পড়াশোনা ছেড়ে নার্সারিতে কাজ, ৩ নার্সারির মালিক হয়ে বাপন এখন ‘অনুপ্রেরণা’

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি বিদেশ থেকে গাছের চারা আমদানি করে সরবরাহ করেন তিনি।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2023, 05:16 PM
Updated : 28 April 2023, 05:16 PM

পরিবারের আর্থিক অনটনে লেখাপড়াটা বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেননি; জীবিকার তাড়নায় কাজ নিতে হয়েছিল নার্সারিতে। সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করে উদ্যেক্তা বনে যাওয়া বাপন দে এখন তিনটি নার্সারির মালিক; দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন অন্যদের কাছেও।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীরে সারোয়াতলী ইউনিয়নের ছনদণ্ডী গ্রামের বাসিন্দা বাপন। দারিদ্র্যের কষাঘাতে বড় হওয়া ৩৮ বছর বয়সী এই ব্যক্তি এখন পুরোদমে উদ্যোক্তা। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় বাপনের গাছেদের কদরও বেড়েছে অনেক।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি এখন বিদেশ থেকেও গাছের চারা আমদানি করেন বাপন। সেগুলো সরবরাহ করেন দেশের নানা প্রান্তে।

দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে বড় হওয়া বাপন ছোট বেলায় বাবা হারানোর পর মা ও বোনের মুড়ি বিক্রি করে সংসার চালানোর কষ্টও দেখেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হলেও মাধ্যমিকে থেকে যেতে হয়েছে; দুবেলা আহার জোগাড়ই যার জন্য কষ্টসাধ্য ছিল, সেখানে পড়ালেখার স্বপ্ন তো বিলাসিতাই!

পড়ালেখাটা এগিয়ে না নিতে পারলেও বাপনের বড় হওয়ার ইচ্ছেটে ভাটা পড়েনি; আর এর পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল সৎ পথে বড় হওয়ার তাগিদ।

‘পরিশ্রম করলে ফল মিলবেই’- এমন বিশ্বাসে এগিয়ে চলা বাপন আগে যেমন অন্যের নার্সারিতে কাজ করেছেন, এবার তার অধীনে কয়েকজন কর্মচারী কাজ করছেন।

কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখা বাপন আড়ালে থাকতেই পছন্দ করেন। নিজের সংগ্রামের কথা জানাতে তেমন উৎসাহও দেখান না। বাপনের একটেই কথা, ‘কাজ করলে মানুষ কিছু না কিছু পাবেই। পরিশ্রম মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়’।

নানা আলাপের পর একটা সময় রাজি হন- তার শূন্য থেকে সফলতা লাভের এই যাত্রার আদ্যপান্ত তুলে ধরতে।

বাপন জানান, তার বাবা ছিলেন দিনমজুর। যে টাকা আয় করতেন, তা দিয়ে নুন আনতে পানতা ফুরোনোর অবস্থা ছিল। তিন বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বাবাকে হারান।

এরপর মা ও বোনের মুড়ি বিক্রির টাকায় তাদের সংসার চালাতে হত। নিজেও ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রম করেছেন। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে বহু কষ্টে মাধ্যমিকে পৌঁছলেন। তারপর আর পড়ালেখা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু মনের মধ্যে লালন করেছিলেন এগিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

২০০০ সালের দিকে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর পড়ালেখার পাট চুকিয়ে উপজেলার কধুরখীল এলাকার একটি নার্সারিতে কাজ নেন। সেখানে আট বছর কাজ করেন বাপন।

এরপর কাজ ছেড়ে বাড়ির কাছে জোট পুকুর মাঠের এক প্রান্তে ছয় শতক জায়গা ভাড়া নিয়ে শুরু করেন নিজের প্রথম নার্সারির কাজ। বিভিন্ন রকম ফুলের চারা বিক্রি করতে শুরু করেন বাপন।

সেখানে সফল হয়ে অদূরেই পুকুরসহ ৪৮ শতক জায়গা ভাড়া নিয়ে কয়েক বছরেই নার্সারির ব্যাপ্তি বাড়াতে থাকাতে থাকেন।

বর্তমানে তিনটি জায়গায় ১৭৬ শতকের নার্সারি পরিচালনা করছেন বাপন। নিজের মায়ের নামে নার্সারির নাম দিয়েছেন ‘গীতা নার্সারি’।

বর্তমানে তার নার্সারিতে প্রায় ৭০ ধরনের ফুলের চারা, ৪০ প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফল ও বিভিন্ন জাতের ২০ ধরনের আমের চারা রয়েছে; চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয় এসব গাছের চারা।

বাপন বলেন, “আমি ছোট বেলা থেকেই পরিশ্রম করতে অভ্যস্ত। এখনও দৈনিক ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা পরিশ্রম করি। আমার সঙ্গে থাকা কর্মীরা যে পরিমাণ পরিশ্রম করে, তাদের চেয়ে বেশি করি আমি।”

আমি মনে করি জীবনে এগিয়ে যেতে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নাই, বলেন তিনি।

বাপন আরও জানান, বিভিন্ন স্থান থেকে বীজ সংগ্রহ করে নার্সারিতেই চারা তৈরি করেন তারা। সেগুলো বিক্রি করা হয় বিভিন্নজনের কাছে। তবে বেশির ভাগই বিক্রি করেন অন্য কোনো নার্সারিতে।

চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, রংপুর, যশোর ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও ফুল-ফলের চারা সংগ্রহ করেন বাপন।

প্রতিবছর কয়েক লাখ বিভিন্ন ফুল, ফল ও সবজির চারা বিক্রি হয় তার নার্সারি থেকে। সেখান থেকে যে আয় আসে তার অংক প্রকাশ না করলেও তা দিয়ে যে ভালো চলে যাচ্ছে তাই জানালেন মাধ্যমিক পার করতে না পারা এই উদ্যোক্তা।

এখন স্থানীয়দের কাছেও বাপন এক অনুপ্রেরণার নাম। একদম শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে ১২ বছরের মাথায় স্বাবলম্বী হয়ে অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন, এ কারণে এখন পুরো উপজেলায়ই দৃষ্টান্ত এই বাপন দে।