রূপসজ্জাশিল্পীর মেয়ের বিয়ে অথবা প্রোডাকশন কর্মীদের পারিবারিক কোনো সংকট, সবখানেই উত্তম কুমার চুপচাপ তাদের পাশে দাঁড়াতেন বলে জানান মাধবী।
Published : 24 Jul 2024, 08:48 PM
কেবল অভিনয় গুণে নয়, বিপদে-আপদে, দুর্দশায় সাধারণের কাছে পৌঁছে যেতেন বলেই ভারতীয় বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেতা উত্তম কুমার হয়েছিলেন মহানায়ক।
উত্তমের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সহঅভিনেতাকে নিয়ে স্মৃতিচারণে এই মন্তব্য করেছেন কলকাতার বর্ষীয়ার অভিনেতা মাধবী মুখোপাধ্যায়। যিনি মহানায়কের সঙ্গে কাজ করেছেন ছয়টি সিনেমায়।
কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারকে মাধবী বলেছেন, অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, শিশির কুমার ভাদুড়িসহ ওই সময়ে আরো অনেকে যে যার জায়গায় বিখ্যাত হলেও, উত্তম কুমার যেভাবে কালজয়ী হয়েছেন, সেভাবে কেউ হননি।
এর কারণ কি জানতে চাইলে মাধবী বলেন, “সুপারস্টার হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কথাও উত্তমকুমার ভাবতেন। খরা বা বন্যার সময় দেখেছি, শিল্পীদের নিয়ে রাস্তায় নেমে ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। সেই টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অবলীলায় দান করেছেন। ১৯৭৮ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলার ত্রাণের জন্য ইডেন গার্ডেন্সে মুম্বাইয়ের শিল্পীদের সঙ্গে চ্যারিটি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। সেখানেও ছিলেন উত্তমকুমার। যে টাকা উঠেছিল, তা তিনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।”
এছাড়া রূপসজ্জাশিল্পীর মেয়ের বিয়ে অথবা প্রোডাকশন কর্মীদের পারিবারিক কোনো সংকট, সবখানেই উত্তম কুমার চুপচাপ তাদের পাশে দাঁড়াতেন বলে জানান মাধবী।
মাধবীর কথায়, “উত্তম কুমার ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। একজন উদার মনের মানুষ। সব সময় বলতেন, আগে আমাকে মানুষকে ভালবাসতে হবে। সারা জীবন তিনি এই আদর্শ মেনে চলেছেন। আমিও সেটা তার থেকেই শিখেছি। দুহাত ভরে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। ”
এই অভিনেত্রীর কথায় জানা গেল প্রোডাকশন সহকারীদের প্রযোজনায় একটা সিনেমা করে দিতে চেয়েছিলেন উত্তম কুমার। শুটিংয়েরও তারিখও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু শুটিংয়ের কয়েকদিন আগে মারা যান উত্তম।
মহানায়কের সঙ্গে প্রথম আলাপের স্মৃতি তুলে ধরে মাধবী বলেন, “তার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের স্মৃতি এখনও টাটকা। ‘থানা থেকে আসছি’ সিনেমার শুটিং তখন। যদিও ওই সিনেমায় তার সঙ্গে আমার কোনো দৃশ্য ছিল না। পরিচালক উত্তমবাবুর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে দেখেই উঠে দাড়িয়ে উত্তমবাবু বললেন, ‘ম্যাডাম বসুন।’ বসার পর তাকে বললাম, আমার নাম মাধবী, দয়া করে আমাকে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করবেন না। ওটা তো দেশীয় নয়। আমার কথা শুনে হেসে ফেললেন। বললেন, ‘ঠিক, আমি আপনাকে মাধবী বলেই ডাকব।’ সেই যে সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটল, তারপর মাধবী থেকে কবে যে তার কাছে ‘মাধু’ হয়ে গেলাম, তা বলা কঠিন।”
শুটিং ফ্লোরে সবার সঙ্গে সবার হৃদ্যতা তৈরিতে মুড়ি ও তেলেভাজা খাওয়ার নিয়ম করেছিলেন উত্তম কুমার। নায়কের তৈরি করা নিয়ম মেনে উত্তমের সিনেমার অভিনেতা, পরিচালক থেকে শুরু করে টেকনিশিয়ান সবাই পালা করে মুড়ি-তেলেভাজা খাওয়াতেন বলে জানান মাধবী।
“উনি মনে করতেন কোনও বিভেদ থাকবে না। ফ্লোরে ছোট থেকে বড়, প্রত্যেকে একসঙ্গে বসে ওই খাওয়া এবং আড্ডার মধ্যে দিয়ে একটা পারিবারিক অনুভূতি তৈরি হত। এটা কিন্তু উত্তমবাবু নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। কখনও আউটডোরে গেলে সুপ্রিয়াদেবী রান্না করতেন। আর আমরা তিন জন একসঙ্গে বসে খেতাম। সেই সব দিনের স্মৃতি আজও আমার মনে উজ্জ্বল।”
মহানায়কের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়ে মাধবী বলেন, “আমার বিয়েতে উত্তমবাবু শুরু থেকে ছিলেন। আমাকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি বরকর্তা হয়ে আসবেন। তবে দাবি ছিল, এসে লুচি খাবেন। আর সেই লুচি যেন সর্ষের তেলে ভাজা হয়। কথা রেখেছিলেন উত্তমবাবু। সুপ্রিয়াদেবীকে সঙ্গে নিয়ে আমার বিয়ে এবং বৌভাতে এসেছিলেন উত্তমবাবু।”
উত্তম কুমার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্যেও ‘অনেক কাজ’ করেছেন বলে জানান মাধবী।
“ একসময়ে ‘অভিনেতৃ সংঘ’ সভাপতি ছিলেন উত্তমবাবু। তার হাতেই তৈরি হয়েছিল ‘শিল্পী সংসদ’। ‘বনপলাশীর পদাবলী’ সিনেমাটি পরিচালনার পাশাপাশি তিনিও অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। সেও এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রির সেরা শিল্পীদের তিনি নির্বাচন করলেন। আমিও সুযোগ পেলাম। শুটিংয়ের পর দেখা গেল সিনেমার দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ৪ ঘণ্টা। সবাই বললেন ২ ঘণ্টা বাদ দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু, তিনি রাজি হলেন না। তার দাবি ছিল, সকলে তার প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছেন, তাকেও তা ফিরিয়ে দিতে হবে। দৃশ্য কাটা যাবে না। শেষ পর্যন্ত মনে হয়, প্রায় ৩ ঘণ্টার সিনেমা তৈরি হল। ছবি সুপারহিট হল। প্রচুর ব্যবসা করে সেই সিনেমা।”
মাধবীর আক্ষেপ মৃত্যুর পর এই অভিনেতারে মরদেহ শহরের রবীন্দ্রসদনে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। যা তার জন্য ‘অসম্মানের’ বলে মনে করেন মাধবী।