মণ্ডপে হামলা: ৫ ঘণ্টা পর চট্টগ্রামে প্রতিমা বিসর্জন

বিজয়া দশমীর দিন চট্টগ্রামের জেএম সেন হলের পূজা মণ্ডপে হামলার প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত সময়ের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর পুলিশের পাহারায় পতেঙ্গার পরিবর্তে ব্রিজঘাট এলাকায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2021, 06:03 PM
Updated : 15 Oct 2021, 06:04 PM

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি মিছিল থেকে ঐতিহাসিক জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে হামলা হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ তখন সেখানে অবস্থান নিয়ে ঘোষণা দেয়, নিরাপত্তা না পাওয়া পর্যন্ত তারা প্রতিমা বিসর্জন দেবেন না। এরপর পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের আশ্বাসে রাত ৮টার দিকে দূর্গা প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হয়।

এদিকে দুপুরে পূজা উদযাপন পরিষদের ঘোষণার পর নগরীর বেশিরভাগ মণ্ডপই প্রতিমা নিরঞ্জন স্থগিত রাখে। সন্ধ্যার পর স্থানীয়ভাবে পুকুর এবং দিঘীতে কিছু প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার খবর পাওয়া যায়।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীতে প্রতিবছর বন্দর নগরীর পতেঙ্গা সৈকতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।

মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশাসনের আশ্বাসের ভিত্তিতে আমরা ব্রিজঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জন করতে এসেছি। কোতোয়ালি জোনের বেশিরভাগ প্রতিমা এখানেই বিসর্জনের জন্য আনা হচ্ছে।

“যারা পতেঙ্গা যাচ্ছে, তারা সেখানে বিসর্জন দেবে। রাত হওয়ায় যারা পতেঙ্গা যেতে পারছেন না, তাদের ব্রিজঘাটে আসতে বলেছি। আর কেউ বাকি থাকলে আগামীকাল তারা প্রতিমা নিরঞ্জন করবে।”

এর আগে দুপুরে মণ্ডপে হামলার পর আশীষ ভট্টাচার্য্য বেলা আড়াইটার দিকে বলেছিলেন, “সরকার আগে নিরাপত্তার কথা বলুক, তারপর আমরা প্রতিমা বিসর্জনে যাব। তার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরের কোনো মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে না।”

এরপর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন উজ্জ্বল এবং নগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মো. তানভীরসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা জে এম সেন হলের কাছে অখণ্ড মণ্ডলী মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ কার্যালয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন।

হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জড়ো হওয়া তরুণরা কাছাকাছি তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থান নিয়ে থাকেন। সন্ধ্যা ৭টার পর জেএম সেন হল থেকে বিসর্জনের জন্য প্রতিমা বের করার সময়ও তাদের সেখানে দেখা যায়। 

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামনে নয় বরং পেছনের পথ দিয়ে জেএম সেন হলের প্রতিমা বিসর্জন দিতে নিয়ে গেছে। কারণ তখনও মূল সড়কে ছেলেরা অবরোধ করে ছিল। তিন স্তরের পুলিশ প্রহরা দিয়ে প্রতিমা নেওয়া হয়েছে।”

হামলার প্রতিবাদে দুপুরে ওই অবস্থানস্থল থেকে শনিবার চট্টগ্রামে আধাবেলা হরতালের ডাক দিয়েছিলেন প্রবীণ এই আইনজীবী।

রাতে প্রতিমা বিসর্জনের পর হরতালের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “হরতালের কর্মসূচি থাকছে। ১২টার পর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন থেকে দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে।”

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, সকল পূজার্থী এবং হিন্দুদের পক্ষ থেকে এই হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।

যেভাবে হামলা

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরে জুমার নামাজ শেষে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ গেইটে একদল লোক ‘কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ’ জানিয়ে সমাবেশ করে। সেখান থেকে তারা মিছিল নিয়ে জেএম সেন হলের দিকে এগিয়ে যায়।

মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের বেস্টনি দেওয়া থাকলেও তারা সেটা ভেঙে এগিয়ে যেতে থাকে। জেএম সেন হলের গেইট ভেঙে তারা ভেতরে ঢোকারও চেষ্টা করে।

এ সময় ভেতরে ঢিল ছোড়া হয় এবং পূজার জন্য সড়কে এবং আশপাশের দেয়ালে টাঙ্গানো বিভিন্ন ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়। পরে টিয়ার শেল ছুড়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ।

ঘটনাস্থলে থাকা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রত্মাকর দাশ টুনু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই মিছিল শুরু হয় বেলা ২টার দিকে। মিছিলের প্রথম অংশ চলে যাওয়ার পর মাঝখান থেকে ৫০ জন জেএম সেন হলের দিকে ধেয়ে আসে।

“তখনই হলের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরা পাশের অখণ্ড মণ্ডলীর ভেতরে অবস্থান নিই কয়েকজন। হঠাৎ মিছিলের ওই লোকজন এত বেশি ইট মারছিল যে বের হতে পারছিলাম না। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দা মসজিদ ফেরত মুসল্লিরাও আমাদের সাথে যোগ দিয়ে হামলাকারীদের ধাওয়া দেয়।” 

টুনু বলেন, “হামলাকারীদের বেশিরভাগের পরনে ছিল লুঙ্গি, জিন্স ও কেডস। মুখে মাস্কও ছিল না। একজনকে আমি ধরে ফেলি। হলের ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা ছেলেদের নিয়ে তিনটি গেটই বন্ধ করে দেয়। পুরো মিছিল যদি হামলা করত তাহলে কিছুই রক্ষা পেত না।”

সে সময় জেএম সেন হলের ভেতরে প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতিতে দুর্গা প্রতিমায় তেল-সিঁদুর দিচ্ছিলেন নারীরা। হট্টগোলের মধ্যে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ কাঁদতেও শুরু করেন।

জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন সাংবাদিকদের বলেন,“হামলাকারীরা ছিল বহিরাগত। প্রশাসনের ভূমিকা শক্ত হলে এই হামলা হতে পারত না। সারাদেশে গত কয়দিনের ঘটনার পর প্রশাসনের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়।”

৭০ জন আটক

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, হামলার পর আশেপাশে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৭০ জনকে আটক করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশের প্রস্তুতি ছিল। হামলাকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে গিয়ে হামলা চালিয়েছে। আমরা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করেছি।”

নামাজের পর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ এলাকায় মিছিল করার কোনো অনুমতি ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, “তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার কারণে বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারেনি।”

সিএমপি কমিশনার সালেহ মো. তানভীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনার সময় কার কী ভূমিকা ছিল সেগুলো নিরপেক্ষভাবে দেখা হবে। আমরা ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছি কার কী ভূমিকা ছিল সেটাও খতিয়ে দেখতে, প্রয়োজনে তদন্ত কমিটিও করা হবে।”

কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন জানান, জেএম সেন হলে হামলার ঘটনায় দুটি মামলার প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করবে, অপর করবে চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ।

বিক্ষুব্ধ তরুণরা

হামলার সময় জেএম সেন হলে বিসর্জনের প্রস্তুতি নিতে থাকা তরুণরা তাৎক্ষণিকভাবে হলের কাছাকাছি সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়।

এর আধ ঘণ্টা পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। এরপর সেখানে আসেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং ঐক্য পরিষদ নেতা রানা দাশগুপ্ত।

বেলা সাড়ে ৩টার দিকে রানা দাশগুপ্ত হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা দেন। তিনিও প্রতিমা বিসর্জন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় বিক্ষোভকারী তরুণরা।

বেলা ৪টার দিকে নগর পুলিশের কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর উপস্থিত হন। তার উপস্থিতিতে আ জ ম নাছির ও পূজা কমিটির নেতারা বৈঠকে বসেন।

বৈঠকের পর আ জ ম নাছির বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বলেন, “আপনাদের বেদনা আমরাও অনুভব করছি। এখানে প্রশাসনের সবাই উপস্থিত। প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে খবর নিয়েছেন। চট্টগ্রামের সব মন্ত্রীরা খবর নিয়েছেন।

“জড়িতরা কেউ ছাড় পাবে না। কেউ আশ্রয় প্রশ্রয় দিলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপনারা বিসর্জন দিন। আমরা সাথে আছি।”

দুর্গা পূজার মধ্যে কুমিল্লার একটি মন্দিরে কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে বুধবার কয়েকটি মন্দিরে হামলা, ভাংচুর চালানো হয়। এর পর দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দিরে ও পূজা মণ্ডপে হামলা হয়। তা ঠেকাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও বাঁধে, যাতে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে প্রাণহানিও ঘটে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, কুমিল্লার ঘটনার পেছনে কোনো ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র’ আছে বলেই তারা মনে করছেন।

আর ‘ধর্মকে ব্যবহার করে যারা সহিংসতা’ সৃষ্টি করছে, তাদেরকে অবশ্যই খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আরও পড়ুন: