গান আমার বিশ্বাস, গানই ধর্ম: মাকসুদ

চার দশকের বেশি সময় ধরে ব্যান্ড সংগীতে নিজের ছায়া রেখে গেছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মাকসুদুল হক; শ্রোতাদের কাছে যিনি ‘ম্যাক’ নামে অধিক পরিচিত। তিনি সত্তরের দশকে যোগ দেন ‘ফিডব্যাক’ ব্যান্ডে; নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে ব্যান্ডটি ছেড়ে গড়ে তোলেন ‘মাকসুদ ও ঢাকা’।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2020, 11:26 AM
Updated : 11 Feb 2020, 11:55 AM

১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘ফিডব্যাক’র ‘মেলা’ অ্যালবামের ‘মেলায় যাই রে’ শিরোনামে গান দিয়ে তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পাওয়া এ সংগীতশিল্পী সামাজিক অসঙ্গতি তুলে এনে বক্তব্যধর্মী গানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শ্রোতাদের কাছে।

১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় নিয়ে তার ‘মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না’ শিরোনামে গানটি বাংলাদেশে বাইরে কলকাতার শ্রোতাদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে ‘সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্য’ ও ‘উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি’র মতো গানে নিজের ছাপ রেখে গেছেন রক, পপ ও জ্যাজ ঘরানার এ সংগীতশিল্পী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলা গানের বাঁক বদল, গানে প্রযুক্তির ব্যবহার-অপব্যবহার, জনপ্রিয়তার নিরিখে গানের মূল্যায়ন, ধর্মীয় উগ্রবাদ বনাম সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরলেন পাঠকদের কাছে।

বাংলা গানের বাঁক বদল

অনেকে বলে, গানে এখন কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু আমি খুবই ইতিবাচক; ভালো ভালো কাজ এখনও হচ্ছে। ভালো ভালো মিউজিশিয়ান আসছে। আমাদের সময়ে ভালো ব্যান্ড কম ছিল। অ্যালবাম বের হতো কম, টেকনোলজিও অতোটা উন্নত ছিল না। সে তুলনায় এখন কিছু গান তো বেরুচ্ছে।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি 

আমি মনে করি, প্রতিভা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশে এখন বিশ্বমানের কাজ হচ্ছে। শুরুতে মূলত আমরা (ফিডব্যাক) কিংবা মাইলসের মতো ব্যান্ডগুলো পপ ঘরানার গান করেছি। ওয়ারফেইজ এসে সেই ঘরানায় পরিবর্তন আনা শুরু করল। পপ থেকে এখন বিভিন্ন জনরার গান হচ্ছে; এর মধ্যে জ্যাজ, ফোক ফিউশনসহ নানা জনরা আছে।

আমাদের ছেলে-মেয়েরা চাচ্ছে, এখন পৃথিবী তাদের গান শুনুক। আমরা এটাকে বলি, ‘গ্লোবালাইজেশন’। তবে গ্লোব’র মধ্যে বর্ণবাদী আভাস পাওয়া যায়। মানে এখন আমেরিকা, ইউরোপের দিকে তাকিয়ে সবাই বলে এটাই ‘গ্লোব’। কিন্তু আমি এটাকে রিভারস করতে চাচ্ছি। গ্লোব মানে আমরাই গ্লোব; আমাদের দিকে তাকাও। গ্লোবাল মিউজিকের অনেক ধারা আছে; সেখান থেকে কিছু কিছু ধারা আমি বেছে নিয়ে কাজ করছি।

বাংলা গানে প্রযুক্তির ব্যবহার-অপব্যবহার

এখন যেহেতু বিভিন্ন জনরার গান হচ্ছে সেহেতু কোয়ানটিটির অভাব নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন গান আসছে। কিন্তু কোয়ালিটিতে অনেক গান ‘ফল’ করছে। বিভিন্ন জনরার গান তৈরি করতে চেয়ে অনেক টেকনোলজির ব্যবহার ঘটছে। কিন্তু গানগুলো মানুষকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না। কারণ মানুষ এখন আগের মতো গান শুনছে না। এখন মানুষ হেডফোনে কে কী গান শুনছে সেটা জানার উপায় নেই। আগে সবাই বসে স্পিকার ছেড়ে গান শুনত। সেই চর্চাটা এখন উঠে গেছে। এখন মিউজিক লিসনিং ক্লাবও নেই; যেখানে মানুষ বসে চা খাবে, আড্ডা দেবে। শহরে কোনো ডিস্কো নেই- যেখানে মানুষ নতুন গানের সঙ্গে নাচবে।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি 

তবে কনসার্ট আর টেলিভিশনের কিছু শো এখনও চালু আছে। টেলিভিশনের ট্রান্সমিশনের মান এখন খুবই নিম্নমানের; ফলে যতই ভালো পারফর্ম করেন না কেন আউটপুটটা খুব খারাপ আসে। সেকারণে আড়াই-তিন বছর হলো টেলিভিশনে শো করা বন্ধ করেছি। এতো শ্রম দেওয়ার পর আউটপুট দেখার পর হতাশ লাগে।

সে সূত্রে বলব, প্রযুক্তির ব্যবহার যারা ভালোভাবে করছে, তারা ভালো মানের গান পাচ্ছে। আর যারা করছে না কিংবা অন্য ধরনের করছে তারা হয়তো সিরিয়াসলি লাইভ মিউজিক করছে; তবে সেই সংখ্যাটা খুব কম। তবে আমি আশাবাদি, সামনে একটা ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।

জনপ্রিয়তার নিরিখে গানের মূল্যায়ন

আমি সবসময়ই বলি, ‘মানচিত্র’ বলে যেমন একটা শব্দ আছে তেমনি ‘শব্দচিত্র’ বলেও একটা শব্দ আছে। এখানে যেমন দশ বছর আগে গ্রাম ছিল; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলে গেছে। গাড়ি-ঘোড়া-সবকিছুকে শব্দচিত্রের মধ্যে ধারণ করা হয়েছে। পরিবর্তনশীল ‘শব্দচিত্র’ যুগের সঙ্গে তালের সঙ্গে মিলিয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে। সে হিসেবে আগের তুলনায় এখনকার গানের ভিডিওগুলোও আরও বৈচিত্র্যময় হচ্ছে।

 

…এর ভেতরে হয়তো যারা বলছেন, তাদের গান পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, কনসার্টে এই গানগুলো হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে গাইছে। এ বিষয়ে আর্টসেলসহ বেশ কয়েকটি ব্যান্ড নিয়ে নিয়ে প্রচুর ক্রিটিসিজম আছে। কিন্তু হাজার হাজার ছেলেমেয়ে তো ওদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ওয়ার্ড টু ওয়ার্ড ধরে গাইছে-তার অর্থ কী? দর্শকদের মনের ভেতরে এমন কিছু গেঁথে থাকে সেটা সর্বজনীন। শব্দ দিয়েই মূলত সময়কে ক্যাপচার করা হয়।

এক্সক্লুসিভ কিছু ভালো মিউজিক হচ্ছে। এটার সঙ্গে শব্দচিত্রের একটা সম্পর্ক রয়েছে। এই ধরনের সংগীত সারা বিশ্বেই হচ্ছে।

ধর্মীয় উগ্রবাদ বনাম সংস্কৃতি চর্চার অভাব

এখানে ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝি আছে। মানে, ছোটখাট বিষয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেখতে পাচ্ছি। আর এটি কোনো গান নিয়ে হচ্ছে না; সেই ব্যক্তিবর্গের কথা নিয়ে হচ্ছে। এখন যারা আমার কাছে এসে আমাকে বলে, আপনার ধর্ম কী? আমি বলি, ‘আপনি আমাকে চেনেন কীভাবে?’ বলে গানের মাধ্যমে। বলি, ‘আমার কাছে গানটাই ধর্ম।’ গানের মধ্যে যা কিছু আছে সেটাই আমার বিশ্বাস, সেটাই আমার ধর্ম।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি 

তবে শিল্পীরা সবকিছু্র উর্ধ্বে নয়। একজন শিল্পী একজন দ্রষ্টাও হতে পারে। তিনি সামনের দিকে দেখেন। ধর্মীয় উগ্রতা, বর্ণবাদ, জাতিগত রেষারেষিসহ নানা বিষয়ে শিল্পীরা সরব থাকেন।

বাঙালি বাঙালি করতে আমরা ভুলে যাচ্ছি আদিবাসীরাও এই মানচিত্রের একটি অংশ। তাদেরও একটি সাংস্কৃতিক অধিকার আছে। তারাও গাইতে পারে। তাদের আঞ্চলিক গান রয়েছে।

সংগীতই নিজেই একটি ভাষা। আপনি তখনই নিজের ভাষাটা ভালো বলতে পারবেন যখন আরেকটা ভাষা জানবেন। বাউলদের গান আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় গাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে কুষ্টিয়া অঞ্চলের গানে কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয় যেগুলো অন্য কোথাও ব্যবহৃত হয় না।

তথাকথিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা যখন এসব নিয়ে যখন মন্তব্য করেন তখন বলতে হয়, আপনি যেটা চর্চা করেন না সেটা নিয়ে আপনার মন্তব্য করার অধিকার নেই।

আসছে ‘মাকসুদ ও ঢাকা’র নতুন গান

দশটা গানের ট্র্যাক রেডি করেছি কিন্তু একসঙ্গে সবকিছু করা সম্ভব না। কারণ আমার কাজের স্টাইলটা সেটা কিন্তু ডিপারচার ফ্রম কারেন্ট মিউজিক। এখন কিন্তু সিনথেটিক মিউজিক হচ্ছে। যা কিছু আছে সেটা কিন্তু মেশিন তৈরি করে মানুষ তৈরি করে না। সেখানে আমার সবকিছু লাইভ; মন্দিরা, খোল, একতারা, ড্রামস থাকবে। ফিনিশিংয়ে একটু সময় লাগছে। গানগুলোর ভিডিও করার পয়সাও নেই, ইচ্ছাও নেই। অ্যাজ অ্যা লিরিক্যাল ভিডিও আমরা ভাবছি।