‘বেঙ্গলি বিউটি’ কি টিকেট কেটে দেখার মত ছবি?

মিথ‍্যা বলে লাভ নেই, রাশান নূর পরিচালিত 'বেঙ্গলি বিউটি' ছবিটির প্রিমিয়ার শো দেখার বহু আগেই অনলাইনে দুটো ট্রেইলার দেখে একাধিক বিশিষ্টজনকে বলেছি- ‘মনে তো হয় না এই ছবি দেখার মতো কিছু হবে!’

অনিক খানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2018, 11:59 AM
Updated : 24 July 2018, 03:45 PM

সাধারণতঃ ‘বিনোদন মূলক’ কোনো প্রকার দাওয়াতে আমি তেমন যাই না সেটা অনেকেরই জানা, আমার আগ্রহ মূলতঃ একটু হার্ডকোর সংবাদে। তবে চলচ্চিত্র দেখতে আমার ভালো লাগে যদিও সেটা এইচবিও বা নেটফ্লিক্সেই সীমাবদ্ধ। তারপরও কেন ‘বেঙ্গলি বিউটি’ ছবিখানা দেখতে গেলাম? কারণ ওই যে শুরুতেই আমি নিশ্চিত ধারণা করেছিলাম বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যদি এই ছবি পয়সা খরচ করে দেখতে হয় সেটা আমার জন‍্য গ্রিক ট্রাজেডির কাছাকাছি হবে।

এমনকি, যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেপ্লেক্সে ‘বেঙ্গলি বিউটি’ শুরু হওয়ার বেশ আগেই পৌঁছে যাওয়ায় কলাকুশলীদের সঙ্গে ফটাফট রেডকার্পেট ফটোসেশন শেষ করে, দুএকবার ভেবেছিলামও যে আমি যে এসেছি তার প্রামাণ‍্য দলিল তো তৈরি হয়ে গেল, এবার হালকা কেটে পড়ে এই ছবির বদলে টিকেট কেটে জুরাসিক পার্ক থ্রিডিটা দেখে ফেলি। দেখা হয়নি।

এই ছবি দেখার আরও কারণ ছিল- ছবিটি ছাড়পত্র পেতে বেশ সময় নিয়েছে, সেটা কেন? ট্রেইলার অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও এই জুলাই মাসের ১৯ তারিখ লেগে গেল, তা বোঝার একটা আগ্রহ ছিল। আর আগ্রহ ছিল ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় মানে মধ‍্য-৭০ দশককে ঘিরে।

কাজেই, তরুণ পরিচালকের মগজ ২০১৮ সালের একটি ছবিতে সে সময়টাকে কীভাবে চিত্রায়ন করলো সেটা দেখার ইচ্ছার সঙ্গে খানিকটা বিরক্তিও ছিল। জাতীয় চলচ্চিত্রে যখন (তথাকথিত) ভদ্র সমাজের দেখার মতো বাণিজ‍্যিক ছবির সংখ‍্যা যেটা ‘এই সময়ের গল্পের ছবি’ তা হাতে গোনা, সেখানে সত্তর দশকের পেছনে লাগার কী আছে?

সত‍্যি সত‍্যিই ছবিটি দেখতে হলঘরে ঢুকেছিলামই হাসাহাসি ও গালাগালি করার একটি দারুণ সুযোগ পেলাম ভেবে। এবং হাসাহাসির আগে গালাগালির সুযোগই পেয়ে গেলাম। প্রিমিয়ার শো’তে দাওয়াত পেয়েছিলো অল্পসংখ‍্যক ব্যক্তি। কিন্তু কোনো টি-শার্ট, চাবির রিং, মগ-টগ ইত‍্যাদি'অলা কোনো গুডি ব‍্যাগ নেই, অন‍্যান‍্য ছবির প্রিমিয়ার শো’র মতো মিডিয়ার ক‍্যামেরার হুড়োহুড়ি নেই– বোঝাই যাচ্ছে বেশ তাড়াহুড়ো করেই আয়োজনটি হয়েছে।

কেন ভাই? এত যখন দেরি হলই আরেকটু প্রস্তুতি নিয়ে প্রিমিয়ার হলে ক্ষতি কী ছিল? তার ওপর আবার আমার দাওয়াত ছিল দু'জনের। এ যেন আরেক রসিকতা!

আমার প্লাস ওয়ান হওয়ার মতো কেউ নেই বিধায়, বান্ধবী তো দূরের কথা আমার চেয়ে সুপুরুষ সাংবাদিক ও অভিনেতা সুমন পাটোয়ারীকে করতে হল আমার সঙ্গী।

আবার ধরেন, কোনো কমপ্লিমেন্টরি পপকর্ন-ড্রিংকসও নেই! (অবশ‍্য ছবির কোনো এক ফাঁকে আয়নাবাজিখ‍্যাত নায়িকা নাবিলা এসে আমার বাঁ পাশে বসা সুমন পাটোয়ারীর হাতে পপকর্ন ধরিয়ে দিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না, এবং সেটা কি আমার জন‍্য ছিল না সুমন পাটোয়ারির জন‍্য, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে বিতর্ক নেই আমার ডানে বসা ঝাকানাকা প্রজেক্টখ‍্যাত জনপ্রিয় ইউটিউবার ও রেডিও জকি আরেক চৌকষ তরুণ ফাহাদের এনে দেওয়া এক বোতল বরফ শিতল পানির মালিকানা নিয়ে - যার অবশ‍্য 'জাস্ট এক চুমুক'-এর কথা বলে আরেক জনপ্রিয় রেডিও জকি সারজিনা ইসলাম কর্তৃক অর্ধেকের বেশি খেয়ে দেওয়া।

এসব দুঃখের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমার সঙ্গী সুমন পাটোয়ারীও হলে ঢোকার আগে আমাকে পপকর্ন কিনে দিয়েছিলেন। নাবিলার দেওয়া পপকর্ন থেকে সর্বোচ্চ ১১টা আর পাটোয়ারীর কিনে দেওয়া পপকর্ন থেকে মাত্র ৯টা ভুট্টা দানা খেতে পেরেছিলাম। জাতীয় সঙ্গীত শেষে বসার খানিকক্ষণ পরেই সুমন পাটোয়ারীরই হাত খালি দেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘পপকর্ন শেষ?’ তিনি বিশাল টান দিয়ে বললেন- ‘সেই কখওওওওওন!’)

যাইহোক, ‘বেঙ্গলি বিউটি’ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি — এবার ছবিতে আসি। ছবিটি শুরু হওয়ার পর থেকেই মূল উদ্দেশ‍্য অনুযায়ী (কেউ দায় এড়াতে পারবেন না) একবার বামে সুমন পাটোয়ারী একবার ডানে ফাহাদের সঙ্গে হাসাহাসি শুরু হলো— এটা কী দেখালো হাঃ হাঃ হাঃ! এর মানে কী? হাঃ হাঃ হাঃ! কাহিনি বলতেছে বাংলাদেশের অগাস্ট মাসের আর নায়ক পরে আছে জ‍্যাকেট, আরে বিদেশ থেকে আসছে বুঝাইতে হবে না? হাঃ হাঃ হাঃ...

তবে আশ্চযর্জনকভাবে সেটা বেশিক্ষণ চালাতে পারিনি। প্রথমার্ধের অর্ধেকের বেশি কেটে যাওয়ার পর ফাহাদ যখন নিচু গলায় বলল- ‘ভাইয়া, ইটস নট ব‍্যাড! নট ব‍্যাড এট অল!’ তখন খেয়াল হল কখন থেকে যে গল্পের ভেতর ঢুকে গিয়ে চুপচাপ ছবিটা দেখতে শুরু করেছি তা বলতে পারবো না!

এবার তবে গল্পের কথায় আসি। না, ভয় নেই, স্পয়লার দেবো না কোনো।

ঘটনা মূলতঃ ১৯৭৫ সালের অগাস্ট মাসের। আমি নিজে সামান‍্য লেখালেখি করি আর মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শোকের ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই বছর ও মাসটি নিয়ে কিছু পড়াশোনা থাকায় বেশ কয়েকটি জায়গায় খটকা লেগেছে। খটকা লেগেছে দিনক্ষণ হিসাবের কিছু গড়মিলেও। কিন্তু যে গল্প আমার মতো নিশ্চিত গালি দিবো সিদ্ধান্ত নিয়ে যাওয়া দশর্ককে বেশিরভাগ সময়েই মগ্ন করে রাখতে পেরেছে, সেই গল্পের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্ভবত উপেক্ষা করা যায়।

আমার জানা মতে গল্পকার/চিত্রনাট‍্যকার/পরিচালক এবং ‘নায়ক’ একজনই অর্থাৎ রাশান নূর হওয়ায়- শুরুতে আমার অভিযোগ থাকলেও, অবশেষে এতে আমার সুবিধাই হয়েছে। আলাদা আলাদা করে বেশি মানুষের নামে প্রশংসা বা অভিযোগ লিখতে হচ্ছে না!

গল্পটি দারুণ। তবে ছবিতে এসে এর গাঁথুনিকে ততটা শক্ত মনে না হলেও, ছবিটি লিনিয়ার হয়নি। বরং একটি সফল গল্পের আদলেই তার ভেতরে ছিল নানা শাখা-প্রশাখা - যা দর্শক মানে এই ক্ষেত্রে আমাকে মনোযোগ দিয়ে ছবিটি দেখতে বাধ‍্য করেছে। মনে মনে তালি দিয়েছি যেভাবে জনাব নূর সুকৌশলে গল্পের ভেতর গল্প ঢুকিয়ে দিয়েছেন সাবলিলভাবে সে কারণে। আর তালুতে তালু বাজিয়ে তালি দিয়েছি ছবিটির চরিত্রদের সংলাপের মাঝে সুন্দর কিছু ফিলোসফি এবং দারুণভাবে কিছু হিউমার ঢুকিয়ে দেওয়ার দক্ষতায়। সঙ্গে এটাও অবশ‍্য বলতে হবে যে সংলাপগুলো অধিকক্ষেত্রেই চাবুকের মেদহীন হলেও কিছু জায়গার, বিশেষ করে কয়েকটি রসিকতার জায়গায় একটু ‘ফেইল’ করেছে।

তবে হিউমার খুবই কঠিন ব‍্যাপার, বিশেষ করে রিপিটেটিভ যে 'রসিকতা'গুলা ছিল, সেগুলো হিসাবে ধরলে ভালো মাকর্স পেয়েই পাশ করেছেন লেখক রাশান নূর। দ্বৈত-অর্থের সংলাপগুলোও বেশ পোক্ত লেগেছে - কয়েকবার চমকে উঠেছি!

অন‍্যদিকে অভিনেতা রাশান নূর, যদিও তার কাজও আগে দেখিনি তবু এই ছবিরই সিংহভাগে তার অভিনয়ের নৈপুন‍্য দেখে মনে হয়েছে, নায়ক বা মূলচরিত্র হিসাবে ‘বেঙ্গলি বিউটি’-কে তিনি তার সম্পূণর্টুকু দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

অন্ততঃ একটা বিষয়ে অভিনেতা রাশানকে, পরিচালক রাশানের ধরিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল যে কলেজে মঞ্চনাটক করা আফজাল (চরিত্রের নাম) ছেলেটির আর দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকা ও সেখানেই পড়াশোনা করে আসা আফজালের কথার ঢং (একসেন্ট) একরকম হবে না। অবশ‍্যই স্পষ্ট কিছু পাথর্ক‍্য থাকবে। কিন্তু পুরো ছবিতে ব‍্যক্তি রাশান নূরের প্রবাসী একসেন্ট ছাড়া ভিন্ন কিছু পাওয়া যায়নি। বাকিসব ঠিক থাকলেও এই একটি মাত্র, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কারণে তার অভিনয়ের এবং পরিচালনার সর্বোচ্চ প্রশংসা করা যাচ্ছে না।

ওদিকে নায়িকা মুমাতাহিনা চৌধুরী টয়ার (ময়নার চরিত্রে) অভিনয় শুরু থেকেই একটু হাঁপানির রোগীর মতো লেগেছে। ছবির ধারাবাহিকতায় জীবনে প্রথমবার বাংলাদেশ বেতারে নায়কের কন্ঠস্বর শোনার মুহূর্ত থেকেই ডাক্তারি ভাষায় তার ‘হেভি ব্রিদিং’ দেখে তাই মনে হয়েছে!

তবে পাঠক, যারা এই ছবির দর্শক হবেন, তাদের জন‍্য বলছি, দুঃশ্চিন্তা করবেন না, আপনাদের প্রিয় অভিনেত্রী সুস্থ আছেন। এবং তার এই বুক ধরপড়ানির অভিনয়ের পেছনেও যথেষ্ট কারণ আছে... সম্ভবত এটা ছোট একটা স্পয়লার হয়ে গেল। স‍্যরি! টয়ার অভিনয়ও আমার আগে দেখা হয়নি। প্রথম দেখায় মুগ্ধই হয়েছি।

যদিও এক ছবির বিষয়ে লেখায় অন‍্য ছবির বা তার শিল্পীদের কথা টেনে আনা বা তুলনা করা দুষ্টলোকের কাজ, কিন্তু বাজারে আমার দুষ্টলোক হিসাবে একটু নাম-গন্ধ থাকায় সেটার সুবিধা নিয়ে বলছি— বেঙ্গলি বিউটির আগে আমার দেখা শেষ বাংলাদেশের ছবিটি হলো 'ঢাকা অ্যাটাক', সেটাও দেখেছিলাম সিঙ্গাপুরের প্রিমিয়ার শো-তে আমন্ত্রিত হয়ে, দলবলসহ সম্পূর্ণ কমপ্লিমেন্টারি, এবং সে জন‍্য আমি নিজেকে ভাগ‍্যবান মনে করি!

যদিও আমন্ত্রিত আমি ছাড়াও এতবড় একটা দল নিয়ে উপস্থিত, তাই আমন্ত্রণ গ্রহণ করার পর এর বানিজ্যিকভাবে সিঙ্গাপুরে মুক্তি দেয়ার মূল নায়ক অমিতাভ নাগের পেছনে লেগে থেকে অন্ততঃ আমাদের দলের অর্ধেক মাথার টিকেটের দাম দিতে শেষমেষ ৬ফুট ৪ইঞ্চির ডা. ওয়াসেকের সঙ্গে একরকম মারমুখী হয়েই হয়েই তিনি এক সময়ে আমাদের অর্ধেক দলের টিকেটের দাম নিতে বাধ‍্য হয়েছিলেন!

ইদানিং আবার শুনছি সেই ছবিটির ২য় পর্ব (সিক্যুয়েল) না কি আসছে, এই তথ‍্য জেনে আমি একটু দুঃশ্চিন্তাতেই পড়ে গেছি!

ঢাকা অ্যাটাকের নায়িকা মাহিয়া মাহির অভিনয়ও সেখানেই আমার প্রথম দেখা। সেই ছবিতে মাহির প্রথম শটেই এবং পয়লা দিনেই হাউজফুল সিঙ্গাপুরী-বাঙালি দশর্কদের করতালিতে ভেঙে পড়লো! ঢাকার একজন শিল্পীর এই পরিমাণ ভক্ত দেখে সত‍্যি ভালো লেগেছিলো।

কিন্তু আমি যেহেতু নায়িকা ম‍্যাডামকে চিনি না, বাধ‍্য হয়ে পাশে বসা বন্ধু সিঙ্গাপুরিয়ান-বাঙালি ইমরানের কাছে ফিস ফিস করে জানতে চাইলাম ‘তিনি কে? নাম কী’ আমি তার নামও জানি না দেখে ইমরান আধো আলো অন্ধকারে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নাম বললেন। আমার তখনই মোবাইলে সার্চ করে জানতে পারলাম যে তিনি ভীষণ জনপ্রিয় ও বিনোদন মিডিয়ার নিয়মিত অভিনেত্রী। তার নামের পাশে বেশ কয়েকটি সফল চলচ্চিত্রের নামও রয়েছে।

বেঙ্গলি বিউটি শেষে একে-ওকে জিজ্ঞের করে জানলাম- টয়ার জনপ্রিয়তা মাহির জনপ্রিয়তার ধারে কাছে নেই। কিন্তু, আমার চোখে নতুন নায়িকা দশর্নের বিচারিক প্রক্রিয়ার খাতায় রায় লেখা হলো- অভিনয় শিল্পী হিসাবে মাহিয়া মাহির তুলনায় টয়ার জনপ্রিয়তা কম হওয়াটা, টয়ার প্রতি রীতিমতো একটি সামাজিক অবিচার!

মাহির জনপ্রিয়তা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু টয়া তার অভিনয়ের জন‍্য আরও বেশি জনপ্রিয়তা প্রাপ‍্য! এবং আমি নিশ্চিত, বেঙ্গলি বিউটির অভিনয় দিয়েই টয়া- জনপ্রিয়তায় অন‍্য কারও চেয়ে না এগুলেও, দশর্কের কাছে গ্রহণযোগ‍্যতায় এগিয়ে যাবে বহুদূর। বাসায় ফিরে ইউটিউব খুঁজে তার কিছু কাজের ক্লিপস দেখলাম। ছোটপর্দার শিল্পীকে প্রথমবার বড়পর্দার আদলে সাবলীল অভিনয় করাতে পারার সাফল‍্যের ভাগ আমি পরিচালককেও দেবো।

অভিনয় দিয়ে আমাকে মুগ্ধ করেছেন আরও দু'জন। তারাও বড় পর্দার দুই নবাগত সারাহ আলম (মিতা চৌধুরী চরিত্রে) এবং আশফিক রিজওয়ান (রাফেল চরিত্রে)। এই ছবির সারাহই আমার একমাত্র 'খাতির-আছে' ধরনের পূর্ব পরিচিত, তবে সেটা রেডিও জকি ও এমটিভি বাংলাদেশের সাবেক ভিডিও জকি হিসাবে।

তাই আমি এটা নিশ্চিত ছিলাম এবং সারাহ কোনো একটি চলচ্চিত্রে কাজ করতে যাচ্ছে জানার পর সম্ভবত তাকেই বলেছিলাম- "শাবাশ সারাহ! ওই ছবি যদি কেউ ডুবায়, তাহলে তুমিই ডুবাবা!”

কিন্তু ছবি শেষে আমি তার কাছে অফিসিয়ালি ক্ষমা প্রার্থনা করেছি। এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’য়ের মাধ‍্যমে তাকে বলছি- ‘মানুষের ভেতর লুকায়িত গুণের ওপর আস্থা না রাখার কারণে আসলে আমি নিজেকেই নিজের কাছে ডুবিয়েছি! শাবাশ সারাহ!’

বড় পর্দায় চোখ-মুখ-নাক-হাত-পা সবকিছুর এক্সপ্রেশনই গুরুত্বপূর্ণ। তবু খুব সুন্দর করেই রাগ-ভালোবাসা-বিরক্তি-আশা-হতাশা সে দেখাতে পেরেছে - এর জন‍্যেও সারাহর সঙ্গে পরিচালককেও লাল সালাম! মঞ্চের মানুষের অভিনয় ভালো হবেই, তবুও বড় পর্দার আরেক নবাগত আশফিক রিজওয়ান অভিনয় করেছেন একটি নেগেটিভ চরিত্রে। তবে তার চরিত্রটি ঠিক টোটাল বদমাশ ধরনের নয়, যে ক‍্যারেক্টার প্লে করা তুলনামূলক সহজ, তার চরিত্রটি ছিল খুবই বিরক্তিকর একজন মানুষের। যা ফুটিয়ে তোলা যা বেশ দুষ্কর। কিন্তু সেই চরিত্রে তিনি এমনই ‘রিয়েলিস্টক’ অভিনয় করেছেন যে গরম গরম ছবি দেখা শেষেই ব্যক্তিগতভাবে দারুণ বিনয়ী এই মানুষের সঙ্গে আমি নিজেই এগিয়ে যেয়ে হাত মিলিয়ে পরিচিত হবার সময়েও তার উপর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছিল, এবং কুশল বিনিময় যতসম্ভব দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত করে সটকে পড়েছিলাম... এবং বাসায় ফিরে সেটা মনে করে ও তার অভিনয়ের প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে বোকা হাসি হেসেছি।

এই চারজন ছাড়াও আরও বেশক'জন প্রয়োজনীয় পার্শ্ব অভিনয় শিল্পী ছিলেন, বিশেষ নজর করেছেন নাজিবা বাশের (টুশি, ময়নার ছোট বোন চরিত্রে), গল্পে তার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও যতটুকু তার, ততটুকুতে তিনি সুন্দর করে চরিত্রটিকে প্রাণ দিয়েছেন।

অন‍্যান‍্য শিল্পী কাউকেই খারাপ না লাগলেও তাদের ভেতর কেউ ঠিক আলোচনা করার মত স্পষ্ট হয়ে ধরা দেননি ছবিতে। হয়ত এর কারণ হতে পারে চরিত্রগুলোর প্রতি তেমন একটা মনযোগ দেয়নি ছবির চিত্রনাট‍্য। যে মনোযোগের অভাব দেখেছি কম প্রয়োজনীয় কিন্তু দৃশ‍্যভেদে উপস্থিত মানুষদের দৃশ‍্যায়নে, মানে সংলাপ থেকে পোশাক প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। কিছু দৃশ‍্যে মনে হয়েছে রাশান নূর গল্পটি যে ১৯৭৫ সালের তার খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। আবার মনে হয়েছে সেই সময়কালটা প্রমাণ করার জন‍্যে জোর করেই কিছু দৃশ‍্য আরোপ করা হয়েছে।

এখানে বলে রাখা ভালো, পিযুষ বন্ধোপাধ‍্যায় ('লে.জে. কে.এম. ইফতেখার, ময়নার বাবা চরিত্রে) অভিনয় বা কাজ নিয়ে কিছু লিখে খামোখা লেখাটা আরও বেশি লম্বা করছি না এবং উনাকে নিয়ে লেখার যোগ‍্যতা আমার আছে বলেও মনে করি না।

আমি বিশ্বাস করি উনাকে চোখ বেঁধে দেশের সবচেয়ে প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে, অতি নিম্নমানের কোন যাত্রার মঞ্চে স্যুট-কোট পরিয়ে বিবেকের চরিত্রে অভিনয় করতে উঠিয়ে দিলেও, তার কন্ঠে ‘‘ওরে ভোলা মওওওন...” ডায়লগ ছুঁড়ে দিয়ে দশর্কদের চোখ ধাঁধিয়ে তবেই তিনি মঞ্চ থেকে নামবেন!

তাঁর প্রতি তাই অভিযোগ নয়, একটু অভিমান করেই বলছি- ছবিটির সময়কালে তাঁর অভিনিত চরিত্রটির যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তার সঙ্গে চরিত্রটির কমর্কাণ্ডের মাঝে খুব বেশি গড়মিল রয়েছে, তার দৃশ্যের অভাব বোধ করেছি।

জানি এটা ‘সিনেমা’ তবু অন্ততঃ এই ক্ষেত্রে লজিকটা আমি মানতে রাজি না এবং চাইলেই সেটা একজন বৃহৎ-মাপের শিল্পী হিসাবে বন্ধোপাধ‍্যায় পরিচালককে ধরিয়ে দিতে পারতেন। কিংবা কে জানে, পরিচালক ধরতে পারেননি বলে হয়ত তিনি নিজেই অভিমান করে কিছু বলেননি!

যাইহোক, গল্পে এই চরিত্রটির, আমি বলবো, অসারতায় প্রচণ্ড রকম অস্বচ্ছন্দ্য বোধ করেছি! এমন একটি চরিত্রে পীযুষ বন্দোপাধ‍্যায়কে পেয়েও তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করার খুব ভালো একটি সুযোগ হাতছাড়া করলেন পরিচালক রাশান নূর!

আসলে, দৃশ‍্য আর চরিত্র ধরে ধরে বলতে গেলে এই দীর্ঘ লেখাটি শুধু দীর্ঘতরই হবে। চাইলে ছবিতে ভুল ধরার মতো আরও অনেক কিছুই আছে, আবার প্রশংসা করার মতো আরও অনেক বেশি কিছু আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ বেতারে আফজালের দুইটি অংশ দুর্দান্ত লেগেছে।

পাঠক, ছবিটি দেখার সময় আপনারা নিজেরাই বুঝবেন আমি কোনো দুটো দৃশ্যের কথা বলছি। সব মিলিয়ে দেখলে- এক কথায় ‘বেঙ্গলি বিউটি’ ছবিটি আমার ভালো লেগেছে বলেই এই লেখাটি দীর্ঘ হয়েছে।

ছবির শেষে ভালো-মন্দ না বলেই আমার সঙ্গী সুমন পাটোয়ারী জানতে চাইলেন- ‘এইটা নিয়ে লিখবি?’ আমি লিখবো জানালাম। মতামত শুধুমাত্র ভালো বা মন্দ নিয়ে লেখা যায়। ব্ল‍্যাক অর হোয়াইট। সাদা-কালোর মাঝে ধূসর মানে মাঝারি বিষয়ে লেখার কিছু নাই। তাই আমরা দুইজনই দুজনের কথার ইশারায় আমাদের দুজনেরই যে ‘বেঙ্গলি বিউটি’ ভালো লেগেছে তা বোঝা গেল। ছবি শেষে একইরকম মুগ্ধতা দেখেছি আমন্ত্রিত বাকি সবার চোখে-মুখেও।

যেহেতু শুরুতেই গালাগাল দেবো বলেই ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম তা স্বীকার করেছি, তাই দুটো গালাগাল দিয়েই লেখাটি শেষ করি।

এক, ছবির শেষটায় আরেকটু বেশি চমক আশা করেছিলাম, বিশেষ করে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে গল্পর মূল ইতিটি টানা হলেও দিনটির সঠিক তাৎপর্য দেখাতে বড় আকারে ব্যর্থ হয়েছেন পরিচালক।

দুই, মৌলিক গানগুলো কানে ভালো লাগেনি ও মনে ধরেনি, গানের সঙ্গে নাচগুলো দৃষ্টিকটু না হলেও গানের ক্ষেত্রে অভিনেতাদের লিপ-সিঙ্ক খুবই বাজে হয়েছে।

নাহ্ থাক, বরং একটু প্রশ‍ংসা দিয়েই শেষ করি। বেঙ্গলি বিউটির সঙ্গে দুটো জিনিসের তুলনা করবো।

এক. ছবিটি গ্রীষ্মের ভ‍্যাপসা গরম আর ধুলোবালি ও ট্রাফিক জ‍্যামের বিশ্রী ঢাকা শহরের মতো যা আমার প্রতিটি ভীনদেশি বন্ধুদের ভেতরে দেখেছি যে শুরুতে একটু কেমন অস্বস্তি লাগলেও কোনো এক জায়গায় শহরটির প্রতি তাদের মাঝে আজব একটা ভালোবাসা প্রথিত হয়ে যায়, তাদের ঢাকা ছাড়তে ইচ্ছা করে না! মন খারাপ করে। ফেইসবুকে নক করে ফজরের আজান শুনতে চায়! যেমন আমার ক্ষেত্রে কাঠমান্ডু শহর নিয়ে হয়েছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে- ইট ডিড নট স্টার্ট উইথ এ ব‍্যাং, বাট ইট স্লোলি গ্রু ইনটু মি!

দুই, বেঙ্গলি বিউটি ছোটবেলায় পড়া টিনটিন কমিক্সের মতো কিছুটা। ছোটবেলায় পড়ে যেমন মজা পেয়েছি, বড়বেলায় পড়েও তেমন মজা পেয়েছি! কারণ কমিক বা হাসি ঠাট্টায় টিনটিনের ভেতর এমন সব ঐতিহাসিক ঘটনার পটভূমি ও সংলাপের মাঝে এমন সব লুকানো রাজনৈতিক কমেন্ট্রি আছে যা বুঝে উঠতে পেরেছি বড় হওয়ার পর।

বেঙ্গলি বিউটির মাঝেও তেমন গল্পের ভেতর গল্প, সংলাপের ভেতর সংলাপ, দৃশ‍্যের ভেতর দৃশ‍্য, আর ‘চিরন্তন ভালোবাসার’ ভেতর নতুন গোপন ভালোবাসা লুকানো আছে-এমন গন্ধ আমি পেয়েছি।

তাই আমার এই লেখাটির শিরোনাম ‘বেঙ্গলি বিউটি কি টিকেট কেটে দেখার মতো ছবি?’-এর জবাব হলো একটিমাত্র শব্দ- "জি!”

এর সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর গ্লোবাল পাঠকদের জানিয়ে রাখি— বেঙ্গলি বিউটি ব্লকবাস্টারের পাশাপাশি ২৭ জুলাই ২০১৮ থেকে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স, শ‍্যামলী, বলাকাসহ ঢাকার বাইরের বেশকিছু হলে মুক্তি পাবে।

ছবিটি এরমধ‍্যে যুক্তরাষ্ট্রেও মুক্তি পেয়েছে এবং শিগগিরই মুক্তি পাবে আরও কিছু দেশে। ফেইসবুকের বেঙ্গলি বিউটি পেইজে লাইক/ফলো দিয়ে রাখলে দুনিয়ার সকল প্রান্ত থেকে নিয়মিত আপডেট পেয়ে যাবেন।

এবং পাঠকদের উদ্দেশে শেষ অনুরোধ – যত দ্রুত সম্ভব ছবিটি দেখে ফেলুন, কারণ খুব বেশি হলে খুব বেশিদিন এই ছবিটি চলবে না, এবং ‘হিট’ হবে না বলেই আমার ‘আশা’, তাই হলগুলো ছবিটি নামিয়ে ফেলবে।

আশাকরি চলচ্চিত্রপ্রেমী বন্ধু দশর্কগণ আমার এই বক্তব‍্যে আঘাত পাবেন না, কিন্তু আমিসহ আমাদের অধিকাংশের দেশি মাপকাঠিতে একটি ছবি ‘হিট’ হওয়ার জন‍্য তার ভেতর যা যা উপাদান আমরা চাই, তার বেশিরভাগই এই ছবিতে নেই।

তাই স্থান-কাল প্রেক্ষাপট বিচারে বেঙ্গলি বিউটি ছবিটি হিট না হলেই আমি ব্যক্তিগত বেশি খুশি হবো। আমি আরও চাই হলে হলে ব্যর্থ হোক বেঙ্গলি বিউটি, কিন্তু সে টিকে যাক বিশেষ কিছু মানুষের মনে, আমি/আমরাই বহু বছর পরও হয়তো কোনো ফোরামে বেঙ্গলি বিউটির রেফারেন্স দিয়ে কথা বলব, ঝগড়া করবো!

ছবিটির সঙ্গে জড়িত সবার প্রতি আমার সাধুবাদ, সালাম, ও গ্রীষ্মের তাপদাহের শুভেচ্ছা এবং আমার আপ্রাণ আশা ছবিটি যেন দেশের বাজারে কোনোমতেই হিট না হয়!