২০১৮ সালের জুনে ‘যুবতী রাধে’ শিরোনামে গানের জন্য সরলপুর ব্যান্ডকে কপিরাইট সনদ দিয়েছিল বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস; সেই গানের কথা ও সুর হুবহু রেখে সরলপুরের অনুমতি ছাড়াই মঙ্গলবার ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ শিরোনামে প্রকাশ করেছে আইপিডিসি।
সরলপুর ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ভোকালিস্ট ও গিটারিস্ট তারিকুল ইসলাম তপনকে ‘যুবতী রাধে’ গানের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কপিরাইট অফিস।
ক্রিয়েটোর পরিচালনায় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের কণ্ঠে প্রকাশিত গানের কথা ও সুরকে ‘সংগৃহিত’ বলে উল্লেখ করায় ফেইসবুক লাইভে ও গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে সরলপুর।
সত্ত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়া গান প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের ৭১ ধারার লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস।
এই ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে কপিরাইট আইনের ৮২ ধারায় ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, “সরলপুর ব্যান্ডকে এই গানের কপিরাইট সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ গানটি পরিবেশন করতে পারবে না। অনুমতি ছাড়া গান পরিবেশন করলে তা কপিরাইট আইনের স্পষ্টত লঙ্ঘন।”
ইতোমধ্যে ব্যান্ডটির অভিযোগের ভিত্তিতে কপিরাইট বিষয়ক জটিলতার কারণে দেখিয়ে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ গানটি সরিয়ে নিয়েছে; বৃহস্পতিবার দুপুরে আইপিডিসির ফেইসবুক পেইজ থেকেও তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তবে মেহের আফরোজ শাওনসহ আরও একাধিক ব্যক্তির ফেইসবুক পেইজে গানটি এখনও রয়েছে।
এর আগে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ফেইসবুক থেকে গানটি সরিয়ে নিয়ে ক্ষমা না চাইলে গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি করেছে সরলপুর।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তারিকুল ইসলাম তপন; যিনি এখন কানাডায় বাস করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের তরফ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গানের কপিরাইট দাবির বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে।
“একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক যে কোনও কার্যক্রম ও সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে সতর্কতা, সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার বিষয়ে আইপিডিসি অঙ্গীকারবদ্ধ। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং স্টেকহোল্ডারদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি।
“…আশা করছি, দ্রুত এই বিষয়টির সমাধান হবে এবং সে পর্যন্ত আমাদের দর্শক শ্রোতাদের ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করার অনুরোধ করছি।”
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পার্থ বড়ুয়াকে টেলিফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
গানের ঠিকুজি তালাশ
২০০৬/২০০৭ সালের দিকে পালাগান দেখতে গিয়ে রাধাকৃষ্ণ সম্পর্কিত পালাগান শুনে রাধাকৃষ্ণের গল্পের উপর গানটি লেখা শুরু করেন বলে জানান তারিকুল ইসলাম তপন।
এরপর ময়মনসিংহ ও শেরপুরে একাধিক কনসার্টে গানটি পরিবেশনের পর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেকে এটিকে মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে সংগৃহিত গান বলে দাবি করলেও কপিরাইট অফিস বলছে, বিষয়টি নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেই সরলপুরকে এ গানের কপিরাইট দেওয়া হয়েছে।
রাধাকৃষ্ণের গল্প থেকে বিভিন্ন তথ্য-ভাবধারা, শব্দচয়ন করলেও হুবহু কোনও কথা নেওয়া হয়নি বলে জানান গানের গীতিকার তপন।
তিনি বলেন, “আমাদের এ গানের সাথে কোথাও কোন গানের হুবহু মিল নেই। গানটি আমরা সম্পূর্ণ রূপে কীর্তন ও লীলা কীর্তনের উপর নির্ভর করে সুর করেছি। কীর্তন ও লীলা কীর্তনের ভাবধারা গানটিতে আনার চেষ্টা করেছি।”
৪২ লাইনের এ গানের সঙ্গে শেষ তিন লাইনের সঙ্গে মৈমনসিংহ গীতিকার একটি পালার মিল খুঁজছেন অনেকে।
এ বিষয়ে অবহিত করা হলে কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৪২ লাইনের গানের মধ্যে শেষ তিন লাইনের সঙ্গে মৈমনসিংহ গীতিকার ভাবগত মিল থাকলেও হুবহু শব্দগত মিল নেই।
“আর শেষ তিন লাইন ছাড়া বাকি লাইনগুলো সেই ব্যান্ডের মৌলিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে তাদের কপিরাইট সার্টিফিকেট দিতে আইনগত কোনও বাধা ছিল না। আর এভাবে দেখলে তো সৃষ্টিই বন্ধ হয়ে যাবে।”
সরলপুরকে কপিরাইট সনদ দেওয়ার আগে বিষয়টি সতকর্তার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল বলে জানান জাফর রাজা চৌধুরী।
গানের ৩০ ভাগ এক বাউল দম্পতির কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল আর বাকি ৭০ ভাগ তারা নিজেরা লিখেছিলেন বলে চ্যানেল নাইনের এক প্রতিযোগিতায় জানিয়েছিলেন তপন।
সে বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে তপন বলেন, “সেই ভিডিওটি পুরোটা প্রকাশ করা হয়নি। সেই বক্তব্যটি খণ্ডিত ছিল। আমরা রাধাকৃষ্ণের গল্প থেকে বিভিন্ন তথ্য-ভাবধারা সংগ্রহের বিষয়ে ৩০ ভাগের কথা বলেছিলাম। কারও কথা আমরা নিইনি। গানটি আমাদের মৌলিক গান।”
এর আগে ‘যুবতী রাধে’ গানকে ‘সংগৃহিত’ বলে উল্লেখ করে কণ্ঠশিল্পী সুমি মির্জা লেজার ভিশনের ব্যানারে ইউটিউবে প্রকাশ করেছিল।
তখন কপিরাইট অফিসে দুই পক্ষের শুনানীতে সুমি মির্জা গানটিকে মৈমনসিংহ গীতিকার পালা বলে দাবি কররেও তার সত্যতা না পাওয়ায় সরলপুরকে কপিরাইট সনদ প্রদান করে কপিরাইট অফিস।
পরবর্তীতে গান নিয়ে সুমী মির্জার সঙ্গে সরলপুরের সেই দ্বন্দ্ব আদালতেও গড়ায়।
মামলার বিষয়ে তপন বলেন, “করোনা পরিস্থিতির পাশাপাশি আমরাও দেশের বাইরে অবস্থান করায় মামলার কার্যক্রম থমকে আছে। আমরা দেশে ফিরলেই আমরা পুনরায় কোর্টে মামলাটি নিয়ে অগ্রসর হব এবং কলার টিউনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গানটি প্রকাশ করায় যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হয়েছি তার জন্য কোর্টে আবেদন করবো।”