দুইবার এভারেস্ট চূড়ায় পা রাখা মুহিতের শঙ্কা জাগে, দূষণ আর দখলে নদী মরে গেলে একটি প্রজন্মের শৈশব আর কৈশোরও যে হারিয়ে যাবে। মানুষের জীবন তাতে বাঁচবে?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় কৈশোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ নিয়ে, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে নিজের ভাবনার কথা জানালেন এই পর্বতারোহী।
তিনি বললেন, নদীকে বাঁচাতে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে শুধু সচেতন হলে চলবে না, পৃথিবীর অন্য দেশের মত আইন মানতে ‘বাধ্য’ করতে হবে।
“চাঁদপুরের পরে মেঘনা নেমে গেছে, ভোলার দুই পাশ দিয়ে গেছে। আসলে মেঘনার প্রবাহটা দুই পাশ দিয়ে গেছে। ভোলা তো একটা দ্বীপ। পূর্বদিকটা মেঘনা নামেই বঙ্গপোসাগরে গেছে। আর পশ্চিম দিকে যেটা, যার অপর দিকে গেলে পটুয়াখালী… পশ্চিম দিকে তেঁতুলিয়া নদী।”
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর ছুটি আর শীতের সময়টা গ্রামে কাটাতে পরিবারসহ নদীপথে ভোলায় যাওয়া হত। রাতের লঞ্চে অন্ধকার বারান্দা থেকে তাকে কেবিনে নেওয়া যেত না। উপভোগ করতেন প্রতিটা মুহূর্ত।
“নদীতে রাতের বেলা মানুষ হারিকেন জ্বালিয়ে মাছ ধরে। শীতের সময় যখন নদীতে চর পড়ে, বাঁশ নামিয়ে পানি মাপে। এক বাম, দুই বাম; বাম মেলে না। মানে যখন বাঁশটা ঠাঁই পায় না। এই কথাগুলো শুনতে ভালো লাগত।”
মুহিতের ভাষায়, ছেলেবেলায় তিনি ছিলেন ‘প্রচণ্ড ডানপিটে’। তেঁতুলিয়া নদীর জোয়ার-ভাটার মধ্যেই তার সাঁতার শেখা। সাঁতার কাটা, নৌকা বাওয়া, ডিগবাজি খেয়ে পানিতে পড়ার সেই দিনগুলো ছিল শুধুই আনন্দের।
শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় মুহিতের কেটেছে তেঁতুলিয়া পাড়েই। তেঁতুলিয়ার পাশাপাশি জাঙ্গালিয়া নদীকেও মনে পড়ে তার।
“বিকেল বেলা কিছু করার নাই, নদীর পাড়ে চলে গেছি। পাল তোলা নৌকা চলছে দেখতাম। বিশাল বিশাল নৌকা। গুন টানছে। এসব আমাকে আকর্ষণ করত।... ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে খুঁজে পাওয়া যেত না, আমি এদিকে নদীর ধারে বসে মুগ্ধ হয়ে সূর্যাস্ত দেখছি।”
নটরডেম কলেজ আর ঢাকা সিটি কলেজে লেখাপড়া করা মুহিত পাহাড়ের নেশায় পড়েছিলেন ১৯৯৭ সালে বান্দরবানে গিয়ে। দশ বছর পর সেই মুহিতকে দেখা যায় হিমালয়ের চুলু ওয়েস্ট, মেরা আর বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম শৃঙ্গ মানাসলুতে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন তো নদীর মাঝখানে চর। অনেক ন্যারো হয়ে গেছে। সেই আগের রূপ আর নাই। আগে তো এপার-ওপার কিছু দেখা যেত না।”
নদীর এমন বদলে যাওয়ার সাথে সাথে নদীনির্ভর জীবন ও জীবিকাতেও পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন মুহিত।
“আমাদের ওখানে বেদে নৌকা আসতো। সে সময় বিদ্যুৎ ছিল না। মাটির রাস্তা। বাবুর হাট নামে একটা হাট ছিল। খালের পাড়ে এক সাথে অনেকগুলো নৌকা জড়ো হত বেদেদের। গ্রামে গ্রামে ওরা শিঙ্গা দিত। … এখন তো বেদেদের পেশাও বদলে গেছে।”
দূষণ আর মানুষের আচরণই নদীর দৃশ্যপটকে এভাবে বদলে দিচ্ছে বলে হতাশা ঝরে মুহিতের কণ্ঠে।
“সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল- আগে নদীতে এমন ভট ভট আওয়াজ ছিল না, যেটা এখন পাই। সব ইঞ্জিন হয়ে গেছে। আগে তো নিঃশব্দে বসে থাকতাম। এখন তো নদী পাড়ে গেলেই ভট ভট ভট ভট শব্দ।
“আগে মাছ ধরতো জাল দিয়ে। এখন কারেন্ট জালে সব ছেঁচে নিয়ে যাচ্ছে। একেবারে কিছুই বাদ যাচ্ছে না। কত রকম জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ... একটার সাথে আরেকটা জড়িত, একটা সার্কেল। পুরো ইকোসিসটেম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
পুরান ঢাকায় থাকেন বলে তেতুঁলিয়ার মত বুড়িগঙ্গা নদীকেও মুহিত কাছ থেকে দেখেছেন ছোটবেলা থেকে। মানুষের দূষণ সেই বুড়িগঙ্গাকেও বিষাক্ত করে তুলেছে।
“আশির দশকে বুড়িগঙ্গায় গোসল করেছি গরমের দিনে। আর এখন এপ্রিল-মে মাসে, যখন সবচেয়ে গরম হয়, দূর থেকেও বুড়িগঙ্গার পানির দুর্গন্ধ পাওয়া যায়।
“আমার যেহেতু নদীপথে যাতায়াত এত বছর ধরে; আমি দেখেছি বুড়িগঙ্গার পানি ফতুল্লা পোস্তগোলা, পাগলায় শীতের সময় কালো দেখাতো। আস্তে আস্তে সেটা দেখলাম মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরীতে। এখন এটা চাঁদপুর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে।”
মুহিতের ভাষায়, এসব শুধু পরিবর্তন নয়, পুরো জাতির জন্য বিপর্যয়।
বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া জয়ের আগে দেশের শীর্ষ চূড়াগুলোতে পা রেখেছেন মুহিত। শৈশবে সমতলের নদীরূপ চেনা হলেও পাহাড়ি নদীর সৌন্দর্য্য তার প্রথম দেখা হয় ১৯৯৭ সালে।
স্কুলে থাকতে গঙ্গোত্রী হিমবাহের কথা পড়েছিলেন মুহিত। হিমবাহ, অর্থাৎ বরফের নদী কেমন- তা দেখার সুযোগ হয় ২০০৪ সালে।
“আমি ওই বছর প্রথম হিমালয়ে যাই। তখন সারাক্ষণ আমাদের সাথে একটা নদী ছিল, দুধকোশি। নেপালে বড় নদীকে বলে কোশি, আর ছোটনদীকে বলে খোলা। দুধকোশি, সুনকোশি, তামাকোশি, বটকোশি এমন কয়েকটা নদী। দুধকোশি নদীটার উৎপত্তি খুম্বু গ্লেসিয়ার থেকে।
“জীবনে প্রথম যে গ্লেসিয়ার দেখি সেটা খুম্বু গ্লেসিয়ার। আমরা এখানে নদীতে গোসল করি, সাঁতার কাটি। আর ওখানে নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়।”
বরফ আচ্ছাদিত পর্বতে নদীর রূপে মুগ্ধ মুহিত বলেন, “ওখানে নদী প্রচণ্ড খরস্রোতা। সাদা ফেনা। ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য্য। উপর থেকে পানি পড়ছে নিচে। সারাক্ষণ আমরা শব্দ শুনছি; মনে হয় যেন সারাক্ষণ ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।
সিকিমে কয়েকটি হিমবাহকে তিস্তায় গিয়ে মিশতে দেখেছেন মুহিত। মানস সরোবরে না গেলেও কাছেই তিব্বতের অংশে ব্রহ্মপুত্রের শুরু দেখেছেন।
গত অক্টোবরের শেষে নেপাল-তিব্বত সীমান্তের হিমলুং অভিযানের অভিজ্ঞতা জানিয়ে মুহিত বলেন, “হিমলুং গ্লেসিয়ারে বরফের উপর পাথর জমা… আঁকাবাঁকা এই গ্লেসিয়ার আমরা এক ঘণ্টায় পার হই।”
উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর পর হিমালয়ের বুকেই জমা রয়েছে সবচেয়ে বেশি বরফ। কিন্তু গত ১৫ বছরে ২৬টি পর্বত অভিযানে গিয়ে পর্বতেও প্রকৃতির পরিবর্তন দেখেছেন এম এ মুহিত।
মুহিত বলেন, হিমালয়ের হিমবাহগুলোর কাছে কোনো কারখানা নেই। কিন্তু সমতলের কারখানাই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। পাহাড়ে গলছে হিমবাহ। ততে নদীর চরিত্রও বদলে যাচ্ছে। পাখিকে যেমন সীমানায় বাঁধা যায় না, তেমনি নদীও সীমানাহীন। তাই ‘সীমান্ত রাজনীতি’ দিয়ে নদীকে বাঁচানো যাবে না।
নদী ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে ভুটানের কথা বলেন মুহিত।
“ভুটান জিরো কার্বন নিঃসরণের দেশ, ওরা অর্গানিক খাবার খায়। ওরা পারলে, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে, আমরা কেন পারব না?”
যথেচ্ছ প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেন, “আগের জালে গোল মাটির চাকা ব্যবহার করতো। এখন প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে।”
দেশের পার্বত্য জেলাগুলোর পাহাড়ি বাসিন্দারা এক সময় প্রাকৃতিক সামগ্রী দিয়েই জীবন চালাতেন। এখন তাদের জীবনযাপনেও প্লাস্টিক ‘ঢুকে যাচ্ছে’ বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুহিত।
“আমরা সবাই মনে হয় মনে করি পানিতে সব কিছু ফেলা যায়। কিন্তু পানিতে সবকিছু ফেলা যায় না। অনেক বড় বড় শিক্ষিত লোক লঞ্চে যাচ্ছে… প্লাস্টিক পানিতে ফেলবে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। ডাস্টবিন রাখতে হবে লঞ্চগুলোতে।”
তিনি বলেন, “আমাদের মধ্যে যেনতেনভাবে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। পরিবেশকে নষ্ট করে কি আমি ভালো থাকব? প্রকৃতির স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে মানুষ ভালো থাকতে পারে?”