গান গেয়ে নয়, গান জড়িয়ে বেঁচে আছি: শুভেন্দু মাইতি

‘গান গেয়ে নয়, গান জড়িয়ে’ বেঁচে থাকার গল্প শোনালেন জীবনে ‘কিছুই হতে না চাওয়া’ পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী শুভেন্দু মাইতি।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2019, 07:46 PM
Updated : 27 July 2019, 07:46 PM

শনিবার বিকেলে রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে কৃষ্টি ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ‘বাংলা গানের পরম্পরায় গান গল্পে’ শীর্ষক আয়োজনে দুই ঘণ্টা গান-গল্পে মুগ্ধতা ছড়ালেন বাংলা সংস্কৃতির শেকড় খুঁজে ফেরা এ শিল্পী।

নিজেকে ‘গানের মজুর’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে মোদিনীপুরের নন্দীগ্রামে জন্ম নেওয়া এ শিল্পী বলেন, ছোটবেলায় তার সহপাঠীরা যখন ডাক্তার, প্রকৌশলী আর বৈমানিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তখন শিক্ষককে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘কিছু হব না, কিচ্ছু হব না’।

‘কিছু হতে না চাওয়ার’ সাধনাতেই নিজের মধ্যে শিল্পী সত্তা অনুভব করেন জানিয়ে শুভেন্দু বলেন, “গান গেয়ে নয়, গান জড়িয়ে বেঁচে আছি। আমি জনপ্রিয়তা চাইনি। আমি গান লিখতে পারি, সুর করতে পারি কিন্তু কোনোটিই গ্রহণ করিনি। আমার একমাত্র সত্তা, আমি গানের মজুর।”

লোক সংগীতকে ‘আটপৌঢ়ে মায়ের’ সঙ্গে তুলনা করেন ৭৫ বছর বয়সী এ শিল্পী। তিনি বলেন, “শাড়ির আঁচলে হলুদের দাগ লাগা আটপৌঢ়ে মাকে জিনস, টপ পরিয়ে, গায়ে সুগন্ধি লাগিয়ে রাস্তায় দাঁড় করালে হবে না।

“লোক সংস্কৃতির মূলভিত্তি লালনের গান, হাছনের গান, রাধারমনের গান; এগুলোকে এখন বাজারে পণ্য হিসেবে মোড়কে বন্দি করে হাজির করানো হচ্ছে। লোক সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে না পারলে নাগরিক সংস্কৃতিটাও থাকবে না। শেকড়টা নষ্ট হয়ে গেলে শরীরটাও নষ্ট হয়ে যাবে।”

লালনের আখড়ার গান নগরে এসে বদলে যাচ্ছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে এ শিল্পী বলেন, সংগীত কোনো জড়বস্তু নয়, সংগীত পাল্টাবেই।

তার ব্যাখ্যা, “লালন কেমন করে গান গাইত? কোনটা ঠিক সুর? গান পাল্টাবেই। সংগীত কোনো জড়বস্তু নয়। লালন যে বাংলায় গান লিখেছেন সেই বাংলায় দুইশ বছর আগে বর্ণপরিচয় লেখা হয়নি। বাংলা ভাষা তখন অপরিণত ছিল।…গাইতে গাইতে বাংলাদেশের গান চলে গেছে বীরভূমে-সেই গান অবিক্রিত থাকতে পারে?”

গান বদলের পক্ষে থাকলেও বিকৃতির ঘোর বিরোধী তিনি। ‘মাকে শাড়ির বদলে জিন্স আর টপস পরিয়ে’ বাজারে তোলাকে ‘অনাচার’ বললেন তিনি।

এরপর তিনি একটি ‘ভাদু’ গান গেয়ে শোনান। বীরভূমের সন্তোষ কর্মকারের লেখা ‘যখন একা থাকি দিশেহারা বড় অসহায় লাগে’ শিরোনামে গানটি পরিবেশনের আগে ‘ভাদু’ গান নিয়ে ধারণা দেন।

তিনি বলেন, ভাদ্র মাসের শুরু থেকে শেষ অব্দি নারীরা ফসলের আকাঙ্ক্ষায় ব্রত পালন করেন, আর গান গায়। ‘ভাদু’ গানে মেয়েদের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, বিরহ ফুটে ওঠে।

দর্শকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গান শেষ করে আবারও লোক সংস্কৃতি নিয়ে আলাপচারিতা শুরু করেন।

বাংলাদেশকে লোক সংস্কৃতির ‘হেড অফিস’ অভিহিত করে শুভেন্দু বলেন, “এটি বাঙালির নিজস্ব বাসভূমি, যা লড়াই করে অর্জন করেছে, কেউ দয়া করে দেয়নি। ভাষাকে সামনে রেখে, সংস্কৃতিকে সামনে রেখে লড়াই করেছে। লোক সংস্কৃতির মূল শেকড়টা বাংলাদেশেই থাকবে। মননে, বুদ্ধি, সৃজনশীলতায়, দেশপ্রেমে বাঙালি সমস্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জনগোষ্ঠী।”

এ সময় দর্শক সারি থেকে একজন ভারতীয় প্রশ্ন করেন, “বাংলাদেশে বসে আপনি বাঙালি জাতিসত্তার কথা বলছেন। কিন্তু ভারতে বাঙালি লোকসংস্কৃতির উপর আক্রমন চলছে। বিষয়টি নিয়ে আপনার করণীয় কী?”

“রাস্তায় নেমে লড়ব। প্রয়োজনে লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে লড়ব,” বলেন শুভেন্দু মাইতি।

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি বাঙালির মাঝে লোক সংগীত ছড়িয়ে দিতে ও লোকগানের মূল সুর-রক্ষা তথা গবেষণার জন্য ‘লালন আকাদেমি’ গড়েছেন তিনি।

শিল্পী বলেন, “যারা বাইরে আছেন তাদের মধ্যে লোকাচারের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। ৭৫ বছর বয়সেও আমি আশাবাদী মানুষ, আমৃত্যু তাই থাকব। আপনারা আশির্বাদ করুন, গান গাইতে গাইতে যেন মরতে পারি। আমরা পারব।”

এরপর তাকে নিয়ে ১০ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। তথ্যচিত্রে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে  বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা তিনজন বন্ধু বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান করতাম। আর গামছা পেতে চাঁদা তুলে যা পেতাম তা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠাতাম। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঘোষণা শুনলাম, তখন তা ছড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের হাজারো মানুষের মধ্যে। দেশ যুদ্ধকে ভাগ করতে পারেনি, কারণ বাংলাদেশের যুদ্ধটা ছিল বাংলা ভাষার জন্য।”

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন কৃষ্টি ফাউন্ডেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বুলবুল মহলানবীশ ও সাধারণ সম্পাদক এনায়েত কবির।