ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের মধ্যে এই যন্ত্রে ভোট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে ভোটারদের কাছ থেকে।
Published : 28 Jan 2020, 05:45 PM
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে ভোটের তিন দিন আগে মঙ্গলবার বিভিন্ন কেন্দ্রে ইভিএমের প্রদর্শনীতে এসে ভোটদান সহজ হওয়ার কথা অনেকে বললেও কারও কাছে তা ঠেকেছে জটিল।
১ ফেব্রুয়ারির ঢাকার দুই সিটির ভোট সামনে রেখে এদিন দুই সিটির অনেক কেন্দ্রে ইভিএম প্রদর্শনীর আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নির্বাচনে সম্পূর্ণ ভোটগ্রহণ করা হবে ইভিএমে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩০ লাখ ৯ হাজার এবং দক্ষিণ সিটিতে ২৪ লাখ ৫২ হাজার ভোটার রয়েছেন।
ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৩১৮টি ভোটকেন্দ্রে ৭৮৫০ ভোটকক্ষের বিপরীতে দক্ষিণ সিটিতে ১১৫০ ভোটকেন্দ্রে ভোটকক্ষের সংখ্যা ৬৫৮৯টি।
মঙ্গলবার দুই সিটির প্রায় ২০টি ভোটকেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে, ভোটারের তুলনায় প্রদর্শনীতে নগরবাসীর উপস্থিতি অনেক কম। তাদের কেউ কেউ জানালেন, যন্ত্রে ভোটিং প্রক্রিয়া বুঝতে ’কষ্ট হচ্ছে’। আবার কেউ বলছেন, অনেক সহজ পদ্ধতি।
হাতেকলমে একবার ভোট দিয়ে তিনি বলেন, “আসলে ভালো কইরা বুঝি নাই। ভোট দিতে আসব। বুঝতাছি না, দিতে পারব কি না।”
দক্ষিণ মুগদাপাড়ার ওয়াপদা গলির বাসিন্দা ব্যবসায়ী এ কে আজাদ অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ইভিএম ভোটিং দেখে নিজে চেষ্টা করলেন। কিন্তু এ কেন্দ্রের ভোটার নন বলে তিনি ভোট দিতে পারেননি।
এই ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যা দেখলাম, তাতে জটিল মনে হয়েছে। কেউ কেউ হয়ত একদিনে, একবার চেষ্টা করেই বুঝতে পারবে। আমি বুঝি নাই।
“আমি তো তাও একটু শিক্ষিত, যারা অশিক্ষিত তারা তো আরও বুঝব না। এভাবে তো অর্ধেক ভোটও নিতে পারব না।”
তবে সিকিউরিটি গার্ড মোহাম্মদ খোকন মিয়ার প্রতিক্রিয়া আবার একেবারেই বিপরীত। তার কাছে ইভিএম ভোট সহজ মনে হয়েছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একবারেই আমি বুঝতে পারছি। সহজই মনে হইছে।”
ভোট দিতে সময় কতক্ষণ লেগেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বেশিক্ষণ না। এক মিনিট তো লাগবোই।”
তবে তার ভাষ্য “আশা করি ভোটাররা সহজভাবেই ভোট দিতে পারবে। যদি কোনো ভোটার আটকে যান বা কোনো অসুবিধা হয় তবে তো পোলিং অফিসাররা আছেনই। অসুবিধা হবে না।
‘আপনি ঠিকমত বুঝেছেন, ভোট দিতে পারবেন’- এ প্রশ্নে আব্দুল মতিনের দ্বিধাগ্রস্ত জবাব, “মনে হয় পারবো। এখনও ক্লিয়ার না।”
দক্ষিণ মুগদাপাড়ার ওই কেন্দ্রে সকাল ১০টা থেকে ভোটারদের অনুশীলন ভোট শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয় ১২টা থেকে।
সকাল সাড়ে ১০টায় এই ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, ভোটিং মেশিন স্থাপন করতেই পোলিং কর্মকর্তাদের গলদঘর্ম অবস্থা। ঘণ্টা দুই চেষ্টার পর দুটি ইভিএম তারা স্থাপন করেন।
এর মধ্যে অনেক ভোটারকে এসে ফিরে যেতে দেখা গেছে। অনেকেই কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। তবে অনেককেই ইভিএম নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে দেখা গেছে। আবার অনেককেই বলতে শোনা গেছে ‘হেরা তো নিজেরাই ঠিকমত বোঝে না’।
দক্ষিণ মুগদাপাড়ার কাজী জাফর আহমেদ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোটের দিন দুটি (১১৯ ও ১২০) ইভিএম ভোটকেন্দ্র বসবে।
অনুশীলনে ভোটারদের সাড়া সম্পর্কে পোলিং কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলেন, “আসছে অনেকেই। তবে বেশিরভাগই আসছে অন্য ভোটকেন্দ্রের ভোটার। ফলে তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে।”
আরেক পোলিং কর্মকর্তা ববিতা রানী ভৌমিক বলেন, “প্রত্যেক ভোটারের তিনটা করে ভোট। ভোটার সচেতন হলে ৩০ সেকেন্ডেই একজন ভোট দিতে পারবেন। বিষয়টা কিন্তু খুবই সহজ। আশা করি ভোটাররা সহজেই ভোট দিতে পারবেন। আর আটকে গেলে আমরা তো আছিই।”
এ কেন্দ্রে ইভিএম প্রদর্শনীতে আসা ভোটার মো. কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইভিএমে ভোট এই প্রথম দিয়েছি। মেশিনে ভোট দেওয়া সহজ মনে হচ্ছে। এখানে পেপারের কোনো বিষয় নেই, ভাজ করতে হবে না। ভোট নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে না।”
এই ভোট কেন্দ্রটিতে দুই হাজার ৩৬৮ জন ভোটার রয়েছেন বলে জানান সেখানে ইভিএম প্রদর্শনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম।
এ প্রদর্শনী দেখতে ভোটারদের আগ্রহ কম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, “আজ অফিস ডে। অধিকাংশ মানুষ যার যার কাজে ব্যস্ত। এছাড়া আজকের ইভিএম প্রদর্শনী নিয়ে প্রচার-প্রচারণাটা বোধ হয় তেমনভাবে করা হয়নি। যে কারণে উপস্থিত কম। ৩০ জানুয়ারি মক ভোট নেওয়া হবে, সেদিন ভোটার হয়তো কেন্দ্রে কেন্দ্রে এসে দেখে যাবেন।”
এই কেন্দ্রের পাশেই আইডিয়াল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র। এ কেন্দ্র দুপুর ২টা পযন্ত ৪৮ জন ভোটার প্রদর্শনীতে এসে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি দেখেছেন বলে জানান সেখানে দায়িত্ব পালন করা ফারহান আহমেদ।
তিন হাজার ৩৩৯ জন ভোটারের থাকলেও প্রদর্শনীতে উপস্থিতি কম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ফারহান বলেন, “আমরা মূলত আইটির লোকজন, আমরা দেখছি মেশিন যথাযথভাবে কাজ করছে কি না? তাছাড়া এই ডেমো ভোট নেওয়ার বিষয়ে প্রচারটা তেমনভাবে করা হয়নি। সব ভোটাররাও জানে না।”
এ কেন্দ্রে ডেমো ভোট দিয়ে মো. রুবেল নামে এক ভোটার ইভিএম সম্পর্কে বলেন, “আমার কাছে তো সহজই মনে হলো। আঙ্গুলে চাপ দেওয়ার সাথে সাথে আমার ছবি বের হয়েছে, তারপর বাটন চেপে চেপে ভোট দিয়ে দিলাম। মেশিনের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যেই ভোট দেওয়া যায়।”
মিরপুরের কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরেও ভোটারের উপস্থিতি কম দেখা গেছে। কিছু কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রের পোলিং কর্মকর্তারা ইভিএম নিয়ে ভোটারদের অপেক্ষায় থাকলেও ভোটার উপস্থিতি সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি।
মিরপুর ১২ নম্বরের রশীদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ইভিএম প্রদর্শনী তে এসেছেন হাতে গুণে কয়েকজন।
কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটদান সম্পর্কে জানতে আসা তাঁত ব্যবসায়ী রিয়াজ আলম ইভিএম মেশিনে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি জানতে পেরে বেশ সন্তুষ্ট।
তিনি বলেন, “নতুন বিষয়, একটু উদ্বেগ ছিল কিভাবে ভোট দিব। সে কারণে জানতে এসেছি। কিন্তু এখন দেখে তো মনে হল খুব সহজ। সবাই একবার দেখলেই দিতে পারবে।”
নরসুন্দর সাগীর আলম তার কাজের ফাঁকে ইভিএম সম্পর্কে জানতে এসেছেন। খুব কম সময়ে ইভিএমে ভোট দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, “দেখে মনে হল, কাগজের ভোটের চেয়ে এটা ভাল। সময় কম লাগছে। এই রুম সেই রুমে একেক কাগজ নিয়ে দৌড়তে হবে না। আবার কাগজ ভাজ করার ঝামেলাও নাই। একবার দেখেই তো শিখে ফেলছি।”
মিরপুরের নন লোকাল স্কুলের ইভিএম প্রদর্শনীতে অংশ নিতে মাইকে জানানো হয় ওই এলাকার ভোটারদের। তারপরও সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ১৫জন ভোটার এসেছিলেন ইভিএম প্রদর্শনীতে।
এ কেন্দ্রে আসা জিনাত রহমান পোলিং অফিসারে কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় জেনে নিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, “ইভিএম সম্পর্কে তো কিছুই জানতাম না। গতকাল ফোনে মেসেজ আসল যে, আজকে প্রদর্শনী হবে। তাই দেখতে চলে আসলাম। ভোট দেওয়া শিখে গিয়েছি। আজ বেশ সহযোগিতা করেছে সবাই। ভোটের দিন এমন পরিবেশ পেলেই হয়।”
আরেক ভোটার এনায়েত হোসেন বলেন, “ইভিএমে ভোট দেয়াটা খুব সহজ। কিন্তু যদি তিনটা ভোট (মেয়র, কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কাউন্সিলর) না দিই, তাহলে তো ভোট হবে না। অনেকে তো এটা জানবে না, তখন তো তাদের ভোট দেওয়াই হবে না।”
রশীদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও কেন্দ্রের পোলিং অফিসার শরীফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সবাই জানতে চাচ্ছে কিভাবে ভোট দিবে। অনেকেই ইভিএমকে জটিল মনে করে জানতে আসছে। কিন্তু দেখার পর সবাই সন্তুষ্ট। তাদের কাছে একদম সহজ মনে হচ্ছে। আর প্রক্রিয়াটি একশভাগ স্বচ্ছ।"
এদিকে, দুপুর ২টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে সেখানে ইভিএম প্রদর্শনী চললেও কোনো ভোটারের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।
সেখানকার সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মো. ফারুক উজজামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এই কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ২৩১৩ জন। তবে আজকের ইভিএম প্রদর্শনীতে ভোটাররা তেমন আসেনি। সকাল থেকে ২-৩ জন ভোটার এসেছিল। ইভিএমে তারা কিভাবে ভোট দিবে সেই সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে গেছেন।’’
ভোটদান প্রক্রিয়া নগরবাসীর সামনে তুলে ধরতে ৩০ জানুয়ারি দুই সিটির সব কেন্দ্রেই মক ভোটিং বা অনুশীলন ভোট অনুষ্ঠিত হবে বলে ইতোমধ্যে জানিয়ে নির্বাচন কমিশন।