"চলচ্চিত্রের এখন দুর্ভিক্ষ চলছে, একটা রাষ্ট্রের খাদ্যের দুর্ভিক্ষ হয়। আর আমাদের দেশে সিনেমার দুর্ভিক্ষ চলছে। আপদকালীন সময় চলছে,” বলেন আরেক হল মালিক।
Published : 08 Jun 2024, 11:11 PM
"চলচ্চিত্র ব্যবসা আর নেই, সিনেমা হল চালু রাখার জন্য সারা বছরে পাঁচ থেকে ছয়টি ব্যবসা সফল সিনেমাও পাচ্ছি না। আমার সিনেমা হলের বয়স আজকে ৯৬ বছর। আর চার বছর পরে ১০০ বছর পূর্তি হবে। ১০০ বছর পূর্তি হলে সিনেমা ব্যবসা বন্ধ করে দেব।“
শনিবার ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) নিজের সিনেমা হল ও চলচ্চিত্র ব্যবসার করুণ অবস্থা তুলে ধরার সময় এভাবেই হতাশা তুলে ধরেন ঢাকার লায়ন সিনেমা হলের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেক।
ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ”সিনেমা হল চালাব কী দিয়ে? ঈদে ১১টা সিনেমা মুক্তি পায়, চলার মতো সিনেমা একটি। খুব খারাপ অবস্থায় আছি।"
প্রদর্শক সমিতির এজিএমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৬০ এর উপরে হল মালিকরা অংশ নেন। এছাড়া প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন ডিপজল, অভিনেত্রী অঞ্জনা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দেশের পুরানো সিনেমা হলগুলোর একটি পুরান ঢাকার ইসলামপুরের লায়ন সিনেমা হল। দর্শক খরায় এটি বন্ধ হয়েছিল ২০০৫ সালে; পরে সেখানে শপিংমল নির্মাণ করা হয়েছে।
ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটারের মালিকানা গত শতকের কুড়ির দশকে মির্জা আবদুল সর্দারের হাতে আসে। পরে নতুন করে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের পর সেটি ‘লায়ন সিনেমা’ নামে পরিচিতি পায়। উত্তরাধিকার সূত্রে হলের মালিকানার দায়িত্বে আসেন মির্জা খালেক।
প্রথম দিকে নাটকের পাশাপাশি সিনেমা দেখানো হলেও ১৯২৭ সাল থেকে শুধুই সিনেমা প্রদর্শন করে লায়ন সিনেমা হল। ঢাকাই সিনেমা সোনালী সময়ে রমরমা ছিল সিনেমা হলটি; পুরানা ঢাকার বাসিন্দারা পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে হলে ভিড় করতেন।
পরে দর্শক খরায় তা বন্ধের ১৭ বছর পর পুরান ঢাকার দর্শকদের স্মৃতিবিজড়িত হলটি ফেরানো হয়। ইসলামপুর থেকে তা বুড়িগঙ্গা সেতু-২ (বাবু বাজার ব্রিজ) সংলগ্ন কেরানীগঞ্জের কদমতলী মডেল টাউনে আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স হিসেবে ২০২২ সালে চালু করা হয়। বলা হচ্ছে, এটিই পুরান ঢাকার প্রথম মাল্টিপ্লেক্স প্রেক্ষাগৃহ।
এজিএমে হল মালিকরা কী বললেন
প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জলের সঞ্চালনায় সভায় তিন বছর আগে সিনেমা হলের সংস্কার ও নতুন হল নির্মাণে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি আলোচনা আসে। নানান জটিলতায় এটির অগ্রগতি না থাকার অভিযোগ করা হয়।
এছাড়া সভায় হল মালিকরা চলচ্চিত্রের ১৯ সংগঠনের পক্ষ থেকে ভারতীয় সিনেমা আমদানিতে বাধা দেওয়া এবং সিনেমা প্রদর্শন করতে অগ্রিম ‘রেন্টাল ফি’ দেওয়ার বিরোধিতা করেন।
সভায় প্রদর্শক সমিতির ওয়েবসাইট উন্মোচন করা হয়।
চলচ্চিত্র ব্যবসায় খরা চলার কথা তুলে ধরে লায়ন সিনেমার আব্দুল খালেক বলেন, "হলের ব্যবসায় লাভ নাই। ভারতীয় সিনেমা আমাদের লাগবে, সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বছরে আটটা সিনেমা আনার। কিন্তু ১৯ সংগঠন তা আটকে দেয়। এটা কেন?
”খুব খারাপ অবস্থায় আছি, হল ঠিক করতে লোন নিতে হচ্ছে। যারাই এই লোন নিয়ে সিনেমা হল নির্মাণ করবে, হল সংস্কারের কথা ভাবছে, এমন সিনেমা নির্মাণ হলে আর এই অবস্থা চললে লোন নিয়ে তারা আরও বিপদে পড়বে।"
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে নিজস্ব অর্থায়নে স্বল্প সুদে হল মালিকদের তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল রয়েছে।
এজিএমে এ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম থেমে যাওয়া ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন হল মালিকরা।
বগুড়ার মধুবন সিনেমা হলের মালিক রোকনুজ্জামান ইউনূস রুবেল বলেন, "সরকার থেকে আমাদের লোন দেওয়ার কথা ছিল, এটা নিয়ে আমরা আমাদের ফাইল রেডি করেছি, টাকাও জমা দিয়েছি। কিন্তু ব্যাংকগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ ঋণ দিতে নেতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন, তারা যা শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন সেটা করতেও আমাদের অনেক খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু ঋণ পাব কি না সেটা নিশ্চিত কেউ করতে পারছে না।"
ভালো সিনেমা চালাতে হলে অতিরিক্ত ‘অগ্রিম রেন্টাল’ দিয়ে সিনেমা নেওয়ার পদ্ধতি বাতিলের দাবি তোলেন যশোর মণিহার সিনেমা হলের জিয়াউল হক মিঠু।
তিনি বলেন, "দেশীয় চলচ্চিত্রের মান অত্যন্ত নিম্নমুখী হওয়ায় সবাই ব্যবসায়িক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সিনেমা হল খোলা রেখে সবাই লোকসান গুনছেন। এর মধ্যে ভালো সিনেমাগুলো নিতে হলে অতিরিক্ত অগ্রিম রেন্টাল দিয়ে সিনেমা নিতে হয়।
”এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সকলের এক হয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিত। ভারতীয় সিনেমাগুলো আমদানি নিয়েও অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। এমন অবস্থা তৈরি করা হলে সিনেমা হল ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।"
নিউ গুলশান সিনেমা হলের মালিক আমীর হামজা বলেন," চলচ্চিত্রের এখন দুর্ভিক্ষ চলছে, একটা রাষ্ট্রের খাদ্যের দুর্ভিক্ষ হয়। আর আমাদের দেশে সিনেমার দুর্ভিক্ষ চলছে। আপদকালীন সময় চলছে। এই দুর্ভিক্ষে চলচ্চিত্র শেষ হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে চলে এসেছে। তাই হল বাঁচাতে হবে।
এ সংকট কীভাবে কাটবে সেই পরামর্শও তুলে ধরেন তিনি। এজন্য এক বছরের জন্য শর্তহীনভাবে সিনেমা উন্মুক্ত করে দেওয়া, ভ্যাট কমানো, ঋণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরামর্শ তার।
প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জল বলেন,"বাংলাদেশের সিনেমা হলের মালিকদের দায়বদ্ধতায় থাকতে হয়, সিনেমা আমদানি করা হলে আগের দিন পর্যন্ত সবাই সংশয়ে থাকে সিনেমা চলবে না কি চলবে না। ১৯ সংগঠন থেকে বাধা আসে। শুক্রবার সিনেমা মুক্তি পাবে বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় জানতে পারি সিনেমা আগামীকাল মুক্তি পাবে।
”এমন হলে দর্শক জানবে কীভাবে, হল চলবে কীভাবে। এসব অবস্থা থেকে বের হতে হবে। সিনেমা যেটা আসবে এক সপ্তাহ আগে থেকে আমাদের জানাতে হবে।"
তিনি চলচ্চিত্র শিল্পীকে বাঁচাতে সবার সহযোগিতা চান।
আরও পড়ুন: