দেশে এক মাসে ৪৫ কোটি সার্জিকাল মাস্ক ব্যবহার: জরিপ

মহামারী ঠেকাতে প্রায় গোটা বিশ্বজুড়ে লকডাউনে বায়ু দূষণ কমলেও করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা সরঞ্জাম থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়ে তা আবার পরিবেশ দূষণের কারণ হচ্ছে বলে বাংলাদেশের এক জরিপে উঠে এসেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2020, 02:20 PM
Updated : 10 May 2020, 02:20 PM

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এই জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত এক মাসে একবার ব্যবহৃত দ্রব্য থেকে ১৪ হাজার ১৬৫ টন ক্ষতিকর প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। এই বর্জ্যের ৩ হাজার ৭৬ টন উৎপন্ন হয়েছে শুধু ঢাকা শহরে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশে লকডাউন শুরু হয়, সম্প্রতি কিছুটা শিথিল হলেও তা এখনও চলছে।

এই সময়ে নিত্যপণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব দোকান-পাট, গণপরিবহন ছিল বন্ধ; নির্দেশনা ছিল, মানুষকে ঘরে থাকতে হবে।

কিন্তু এই সময়ে ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় বাসাবাড়ি ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকে তৈরি সার্জিকাল ফেইস মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বেড়েছে, তা প্লাস্টিক বর্জ্যের বড় উৎস।

রোববার এক ভার্চুয়াল আলোচনায় এসডো’র জ্যেষ্ঠ প্রকল্প কর্মকর্তা সৈয়দা মেহরাবিন সেঁজুতি তাদের জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, এপ্রিল মাসে একবার ব্যবহৃত যে প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে, তার ১২ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে সার্জিকাল ফেইস মাস্ক থেকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি সার্জিকাল ফেইস মাস্ক ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে অন্তত ১ হাজার ৫৯২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। অন্য শহরের তুলনায় ঢাকা শহরেই এর পরিমাণ বেশি।

এছাড়া মোট বর্জ্যের ২৪ দশমিক ২ শতাংশ পলিথিনের তৈরি সাধারণ হ্যান্ড গ্লাভস থেকে, ২২ দশমিক ৬ শতাংশ সার্জিকাল হ্যান্ড গ্লাভস থেকে এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ খাদ্যদ্রব্য বহনে ব্যবহৃত পলিথিনের ব্যাগ থেকে হয়েছে বলে এসডোর জরিপের তথ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গড়ে ৯ শতাংশ মানুষ সার্জিকাল হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহার করেন, যাদের অধিকাংশই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের মতো শহরে বাস করেন। অন্যান্য জেলাতে পলিথিনের পাতলা হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহারের প্রবণতা বেশি।

ফেলে দেওয়া ১২১ কোটি ৬০ লাখ পলিথিনের হ্যান্ড গ্লাভস থেকে এক মাসে প্রায় তিন হাজার ৩৯ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। এর প্রায় ২০ শতাংশ শুধু ঢাকাতেই উৎপন্ন হয়েছে।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে খাদ্যদ্রব্য ঢেকে কেনা-বেচা করা ও ত্রাণ বিতরণের কারণে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে।

সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে পলিথিনের ব্যাগ থেকেই। এক মাসে ১৪৪ কোটি ৯০ লাখ পলিথিনের ব্যাগ থেকে উৎপন্ন হয়েছে ৫ হাজার ৭৯৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই তৈরি হয়েছে প্রায় ৪৪৩ টন।

মাস্কের সঙ্গে বেড়েছে গ্লাভসেরও ব্যবহার

জরিপে বলা হয়েছে, চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মীরা নিয়মিতই একবার ব্যবহারযোগ্য মাস্ক, গ্লাভসসহ পিপিই ব্যবহার করায় হাসপাতালগুলোতেও প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়েছে। এথেকে এক মাসে ২৫৮ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে।

এছাড়া কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষাগারগুলো থেকে আরও ১ দশমিক ৪ টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে।

একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত ৫৭০ জন সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সেবা প্রদানকারী, এনজিওকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনলাইন ও টেলিফোন সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই জরিপটি চালায় এসডো।

তবে অন্য সময়ের তুলনায় বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে কি না, তা তারা স্পষ্ট করেনি।

এবছরের শুরুতে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখানো হয়েছিল, গত বছর বাংলাদেশের শহরগুলোতে সৃষ্টি হওয়া সর্বমোট প্লাস্টিকের বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন।

সেই হিসাবে প্রতি মাসে শহরগুলোতে ৬৬ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। তবে তার মধ্যে একবার ব্যবহৃত ও বহুবার ব্যবহৃত দুটোই রয়েছে। এসডোর জরিপ শুধু একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিজ বর্জ্য নিয়ে। 

এসডোর জরিপ প্রতিবেদনে প্লাস্টিক বর্জ্য যথাযথ নিষ্কাশন না করলে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

বর্জ্য সংগ্রহে নিয়োজিত কর্মীরা যথোপযুক্ত নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই কাজ করায় তারা রোগ সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে তাদের মাস্ক, গ্লাভসসহ সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের সুপারিশ করেছে এসডো।

এসডো’র চিফ টেকনিকাল অ্যাডভাইজর অধ্যাপক আবু জাফর বলেন, “যেসব বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলোর বিষাক্তগুলোকে আলাদা করে রাখা হচ্ছে না। বর্জ্য যারা সংগ্রহ করছে, তাদের কীভাবে আমরা সচেতন করব? তাদের আমরা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি।

“এই মহামারীর সময়ের বর্জ্যগুলোকে আমরা সাধারণ বর্জ্য থেকে আলাদা করে রাখতে পারি কি না? যেখানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রয়েছে, সেখানে ব্যাগ দিয়ে দিতে পারি আমরা। এবং তাদের জানিয়ে দিতে পারি, এগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে যদি হালকাভাবে নিই, তাহলে মহামারী দূর করা যাবে না।”

আলোচনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, “ঢাকার ৯০ শতাংশ হাসপাতাল থেকে প্রিজম বর্জ্য সংগ্রহ করে। তারা আমাকে জানিয়েছে, ঢাকাতেই প্রতিদিন ৫৬ টন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। যার মধ্যে ক্ষতিকর ১০ টন।

“স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এই মহামারীর সময় ক্ষতিকর বর্জ্যগুলো পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সাথে সংগ্রহ করতে হবে। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।”

দূষণ এড়াতে ত্রাণ সামগ্রী পাট বা কাপড়ের ব্যাগে বিতরণ করতেও পরামর্শ দেন তিনি।

এসডোর সাধারণ সম্পাদক ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “বাসাবাড়ির বর্জ্য অন্য বর্জ্যের সাথে যেন না মিশে, সেজন্য আলাদাভাবে বর্জ্য সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষতিকর বর্জ্যগুলো সিল কনটেইনারে সংরক্ষণ করতে হবে।”

সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই যারা বর্জ্য সংগ্রহ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাদের করোনাভাইরাস পরীক্ষার সুপারিশ করেন তিনি।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের মানুষকে নিয়ে ‘ওয়ানস্টপ’ নীতিমালা প্রণয়নের পক্ষে মত দেন বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির মহাসচিব ও বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর হুমায়ন কবির বুলবুল।