চলচ্চিত্রটিতে অনন্ত কেবল পরিচালনাই করেননি, কাহিনি ও সংলাপও লিখেছেন, লিখেছেন গানও। পাশাপাশি গান লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, জাহিদ আকবর ও অনন্য মামুন। সংগীত পরিচালনা করেছেন কিশোর, শওকত আলী ইমন ও ইমন সাহা। আবহ সংগীত পরিচালনায় ছিলেন এস পি ভেংকটেশ। চিত্রনাট্য করেছেন ছটকু আহমেদ।
চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন মাহফুজুর রহমান খান। সম্পাদনায় ছিলেন একরামুল হক। রূপসজ্জায় মনির হোসেন। শিল্প নির্দেশক কলমতর। নৃত্য পরিচালক হাবিব। আর অ্যাকশন দৃশ্য পরিচালনা করেন আরমান।
নিঃস্বার্থ ভালোবাসা মুক্তি পায় ৯ অগাস্ট। নায়ক-নায়িকা যথারীতি এজে অনন্ত ও বর্ষা। অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে আছেন-- রাজ্জাক, সুচরিতা, ডন, মিশা সওদাগর, ইলিয়াস কোবরা, কাবিলা, জামিলুর রহমান শাখা, সিরাজ হায়দার, রাজু সরকার প্রমুখ।
চলচ্চিত্রটি প্রকৃত অর্থেই রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী; অন্তত নাগরিক জীবনে। প্রমাণ, ঢাকার মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্বকারী হল বলাকায় ও সিনেপ্লেক্সে অগ্রিম টিকেট বিক্রির হার। দুই জায়গাতেই ঈদের ছুটির দিনগুলোর টিকেট অন্তত দিনতিনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবং যেসব মধ্যবিত্তের মধ্যে নিজেদের চলচ্চিত্রের প্রতি কোনো ধরনের অনুভূতিই ছিল না, হলে যাওয়া তো দূর অস্ত, তারা পাল্লা দিয়ে ছবিটি দেখতে এসেছে; যদিও অধিকাংশই নেতিবাচক, আরও স্পষ্ট করে বললে উপহাসসূচক মনোভাব থেকেই।
দীর্ঘদিন পর আমাদের মধ্যবিত্ত যে চলচ্চিত্রটি দেখল, তাতে আসলে কী দেখানো হয়েছে? অনন্ত জলিল কি বাংলা সিনেমার কাহিনিগত ঘূর্ণাবর্ত থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন? বা তার যাত্রা কি সেদিকে?
অনন্তের আগের চলচ্চিত্রগুলোতে কাহিনিগত এই ঘূর্ণাবর্ত থেকে বের হয়ে আসার একটা ইঙ্গিত ছিল; আছে এটাতেও। তবে সে ইঙ্গিতটি যেন ক্রমশ কমে আসছে। মূল প্লটটিকে বাংলাদেশের সিনেমায় একরকম নতুনই বলা চলে। বিশাল ধনকুবের অনন্ত প্রবেশ করেছে রূপালি পর্দায়। আর গরিব ঘরের মেয়ে মেঘলা রূপালি পর্দার মোহে ছুটে এসেছে। অনন্তের খোঁজ পেয়ে আঁকড়ে ধরেছে তাকে। পরবর্তী ঘটনা-পরম্পরায় রূপালিজগতের নানা নোংরামিও উঠে এসেছে কাবিলা-মিশা সওদাগরদের চরিত্রের মধ্য দিয়ে। তবে অনন্তের চরিত্রটি বিপরীতধর্মী চরিত্রর প্রতীক। আর মেঘলা রূপালিজগতে এসে তাল হারিয়ে ফেলা মেয়েদের প্রতীক।
নতুনতর এই প্লটের উপর বসানো হয়েছে বাংলা সিনেমার প্রথাগত উপাদানের মোটা আস্তরণ। নায়ক অনন্ত বরাবরের মতোই দেবতুল্য; সাহসে-শৌর্যে ইস্পাতকঠিন, লড়াইয়ে সাক্ষাৎ ইন্দ্র, উদারতায় হারুন-অর-রশীদ, ইন্দ্রিয়জ লোভ-লালসায় জীতেন্দ্রীয়, আবার ভীষণ আবেগপ্রবণও বটে।
বিপরীতে নায়িকা মেঘলার চরিত্র বেশ ঠুনকো। একবার সে একাকিত্ব এড়াতে আরেক পুরুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, আরেকবার আন্তর্জাতিক মডেল হওয়ার বাসনায় প্রবঞ্চনা করে অনন্তের সঙ্গে। অনন্তের ভালোবাসা অবশ্য নিঃস্বার্থ। সে, আদর্শ নায়কের মতো, ভালোবাসার দাবি নিয়েও সামনে দাঁড়ায় না, প্রচণ্ড ক্ষোভে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তাণ্ডবও চালায় না; নিঃস্বার্থভাবে কেঁদে যায়। আর ভালোবাসা তো বটেই, সম্পত্তিও নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দেয় নায়িকাকে। যার কারণে সিনেমাটির নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই বলেই মনে হয়। তবে এতটা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ইন্দ্রপুরীতেও পাওয়া সম্ভব কি না, সে প্রশ্নের অবকাশ অবশ্য আছে।
সিনেমার আরেকটি নামও আছে, ইংরেজি নাম-- ‘What is Love?’। এই নাম নিয়েও আপত্তি করার কিছু নেই; একটা আস্ত গান তো বটেই, সিনেমার চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সে নায়ক অনন্ত নায়িকা মেঘলা ওরফে বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে যে আবেগে What is Love? বলে ওঠেন, তাতেই এই নামকরণ সিদ্ধ হয়ে যায়। তবে নায়িকা চরিত্রকে গুরুত্ব দিলে, নায়িকার একটি সংলাপও নামের অংশ হতে পারত। নায়িকা সিনেমায় নায়কের ধন-সম্পদের একেকটি পরত আবিষ্কার করেন, আর বলে ওঠেন, ‘ওয়াও’। নায়ক তাকে একেকটি উপহার দেন (বাড়ি-গাড়ির নিচে কোনো উপহার নেই), আর তিনি বলে ওঠেন, ‘ওয়াও’। এমনি ‘ওয়াও’ তিনি অনেকবারই বলেছেন। সংলাপটি সংক্রামকও বটে; শেষে গিয়ে এই সংলাপ অন্য আরেক চরিত্রের মুখেও পাওয়া যায়।
সে যাই হোক, ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ সিনেমার নতুনতর প্লটটি সেভাবে চোখে পড়ে না। বাংলা সিনেমার প্রথাগত উপাদানের মোটা আস্তরণের নিচে তা একরকম চাপাই পড়ে গেছে। কাহিনিটা হয়ে গেছে একেবারেই একরৈখিক, চরিত্রগুলো নিতান্তই টাইপ্ড। পুরো সিনেমায় বারবার নায়িকার স্খলন ঘটেছে, নায়ক উদ্ধার করেছে; স্খলনে প্রভাবকের কাজ করেছে খলনায়করা। যার ফলে চরিত্রগুলোর মধ্যেও কোনো বিবর্তন নেই। নায়ক বরাবরই দেবতুল্য, খলনায়করা কুচক্রী। শেষে এসে নায়িকাকে অনুতপ্ত দেখা যায় বটে, কিন্তু সেটাও নায়িকাচরিত্রে পৌনঃপুনিকভাবেই দেখা গেছে; বারবারই সে এমনি করে অনুতপ্ত হয়। পার্থক্য কেবল, শেষ বারে ক্ষমা চাওয়ার মাত্রাটা ভীষণ বেশি।
চলচ্চিত্রটির কাহিনি শুধুই একরৈখিক নয়, ভীষণভাবে পুরুষতান্ত্রিকও বটে। মজার বিষয় হল, টাইপ্ড চরিত্র এবং পুরুষতান্ত্রিকতা-- উভয় বৈশিষ্ট্যই আমাদের সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী। আমাদের সমাজের অধিকাংশ চরিত্রই টাইপ্ড চরিত্র। তাদের আমরা দীর্ঘদিন ধরে একই রকম দেখি; তারা সহজে বদলান না, বদলাতে চাইলেও বদলে যেতে পারেন না। আর আমাদের সমাজ যে ভীষণভাবে পিতৃতান্ত্রিক, তা একরকম অবিসংবাদিরূপে প্রতিষ্ঠিত। ফলে, চলচ্চিত্রে টাইপ্ড চরিত্র এবং ভীষণ পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা পরিত্যাজ্য হলেও, আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে এগুলো থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবুও আখেরে এগুলো চলচ্চিত্রে পরিত্যাজ্যই। আশা রইল, ভবিষ্যতে এজে-র চলচ্চিত্রে আমরা প্লটের পাশাপাশি কাহিনি-চরিত্র প্রভৃতিতেও বিবর্তন পাব।
‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’য় নায়ক চরিত্রের নামও ‘অনন্ত’। অর্থাৎ সিনেমাতেও নায়কের নাম অনন্ত। এই অনন্ত ব্যক্তি অনন্ত কি না, সিনেমা দেখতে দেখতে সে সন্দেহও দানা বাঁধে। কারণ তাদের মিল কেবল নামেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাদের মিল যে কোথায় কোথায় নেই, তা খুঁজে বের করাই তুলনামূলক সহজ। এমনকি সিনেমার অনন্ত ‘দ্য স্পিড’, ‘খোঁজ দ্য সার্চ’, ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ সিনেমাগুলোরও নায়ক। নায়িকাও বর্ষা; তবে তার নাম বর্ষা নয়-- ‘মেঘলা’। এই মেঘলা চরিত্রের সঙ্গে বর্ষার মিলও কিছু কম নয়। এমনকি কিছুদিন আগে অনন্ত-বর্ষার ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে মিডিয়া যে ভীষণ মাতামাতি করল, তারও কিছু ইঙ্গিত চাইলেই খুঁজে বের করা যেতে পারে সিনেমার ভেতরে।
এই মিল থেকে তিনটি অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। পুরো ব্যাপারটি নিতান্ত কাকতালীয়। অথবা তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই চলচ্চিত্রটি বানিয়েছেন এজে। কিংবা তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সেই টানাপোড়েনটি ছিল ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’র প্রচারের জন্য স্টান্ট।
চাইলে দর্শক-সমালোচকগণ এ নিয়ে বিতর্ক করতেই পারেন, আপাতত তৃতীয় অনুসিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা যাক। সে প্রেক্ষিতে এই স্টান্টবাজিকে বাংলাদেশের সিনেমাজগতের অন্যতম সেরা প্রচার-স্টান্ট বলা যেতে পারে। আর সে জন্য অসম্ভবসম্ভবকারী এজের বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য।
প্রচার-স্টান্টের মতো বৈপ্লবিক না হলেও, সিনেমাটির গানগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সিনেমাটির অন্তত তিনটি গানের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হবে-- ‘সাজনা ভালোবেসে ভোলা যায় না’, ‘হোয়াট ইজ লাভ’ ও ‘এ হৃদয় করে তোর সাধনা’। প্রথম ও তৃতীয় গানদুটির কোরিওগ্রাফিও ভালো। আর ‘হোয়াট ইজ লাভ’ গানে স্পেশাল এফেক্টের ব্যবহার একটু বেশি হলেও, তা আনন্দদায়কও বটে। দুটি আইটেম গান ‘ঢাকার পোলা’ ও ‘ডান্স বেবি ময়না’ও বেশ। বিশেষ করে ‘ঢাকার পোলা’র কোরিওগ্রাফি বেশ চটকদার তো বটেই, তাতে আদিরসের অপব্যবহারও নেই। ‘যমুনার জল’, ‘স্বপ্ন দেখি’ গানগুলোও নিতান্ত মন্দ নয়, তবে কোরিওগ্রাফি যুৎসই নয়। সব মিলিয়ে সিনেমাটিতে গান একটু বেশি-ই হয়ে গেছে; একটু পরপরই গান মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ বিরক্তিভাবেরও উদ্রেক করেছে।
সিনেমাটিতে স্পেশাল ইফেক্টের ব্যবহার এজে অনন্তের অন্যান্য সিনেমার মতোই প্রচুর। তবে একদম শেষে হৃদয় বের করে, নায়কের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার স্বরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বোঝানোর অংশটুকু সম্ভবত একটু বেশি-ই স্থ‚ল হয়ে গেছে। স্থূলত্বের দিক দিয়ে তা জাপানি সুমো কুস্তিগীরদের সমকক্ষ হয়ে গেছে। বের করে আনা হৃদয়ে তীর-বুলেট-বোমার আক্রমণ অবশ্য দর্শকদের বেশ বিনোদন দিয়েছে। তবে নায়কের হৃদয়ে নায়কেরই পাসপোর্ট সাইজ ছবি ঝুলিয়ে না দিলে বোধহয় ভালো হত; পাসপোর্ট সাইজ ছবি ছাড়াই বোঝা যেত, ওটা যে নায়কের হৃদয়।
চলচ্চিত্রটিতে আরও অন্তত দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। নায়ক অ্যাক্সিডেন্ট করার পর পুরো দেশ থমকে যাওয়ার প্রতীকি সিকোয়েন্সটি। প্রয়োগ যেমন হোক, সিকোয়েন্সটির চিন্তাটা বেশ ভালো। আর সিনেমার মাঝে সিন ফ্রিজ করে দিয়ে, সে সিনে অ্যাকশন স্টান্ট করতে গিয়ে নায়ক অনন্তর আহত হওয়ার ঘটনাটা জানানোর খুল্লাম খুল্লা প্রক্রিয়াটাও অভিনব। চাইলে কেউ খটমট ভাষা ব্যবহার করে একে উত্তর-আধুনিকতাবাদেও পৌঁছে দিতে পারেন। তবে বাণিজ্যিক ঘরানার চলচ্চিত্রে এমন উত্তর-আধুনিক টেকনিক ব্যবহার করা কতটা গ্রহণযোগ্য, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
সব মিলিয়ে দর্শকরা যে আগ্রহ নিয়ে ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ দেখতে হলে গিয়েছে, মানে নানা স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এজে অনন্ত যে হাইপ তৈরি করতে পেরেছেন, তা প্রশংসার যোগ্য হলেও, তুলনায় সিনেমাটি একটু হতাশই করেছে। বিনোদন-বিবেচনাতেও এর চেয়ে ‘মোস্ট ওয়েলকাম’কে এগিয়ে রাখতে হবে। কাহিনির গাঁথুনিতে ‘মোস্ট ওয়েলকাম’-এর চেয়েও ‘দ্য স্পিড’ উত্তম। এই বিষয়গুলোও এজের ভেবে দেখা দরকার বলে মনে হয়।