ওয়েব সিরিজ: নিষেধ নয়, বিধি চাইছেন সবাই

ওয়েব সিরিজ ‘বুমেরাং’, ‘আগস্ট ১৪’ ও ‘সদরঘাটের টাইগার’ নিয়ে বিতর্কের মধ্যে দেশে ওয়েব কনটেন্ট নির্মাণের পথ বন্ধ না করে সেটিকে নীতিমালার আওতায় আনার প্রস্তাব দিয়েছেন নির্মাতারা।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2020, 04:50 PM
Updated : 24 June 2020, 05:22 AM

‘বিঞ্জ’ প্লাটফর্মের তিনটি ওয়েব সিরিজের ‘যৌন দৃশ্য’ নিয়ে দর্শকদের সঙ্গে ওয়েব সিরিজের চরিত্র বিশ্লেষণে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্কে শামিল হয়েছেন নির্মাতারাও।

মোরশেদুল ইসলাম, অমিতাভ রেজা, অনিমেষ আইচসহ ১১৭ নির্মাতা ওয়েব সিরিজের পক্ষে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন।

অন্যদিকে সৈয়দ হাসান ইমাম, মামুনুর রশীদ, আফজাল হোসেন, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, মাসুম রেজাসহ ৮০ ব্যক্তিত্ব পাল্টা বিবৃতিতে ওয়েব প্লাটফর্মে ‘কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট’ পরিবেশনের অভিযোগ তুলেছেন। 

বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি ও যুক্তি-তর্কের জেরবারে দেশে ওয়েব কনটেন্ট নির্মাণের পথই বন্ধ হয়ে যায় কি না-সেই আশঙ্কাও করছেন অনেকে।

চলচ্চিত্র ও নাটকের বাইরে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে ওয়েব কনটেন্ট নিয়ে চলমান সঙ্কটের সমাধান খুঁজছেন নির্মাতা, নীতিনির্ধারকরা।

টিভি নাটক প্রচারের আগে প্রিভিউ ও চলচ্চিত্রের জন্য আলাদা নীতিমালা থাকলেও ওয়েব কনটেন্টের জন্য কোনো নীতিমালা এখনও হয়নি; ফলে এতে শৃঙ্খলা ফেরানোর তাগিদ দিচ্ছেন দিচ্ছেন অনেকে।

নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলছেন, তিনি শিল্পীর নিরঙ্কুশ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন; তবে স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্বাস করেন না।

তিনটি ওয়েব সিরিজের মধ্যে দুইটিতে ‘গলদ’ থাকলেও ‘মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার’ বিপক্ষে নিজের অবস্থান জানিয়ে বাচ্চু বলেন, বিষয়টি নিয়ে তাদের বোঝাতে হবে। তাই বলে শিল্পীর তো ফাঁসি দেওয়া যায় না।

এই দুই-তিনটি ওয়েব সিরিজকে বিচার করে দেশের ওয়েব কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রিই যেন বন্ধ না করা হয়- সেই প্রস্তাব তুলে বাচ্চু বলছেন, ওয়েব কনটেন্টের জন্য সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এ নির্মাতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিধি হতে পারে কিন্তু নিষেধ নয়। ওয়েব কনটেন্ট প্রকাশের আগে সাটিফিকেশন হোক। যাতে কোন কনটেন্ট ২১ বছরের ঊর্ধ্বের দর্শকদের জন্য আর কোন কনটেন্ট ১৮ বছরের নীচের দর্শকদের জন্য তার প্রত্যয়ন দেওয়া হোক। সেই প্রত্যয়নই বলে দেবে, এই কনটেন্ট কোন বয়সের দর্শকদের জন্য।”

তবে সেটা যেন প্রত্যয়নই থাকে; এর নামে আর্টওয়ার্কের মাঝখান থেকে দৃশ্য ফেলে দেওয়া, সংলাপ বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী নন বলে জানান ‘আলফা’, ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রের এ নির্মাতা।

অন্যদিকে নির্মাতা-অভিনেতা মামুনুর রশীদও বলছেন, তারাও ওয়েব সিরিজের বিপক্ষে না।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঠিক আছে এগুলো চলুক কিন্তু এই রকমভাবে নয়। যে রকম ওরা করেছে এই রকম নয়।”

ওয়েব সিরিজের বিষয়বস্তু নির্বাচনে আরো সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে কোনো ওয়েব সিরিজ হচ্ছে না। আমাদের ইতিহাসের বড় অংশই মানুষ জানে না। সেগুলো নিয়েও কোনো ওয়েব সিরিজ হচ্ছে না।

“কিন্তু সেগুলো নিয়ে ওয়েব সিরিজ করে ছেলে-মেয়েদের যৌনতা ও অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তিন মিনিটের ‘বেডসিন’ দেখানোর জন্য ১১৮ জন ডিরেক্টর লড়াইয়ে নেমে গেল। দিস ইজ আনফেয়ার।

ওরা যদি বলত সরকারের অনিয়ম নিয়ে একটি নাটক করেছি সেটা করতে দিচ্ছে না তখন অবশ্যই তাদের পাশে দাঁড়াতাম।”

চিত্রনাট্যকার মাসুম রেজাও বলছেন, ওয়েব সিরিজের উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের ওয়েব কনটেন্টেও সার্টিফিকেশন করা হোক; তবে সেটি যেন নিয়ন্ত্রণ না হয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে ওয়েব সিরিজের নীতিনির্ধারণ করা হোক। তবে শিল্পমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ নয়, দেখভালের জন্য বাইরে দেশে প্রচলিত আছে। সেগুলো চালু করা হোক।”

শিল্পচর্চার নতুন সম্ভাবনা হিসেবে উল্লখ করে ওয়েব সিরিজে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর দাবি জানান ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ চলচ্চিত্রের এ চিত্রনাট্যকার।

এর আগে মঙ্গলবার বিকালে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে মোরশেদুল ইসলাম, গিয়াস উদ্দীন সেলিম, অনিমেষ আইচ, নাজনীন হাসান চুমকি, রেদওয়ান রনিসহ ১১৭ নির্মাতাও ওয়েব প্লাটফর্মের জন্য বাস্তবধর্মী নীতিমালার প্রস্তাব দিয়েছেন; সেই সঙ্গে পাইরেসি বন্ধেরও দাবি জানান তারা।

কী বলছে তথ্য মন্ত্রণালয়

তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান জানান, সরকার ওয়েব সিরিজের বিপক্ষে নয়।

বাংলার ১৪ শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের বিষয়গুলো তুলে ধরতে নির্মাতাদের উৎসাহিত করে তিনি বলেন, পশ্চিমা বিশ্বকে অনুকরণ করে দেশের ওয়েব সিরিজে ‘ন্যুডিটি’, ‘ভালগারিজম’ তুলে আনা সমীচিন নয়।

ওয়েব সিরিজের নীতিমালার বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক জিজ্ঞাসায় প্রতিমন্ত্রী জানান, সরকার এখনই আইন, নীতিমালা করছে না। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন, তারা কীভাবে এটি এগিয়ে নিতে চান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাইলেই যা খুশি তাই নির্মাণ করতে পারেন না। স্বাধীনতার অপব্যবহার করতে পারেন না। মানুষের অনুভূতি, চিন্তা-চেতনায় আঘাত করার অধিকার কেউ কাউকে দেয়নি। এগুলো মাথায় রেখে তারাই বিষয়গুলো ঠিক করুক।”

গল্পের প্রয়োজনে অনেক ওয়েব সিরিজে ‘যৌন দৃশ্য’ রাখতে হয় বলে জানান নির্মাতারা।

এ বিষয়ে মুরাদ হাসান বলেন, “কাহিনির প্রয়োজনে, চরিত্রের প্রয়োজনে দরকার হলে সেটা শৈল্পিকভাবে দেখাও। যা সত্য তা অস্বীকার করতে বলি না। সমাজের চিত্র তুলে ধরেন। তবে শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। অশ্লীলভাবে পর্নোগ্রাফির মতো তুলে ধরলে হবে না।”