“এখন শাফিন ভাইকে বিদায় জানাচ্ছি, জুয়েলকেও বিদায় জানানো হবে; এরপর তারা তো মিশে যাবে…,” বলেন অবসকিউর ব্যান্ডের টিপু।
Published : 30 Jul 2024, 06:19 PM
বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের জনপ্রিয় তারকা শাফিন আহমেদকে শেষ বিদায় জানাতে যখন গুলশানের আজাদ মসজিদের জড়ো হচ্ছিলেন শিল্পী-অনুরাগীরা, ঠিক সেই মুহূর্তে তারা পেলেন নব্বইয়ের দশকের আরেক শিল্পীর প্রস্থানের খবর।
শাফিন আহমেদের বিদায়ের দিনে গায়ক হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের মৃত্যু শোক আর বেদনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে সঙ্গীতাঙ্গনে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই শিল্পীকে বিদায় জানাতে হচ্ছে, যাতে মর্মাহত সঙ্গীতজ্ঞরা।
ঢাকার গুলশানের আজাদ মসজিদে মঙ্গলবার দপুরের জানাজা হয় শাফিন আহমেদের। এদিন বেলা ১১টা ৫৩ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান জুয়েল। শাফিনকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে, জুয়েলকেও সেখানেই সমাহিত করা হবে।
শাফিনের জানাজায় যোগ দিতে আসার পথেই জুয়েলের মৃত্যুর খবর পান গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জুয়েল আমার বন্ধু, আর শাফিন আহমেদ তো বাংলাদেশের ব্যান্ড লিজেন্ড। শাফিনের সলো অ্যালবাম ‘পাগলা ঘণ্টি’র দশটি গানই ছিল আমার লেখা। ‘পলাশীর প্রান্তর’, ‘হ্যালো ঢাকা’সহ অনেক গান করেছি। এই মৃত্যু ভীষণ বেদনার।”
মাইলস ব্যান্ডের অন্যতম ভোকালিস্ট শাফিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে গত ২৫ জুলাই মারা যান। সেখানে তার প্রথম জানাজা সম্পন্ন করে সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকায় আসে তার মরদেহ। মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানের আজাদ মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা হয়। তাকে শেষ বিদায় জানাতে হাজির হন সহকর্মী ও স্বজনেরা।
‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের দলনেতা মাকসুদুল হক বলেন, “বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে তো শাফিনের যে কন্ট্রিবিউশন, তা অস্বীকার করা যাবে না। মাইলস ব্যান্ডকে অনেক দূর নিয়ে গেছে সে। তার যে কণ্ঠটা, একটু আলাদা।
“ক্লাসিক্যাল মিউজিকটা তো মা-বাবার কাছে শেখা। ক্লাসিক্যাল সুরের মিশেলে যে ব্যান্ডের অন্যরকম একটি আমেজ তৈরি করেছে, সেটি এই দেশের গানের ইতিহাসে মনে রাখতে হবে। শাফিনের মৃত্যুতে যে ক্ষতি হল, তা তো পূরণ হবার নয়। আরও কিছুটা বছর বাঁচতে পারত।”
আরও পড়ুন:
ঝরে গেল ব্যান্ড সংগীতের আরেক তারা, চলে গেলেন শাফিন আহমেদ
এই খবর আসবে, বুঝতে পারিনি: শাফিনের ছেলে রাকিন
মাকসুদ বলেন, “শুধু গায়ক নয়, ওর যে স্টাইল, গেটআপ, মেকআপ, সেটি তো আলাদা। এজন্য গায়কের বাইরে ওর ফ্যাশন সচেতনতাও অনেকে দৃষ্টি কেড়েছে। ওর মত অনেকে চুল রেখেছে, স্টাইল করার চেষ্টা করেছে। সব মিলিয়েই শাফিন একটা ‘প্যাকেজ’। অন্য অনেকের চেয়ে নানাভাবেই সে আলাদা।”
শাফিন আহমেদকে বিদায় দিতে এসে শিল্পী জুয়েলের মৃত্যু খবরে মর্মাহত হওয়ার কথা জানান তিনি।
ব্যান্ড সঙ্গীতের একটা প্রজন্ম পর পর চলে যাচ্ছে মন্তব্য করে অবসকিউর ব্যান্ডের দলপ্রধান সাঈদ হাসান টিপু বলেন, “আমি একসময় চাইম ব্যান্ডে ছিলাম। সেই চাইম ব্যান্ডের খালিদ ভাই কিছুদিন আগেই চলে গেলেন। এবার শাফিন ভাইও চলে গেলেন। আর এখানে আসার পথেই খবর পেলাম হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলও নেই। কী বলব! ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।”
টিকেট কেটে মাইলসের কনসার্ট দেখার স্মৃতি মনে করে টিপু বলেন, “তখনও আমি মিউজিকে আসিনি। মাইলস তখন ভীষণ জনপ্রিয়। টিকেট কেটে তাদের কনসার্ট দেখেছি। উনাদের দেখেই তো আমরাও ব্যান্ড করতে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
“এখন শাফিন ভাইকে বিদায় জানাচ্ছি, বিকেলে জুয়েলকেও বিদায় জানানো হবে। এরপর তারা তো মিশে যাবে। তাদের যে কন্ট্রিবিউশন, সেটি সংরক্ষণের উদ্যোগ রাষ্ট্রকে নিতে হবে।”
২০১১ সাল থেকে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন আবিদুর রেজা জুয়েল। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে জুয়েলের চিকিৎসা চলেছে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই শরীর খারাপ করছিল তার। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট গুরুতর হলে গত ২৩ জুলাই তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাচানো যায়নি।
নব্বইয়ে দেশে ব্যান্ড সংগীত নিয়ে যখন তুমুল উন্মাদনা শুরু হয়, জুয়েল সংগীত জগতে পা রাখেন ঠিক সেই সময়টায়। তার প্রথম অ্যালবাম ‘কুয়াশা প্রহর’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘এক বিকেলে (১৯৯৪)’, ‘আমার আছে অন্ধকার’ (১৯৯৫), ‘একটা মানুষ’ (১৯৯৬), ‘বেশি কিছু নয়’ (১৯৯৮), ‘বেদনা শুধুই বেদনা’ (১৯৯৯), ‘ফিরতি পথে’ (২০০৩), ‘দরজা খোলা বাড়ি’ (২০০৯) এবং ‘এমন কেন হলো’ (২০১৭)।
দুই শিল্পীর প্রয়াণে শোক জানিয়ে ‘দূরবীন’ ব্যান্ডের শিল্পী শহিদ বলেন, “শাফিন ভাই, জুয়েল ভাই আমাদেরকে নানাভাবেই অনুপ্রেরণা যুগিয়ে গেছেন। একে একে আমাদের তারাগুলো নিভে যাচ্ছে।”
২০০৬ সালে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘সংগীতা’ থেকে প্রকাশ পায় মাইলস ব্যান্ডের গানের অ্যালবাম ‘প্রতিধ্বনি’। এ অ্যালবামে ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’, ‘কেঁপে ওঠে মন’, ‘সাত দিনের তুমি’ ও ‘মন চায়’ শিরোনামে চারটি গান লিখেছেন রনিম রহমান।
শাফিন আহমেদকে বিদায় জানাতে এসে গীতিকার রনিম বলেন, “শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা তো ২৭/২৮ বছরের। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে। আমার লেখা অনেকগুলো গান তিনি করেছেন। এর মধ্যে ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ গানটা হিট করে। আজকে শাফিন ভাই বিদায় জানাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ, জয় শাহরিয়ার, কবির বকুল, শওকত আলী ইমন ও শাহরিয়ার শাকিলসহ অনেকেই এসেছিলেন শাফিন আহমেদকে বিদায় জানাতে।
বড় ভাই হামিন আহমেদসহ ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে পশ্চিমের সংগীতের সঙ্গে সখ্য হয় শাফিনের। শুরু হয় তার ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা। পরে ফরিদ রশিদের হাত ধরে ১৯৭৯ সালে তারা গড়ে তোলেন ব্যান্ড দল ‘মাইলস’। এরপর বিভিন্ন গান জনপ্রিয় হয়। তবে পরবর্তীতে মাইলস থেকে বেরিয়ে পরে ‘ভয়েস অব মাইলস’ গড়ে তুলেছিলেন শাফিন আহমেদ।
আরও পড়ুন-