বাংলার মাইজভাণ্ডারির সঙ্গে কারেলিয়ান, সুফি-রকে মাতল ঢাকা

আঠারো শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে মারফতি গানে বন্দনা হত আল্লাহ, রসুলের সেই মাইজভাণ্ডারি গানে শুরু হয়ে পাকিস্তানের সুফি-রকে পর্দা নামল আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের পঞ্চম আসরের।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2019, 06:28 PM
Updated : 17 Nov 2019, 05:57 AM

বাংলাদেশের লোকগানের শিল্পী আব্দুল মালেক কাওয়ালি, চন্দনা মজুমদার, রাশিয়ান কারেলিয়ান ফোক ব্যান্ড সাত্তুমের পর পাকিস্তানি সুফি-রক ব্যান্ড জুনুনের পরিবেশনা ছিল তিন দিনব্যাপী এই আসরের শেষ দিনে।

বাংলা লোকগানের শিল্পী আব্দুল মালেক কাওয়ালির আধ্যাত্মিক গানের পরিবেশনায় শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে এক অনন্য দ্যোতনা সৃষ্টি হয়।

মাইজভান্ডারি গানের পরিবেশনায় তিনি শুরুতে শোনান ‘হযরত গাউসুল আজম মাইজভান্ডারি’। হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোলকের সঙ্গতে তিনি একে একে পরিবেশন করেন ‘ইশকে আজম রাসূলে আজম’, ‘দয়াল বাবা মওলানা’ মাইজভাণ্ডারি গানগুলো।

দেশের এ গুণী শিল্পী যখন মঞ্চে উঠেন, তখন আর্মি স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারি ভরে উঠতে শুরু করেছে। কখনও স্থায়ী, কখনও অন্তরা আবার কখনও সঞ্চারিতে দর্শকরা কণ্ঠ মেলালেন আধ্যাত্মিক গানের এই সাধকের সঙ্গে।

গানের মাঝে মাঝেই আধ্যাত্মিকতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন এই শিল্পী। সুর নেশায় বুদ হয়ে দর্শক তন্ময় হয়ে শুনছিলেন মাইজভান্ডারি গানের নানা সূত্র।

এই শিল্পী সদল বলে গাইলেন দুটি কাওয়ালি গান ‘ইশকে নবী দিল মে’, ‘খাজা জি ম্যা হু’।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শনিবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র শেষ দিনে সংগীত পরিবেশন করছে রাশিয়ার গানের দল সাত্তুমা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

তার পরিবেশনা শেষে ১০ মিনিটের বিরতি দিয়ে মঞ্চে আসে রাশিয়ান কারেলিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোর একটি সাত্তুমা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো মাতিয়ে বেড়ানো সাত্তুমা মাতিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মঞ্চও। এবার তারা গাইল ঢাকার মঞ্চে।

তারা গেয়ে শোনান ‘লাউলাজাপইকা’ গানটি। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া কিনোফিল্মি অ্যালবামের এই গানের ইংরেজি অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘দ্য সিঙ্গার বয়’।

পরে তারা শোনান ‘মাতসানেইদোন সুরু’; ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কুদেলমা’ অ্যালবামের  এই গানের অর্থ ‘বন্য দাসীর দুঃখগাঁথা’।

কারেলিয়া অঞ্চলের বেশকটি লোকসঙ্গীতও পরিবেশন করেন তারা। শোনান ‘সনপলকা’ গানটি। গানের ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চে নানা ধরনের ম্যান্ডোলিন, বাঁশি, হাওয়াইন গিটার, বেইজে সুরের মায়াজালে তারা মুগ্ধতা ছড়ান।

উৎসবের শেষ দিনের আসরে তৃতীয় শিল্পী বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতশিল্পী চন্দনা মজুমদার। মঞ্চে এসেই তিনি গাইলেন সাধক লালন সাঁইজির ‘জগত মুক্তিতে ভোলালেন সাঁই’। এরপর তিনি গান আরেকটি লালন সঙ্গীত ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’।

দোতরা, ঢোলক আর বাঁশি- বাংলার লোকজ বাদ্যযন্ত্রের অপূর্ব ধুনে চন্দনার সুর কণ্ঠে তুলে নেন মাঠভর্তি দর্শক। লালনের এই গানের প্রতিটি কলিই যে তাদের জানা! সমস্বরে গেয়ে বাংলার লোকসঙ্গীত এই সাধককে স্বাগত জানান তারা।

চন্দনা তখন বলেন, “আমি কিন্তু আপনাদের পছন্দের গানগুলো করছি, আপনাদের অনুরোধের গানই করছি।”

চন্দনা ধরলেন আরও একটি লালনসঙ্গীত ‘সে কি চেনে মানুষ রতন’। আর্মি স্টেডিয়ামের গ্যালারির দর্শক তখন সব উঠে দাঁড়িয়েছে, ছন্দে-তালে তারাও কণ্ঠ মেলালেন এ গানে।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শনিবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র শেষ দিনে সংগীত পরিবেশন করছে রাশিয়ার গানের দল সাত্তুমা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

গীতিকবি বিজয় সরকারের ‘তুমি জানো নারে প্রিয়’ গানটি চন্দনা মজুমদার কণ্ঠে তুলতেই সুর জাগল স্টেডিয়ামের প্রতিটি কোণে। এরপরে তিনি শোনান ফকির কালা শাহ্-র ‘লোহারে বানাইল কাঞ্চা সোনা’। শেষে তিনি শোনান ‘মনপুরা’ সিনেমার ‘যাও পাখি বলো তারে’ গানটি।

চন্দনা মজুমদার শেষে বলেন, “বাংলার আসল লোকজ যে গান, আপনারা সে গান শুনবেন।”

উৎসবের শেষ পরিবেশনা ছিল পাকিস্তানের সুফি ঘরানার ব্যান্ড জুনুনের। ১৯৯৭ সালে চতুর্থ অ্যালবাম ‘আজাদি’র ‘সাওনি’ দিয়ে উপমহাদেশের শ্রোতাদের মন জয় করে নেয় ব্যান্ডটি।

ব্যান্ডের লিড ভোকাল আলী আজমত ঢাকার মঞ্চে বাংলার লোকসঙ্গীত সাধকদের সঙ্গে পারফর্ম করতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “চমৎকার মানুষ আপনারা। এখানে আসতে পেরে সত্যিই অন্য রকম লাগছে। লোকগানের প্রতি এতটা নিবেদন আপনাদের! এই মঞ্চে গাইতে পারাও তো… আপনারা সম্মান জানবেন আমার।”

পরে তারা শোনায় বলিউডি সিনেমা ‘হাফ গার্লফ্রেন্ড’-র ‘তু হি হ্যায়’ গানটি। এরপর শোনায় ‘ইয়ে দিল হ্যায় তোমহারা’।

এরপর নিজেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘সাইওনি’ গানটি পরিবেশন করে পাকিস্তানি এই ব্যান্ড দল। ১৯৯৭ সালে নিজেদের চতুর্থ অ্যালবাম ‘আজাদি’-র প্রথম ট্র্যাক ছিল গানটি। এই এক গানেই উপমহাদেশে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় পাকিস্তানের ফোক গানের এই ব্যান্ড।

অ্যালবামের প্রথম গান ‘সাইওনি’ পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ- তিন দেশের শ্রোতাদের কাছেই জনপ্রিয়তা পায়। বিশ্বব্যাপী ‘জুনুন’-র ত্রিশ মিলিয়নেরও বেশি অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে।

এরপর হালের পপ ধারার সঙ্গে ফিউশনে তারা শোনান পাকিস্তানের সুফি সাধক বুল্লে শাহ’র ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’।

জুনুনের গানের সঙ্গে উন্মাতাল দর্শক সারিতে এবার নামল নীরবতা। আলী আজমত, সালমান আহমেদরা এবার ধরলেন বড় মন খারাপের গান।

জুনুনের ‘পারভেজ’ অ্যালবামের ‘মিট্টি মে মিল জায়েঙ্গে’ গানটি শুরু হতেই নীরব পুরো স্টেডিয়াম। খানিক আগেই যে তরুণ উদ্বাহু নেচেছিলেন, সেই মুখ একদম চুপচাপ। এরপর এই অ্যালবামের ‘বুল্লেয়া’গানটিও শোনায় তারা।

এমন মন খারাপে কি গান গাওয়া চলে! ঢোল আর ড্রামসের ধুনে আবার মাতিয়ে তুলল জুনুন। এবার আলী আজমত গাইলেন ‘ইয়ার বিনা দিল মেরা’ গানটি।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শনিবার ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে’র শেষ দিনে সংগীত পরিবেশন করছেন দেশের জনপ্রিয় কাওয়ালি শিল্পী মালেক কাওয়াল। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

পরের গানটি রক ধাঁচের। ১৯৯৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ইনকিলাব’ অ্যালবামের ‘মেরা মাহি’ আর ‘চালে থে সাথ’ গান দুটো যখন জুনুন গাইল মঞ্চে, তখন সারা স্টেডিয়াম মন খারাপ ভুলে আবার ভাসল উচ্ছ্বাসে।‘ইনকিলাব’ অ্যালবামের ‘ইয়ারো ইয়াহি দোস্তি’ গানটিও পরে শোনায় তারা।

আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব ঢাকা ফোক ফেস্টের এটি ছিল পঞ্চম আসর। এ আসরের প্রথম দিনে পারফর্ম করেন জর্জিয়ার লোক গানের দল ‘শেভেনেবুরেবি, বাংলাদেশের বাউল শিল্পী শাহ আলম সরকার, ভারতীয় সংগীতশিল্পী দালের মেহেন্দি।

ফোক ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে পারফর্ম করেন বাংলাদেশের লোকশিল্পী কাজল দেওয়ান, ফকির শাহাবুদ্দিন, ম্যাজিক বাউলিয়ানার কামরুজ্জামান রাব্বি ও শফিকুল ইসলাম, মালির হাবিব কইটে অ্যান্ড বামাদা এবং পাকিস্তানের সুফি গায়িকা হিনা নাসরুল্লাহ্।

প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হয়ে উৎসব চলেছিল রাত ১২টা পর্যন্ত। বাংলাদেশসহ ছয় দেশের দুই শতাধিক শিল্পী অংশ নিয়েছেন এবারের উৎসবে।

এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত ছয় খ্যাতিমান সংগীত শিল্পী সুবীর নন্দী, বারী সিদ্দিকী, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, ফকির আব্দুর রব শাহ ও আইয়ুব বাচ্চুকে।

২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট’। বিগত চার বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও এ উৎসবের আয়োজন করেছে সান কমিউনিকেশন।