বিথঙ্গল বড় আখড়া

গতানুগতিক ভ্রমণের বাইরে একটু অন্যরকম জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার কথা অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে অনেক জায়গাই আছে। তবে হবিগঞ্জের বিথঙ্গল জায়গাটির নাম শোনার পর থেকেই অন্যরকম অনুভূতি হতে থাকল। সেখানে যাওয়ার পথে নৌকায় হাওর ভ্রমণ। সঙ্গে হাওরের বুকে রাতে বসে জ্যোৎস্না দেখা আর ঐতিহাসিক আখড়া তো রইলই। সব মিলিয়ে আলাদা একটা স্বাদ।

আহমেদ সাফি, প্রদায়কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 April 2013, 08:27 PM
Updated : 15 April 2013, 07:54 AM

সবকিছু ঠিকঠাক করে রওনা হলাম। আমাদের বহরে ছিল মোট সাত জন। দলনেতা মিঠু ভাই। বাসে ওঠার আগে সবাইকে নিয়ে সভা করে ফেললেন। তারপর যাত্রা হল শুরু হবিগঞ্জের পথে।

হবিগঞ্জ শহরের কাছে কালাডুবা ঘাট। সেখান থেকেই ট্রলার ভাড়া করে যেতে হয় বিথঙ্গল আখড়ায়। কালাডুবা ঘাটে পৌঁছলাম সকালে। কাছেই আছে ছোট্ট বাজার। সেখানে সবাই নাস্তা করে নিলাম। আমাদের পৌঁছতে সকাল হওয়ার কথা না। এখানে বলে রাখা ভালো, রাতে আমরা নির্দিষ্ট বাসে উঠতে পারিনি। তাই অন্য বাসে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়।

ঘাট থেকে বিথঙ্গল বাজার যেতে সময় লাগবে প্রায় দুঘণ্টার মতো। যাই হোক দরদাম করে জোগাড় করে ফেললাম ট্রলার। রওনা হলাম বিথঙ্গলের পথে। প্রচণ্ড রোদ, তবে মিষ্টি বাতাসের তোড়ে রোদ কোনো পাত্তাই পাচ্ছে না। পথে যেতে যেতে স্বচ্ছ পানিতে দৃশ্যমান পানির জগৎ আর বুক পানিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা হিজলগাছ- কী অপরূপ দৃশ্য! এসব দেখতে দেখতেই বিথঙ্গল বাজারে এসে পৌঁছলাম।

ঘাট থেকে আখড়ায় যেতে পায়ে হেঁটে ২ থেকে ৩ মিনিটের পথ। অবশ্য ঘাট থেকে নেমেই আগে পড়বে একটা জমজমাট বাজার। বাজার পেরিয়ে আখড়ার প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে যেতেই বুঝলাম জুতা খুলে প্রবেশ করতে হবে। আমরা ভিতরে যাওয়ার পরপরই একটা মিশ্র অভিজ্ঞতার স্বাদ পেলাম। যথেষ্ট বড় একটা জায়গা নিয়ে আখড়াটা। বিশাল কক্ষ। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমাদের একটা বড় ঘর দেওয়া হল। ভেতরে দুটি চৌকি বালিশও আছে। আবার আখড়ার মূল যে মন্দির সেখানে প্রবেশ নিষেধ ভিন্ন ধর্মানুসারিদের। তারপর সেখানে বসবাসকারী বৈষ্ণবদের কাছ থেকে এর ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। যদিও আশপাশের মানুষদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম।

বিশাল এই আখড়ায় মোট ঘর বা কক্ষ আছে ১২০টির মতো। লোকমুখে জানা যায় কক্ষগুলোতে ১২০ জন বৈষ্ণব থাকতেন। তবে এখন আছেন কয়েকজন। দুঃখের বিষয় হল প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ এই স্থাপনাটি দেশের অন্যসব পুরনো স্থাপনার মতোই খুব করুণ। জরাজীর্ণ ভবনগুলো যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। ঘটতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া আখড়াতেই। এক প্রকার প্রসাদ দেওয়া হয় এখানে। অনেকটা সবজি আর খিচুড়ির মিশ্রণ। অসাধারণ স্বাদ। তবে সেটা সবাইকে একবারই দেওয়া হয়। অবশ্য আপনি চাইলেই পাশের বাজারে গিয়ে ভরপেট খেয়ে আসতে পারেন। ডাল-ভাত-মাছ যা ইচ্ছা। দিনভর ঘুরাঘুরির পর আখড়া থেকে বেরনোর সময় একটা বিষয় অনেক বেশিই ভালো লাগল। আখড়ার প্রধান ফটকের পাশেই এলোমেলো বেঞ্চে শিশুরা পড়াশোনায় ব্যস্ত। জানতে পারলাম এই আখড়ার মাধ্যমেই চলে এদের পড়াশোনা।

খুব থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল জায়গাটাতে। তবে ফিরতে যে হবেই, সেই সঙ্গে হাওরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় রাতের জ্যোৎস্না দেখার লোভটাও দমন করতে পারলাম না। বেঁচে থাকলে আবার আসার শক্তপোক্ত ইচ্ছা নিয়েই ফিরে আসলাম। আসতে আসতে উপভোগ করলাম নৈসর্গিক এক ব্যাপার। আকাশে চাঁদ আর জল-জ্যোৎস্নার অপরূপ এক মুহূর্ত। এই সময় শুধু একটা কথাই মনে হতে থাকল- হাজার হাজার টাকা খরচ করে বিদেশের মাটিতে ঘুরতে যাওয়ার আগে আমাদের এই ছোট্ট বাংলাদেশটা ঘুরে দেখুন, সত্যি সুন্দর। ভালো লাগবে।

এই আখড়ার ইতিহাস

লোকমুখে জানা যায় প্রায় ৬০০ বা ৪০০ বছর আগে হবিগঞ্জের তৎকালীন রিচি পরগনার অধিবাসী রামকৃষ্ণ গোস্বামী এই আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা। উপমহাদেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান সফর শেষে তিনি বিথঙ্গলে এসে এই আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে পালিত উৎসবের মধ্যে আছে- কার্তিক মাসের শেষদিন ভোলা সংক্রান্তি কীর্তন, ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোল পূর্ণিমা উৎসব।

চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে ভেড়ামোহনা নদীর ঘাটে ভক্তরা স্নান করেন। স্নানঘাটে বারুনির মেলা ও আষাঢ় মাসে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি উৎসবে হাজারো ভক্ত যোগদান করে থাকেন। জানা যায়, আগরতলার মহারাজা উছবানন্দ মানিক্য বাহাদুর প্রতিবছর তার রানিসহ আখড়ায় এসে কয়েকদিন অবস্থান করতেন।

যাওয়ার উপযুক্ত সময়

সাধারণত শরৎকালেই এখানে যাওয়ার জন্য ভালো সময়। বর্ষার বিদায়ী আমেজটা উপভোগ করা যায়। তাছাড়া তখনও ভরপুর পানি থাকে হাওর জুড়ে। অবশ্যই পূর্ণিমার সময়টা খেয়াল রেখে যাওয়ার আয়োজন করা উচিৎ। কারণ ভরা চাঁদের আলো ছাড়া পুরো ভ্রমণই অপূর্ণ রয়ে যাবে।

যেহেতু এই আখড়াটি হাওরের মাঝে ছোট্ট গ্রামে অবস্থিত, তাই থাকার জন্য নেই কোনো হোটেল। তবে হবিগঞ্জ এসে থাকতে পারেন। খাওয়াদাওয়া সারতে পারেন অনায়াসে বাজারের ভাতের হোটেলগুলোতে। খাওয়ার জন্য প্রতিজন প্রতিবেলা গুনতে হবে ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

যাতায়াত

ঢাকার সায়দাবাদ থেকে বাস যায় হবিগঞ্জের দিকে। এর মধ্যে অগ্রদূত, দিগন্ত, বিসমিল্লাহ পরিবহন উল্লেখযোগ্য। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে শুরু করে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পরপর বাস ছেড়ে যায়। দিনের শেষ বাসটি ছাড়ে সন্ধ্যা ৭টায়। ভাড়া এসি ছাড়া ২০০ টাকা। এসিসহ ২৫০ টাকা। হবিগঞ্জ শহরে নেমে সেখানে থকে কালাডুবা ঘাট যাওয়ার জন্য ম্যাক্সিতে উঠতে হবে। ভাড়া জন প্রতি ১৫ টাকা। এই ঘাট থেকে বিথঙ্গল যাওয়ার ট্রলার ভাড়া করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ৬-৭ জনের একটা দল গেলে খরচ অনেক কম লাগবে। একটু দরদাম করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যেই ট্রলার ভাড়া পাওয়া যাবে।