'৫০ পূর্ণ করে' টেন্ডুলকার বললেন, ‘আক্ষেপ নেই কোনো’

জীবনের ইনিংসে ৫০ পূর্ণ করে শচিন টেন্ডুলকার কথা বললেন তার ক্রিকেট, জীবন ও পরিবারের অনেক কিছু নিয়ে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2023, 08:42 AM
Updated : 24 April 2023, 08:42 AM

২২ গজে ব্যাট হাতে শচিন টেন্ডুলকারের চেয়ে বেশি পঞ্চাশ ছুঁতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে কেউ। সেই তিনি এবার জীবনের ইনিংসে স্পর্শ করলেন পঞ্চাশ। বিস্ময় বালক হিসেবে ১৬ বছর বয়সে অভিষেকের পর গৌরবময় পথচলায় ক্রিকেট মাঠে অসংখ্য রেকর্ড ও কীর্তির জন্ম দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি পেয়েছেন ইশ্বরের মর্যাদা। ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে ভারতের স্পোর্টস্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কিংবদন্তি কথা বলেন তার ক্রিকেট, জীবন, পরিবার, দর্শন ও আরও অনেক কিছু নিয়ে। 

সুদীর্ঘ সেই সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরা হলো এখানে। 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচিন টেন্ডুলকারের উত্থানের সঙ্গে দেশ হিসেবে গোটা বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তির বদল একই সমান্তরালে হওয়া…. 

শচিন টেন্ডুলকার: কাকতালীয়ভাবে, সময়টাই ছিল অমন। ওই সময়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন আসছিল। সবকিছু ভিন্ন দেখাচ্ছিল। মাঠের ভেতরে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি, তা ছিল ১৯৯৬ বিশ্বকাপে। সেই থেকে ভারতীয় ক্রিকেটে সবকিছু নাটকীয়ভাবে বদলাতে শুরু করল। 

জাতি হিসেবেও আমরা বদলে যাচ্ছিলাম। চারপাশে এত কিছু চলছিল! এমনকি আমার জন্যও সবকিছু বদলে যাচ্ছিল। স্পন্সরশিপ ও আরও অনেক কিছু ছিল… আমি সম্ভবত প্রথম (ভারতীয়) ক্রিকেটার, চুক্তি স্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে যে ক্রীড়াবিদের ব্যবস্থাপনা দেখভাল করছিলেন একজন এজেন্ট। এর আগ পর্যন্ত এজেন্টের ধারণাই ছিল না ভারতে। 

কয়েকটি জায়গা থেকে তখন এমন বলাবলি হচ্ছিল যে, আমার মনোযোগ এখন অর্থের দিকে বা এমন অনেক কিছু। কিন্তু আদতে ব্যাপারটি ছিল উল্টো। টেবিলে বসে চুক্তি নিয়ে দরকষাকষি করতে চাচ্ছিলাম না আমি, কারণ এটা তো আমার কাজ নয়। এই কাজে শক্তি ও সময় খরচ করতে চাচ্ছিলাম না। স্কোরবোর্ডের ডান দিকে সংখ্যাটি ও দলের জয় থেকেই কেবল রাতে শান্তির ঘুম দিতে পারতাম। 

রানের সংখ্যার চেয়ে ব্যাংক ব্যালান্স কখনোই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আমার পরিবারের সদস্যরা সবসময় জানতে চাইতেন, আমি কত রান করেছি। কতগুলি চুক্তি স্বাক্ষর করেছি, তা নয়। আমি তাই শুধু খেলাতেই মনোযোগ দিতে চেয়েছি। 

আশি-নব্বয়ের দশকের সমার্থক হয়ে থাকা মধ্যবিত্ত মানসিকতা বা হীনম্মন্যতার প্রভাব নিজের ক্যারিয়ারে পড়তে না দেওয়া… 

টেন্ডুলকার: আমার মনে হয়, বাবার স্থিরতা ও মায়ের দৃঢ়তা থেকেই এটা পেয়েছি আমি। সবসময়ই বিশ্বাস করেছি, বিনয়কে কখনও দুর্বলতা হিসেবে দেখা উচিৎ নয়। আমি যদি ভালো, বিনয়ী ও ভদ্র হই, এটার মানে এই নয় যে আমি আত্মবিশ্বাসী নই। নিজের বেড়ে ওঠার শিক্ষাকেই স্রেফ ফুটিয়ে তুলছি আমি। 

আমি নিজেকে বলতাম, মাঠে আমি প্রতিনিধিত্ব করছি দেশকে, মাঠের বাইরে আমার পরিবারকে। এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগ্রাসন দেখানোর প্রয়োজন হলে ঠিকই দেখিয়েছি। মাঠে আমার আগ্রাসী মনোভাব ও মাঠের বাইরে ধীরস্থির মনোভাব নিয়ে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, ‘মাঠে যা দেখি, সেভাবেই সাড়া দেই আমি। মাঠের বাইরে সাড়া দেই যা ঘটছে, সেটির।” 

প্রতিক্রিয়া দেখানো ও জবাব দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রতিক্রিয়া আসত সহজাতভাবেই, মাঠে আমি জানতাম যে প্রতিপক্ষ বোলার ও তাদের গোটা দলের বিপক্ষেই লড়াইয়ে জিততে হবে। এর বাইরে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটি ছিল পুরো ভিন্ন। এটা পরিবার থেকেই এসেছে। বেশির ভাগ সময়ই আমি ভাবতাম, এই সময়ে আমার বাবা কীভাবে সাড়া দেবেন। সেভাবেই কাজ করার চেষ্টা করতাম। 

‘ভারতরত্ন’ খেতাব পাওয়া বা বৈশ্বিক মহাতারকার আড়ালে কখনোই ছোট্ট সেই শচিনকে হারাতে না দেওয়া… 

টেন্ডুলকার: পুরস্কার-স্বীকৃতি এসবে প্রতিফলন পড়েছে আমার মাঠের পারফরম্যান্সের। কিন্তু এটি আমাকে বাজে ব্যবহার করার বা যা ইচ্ছা করার অধিকার দিয়ে দেয়নি। কারণ দিনশেষে আমাকে পরিবারে ফিরতে হবে এবং সবার মুখোমুখি হতে হবে। আমার বাবা-মা, আমার দুই ভাই ও বোন আমাকে যেভাবে গড়ে তুলেছেন, সেটির প্রতিফলন পড়েছে এখানে। আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়, স্ত্রী অঞ্জলি, তার বাবা-মা, আমার সন্তানরা ও আমার পিসি-মাসী, সবাই বড় ভূমিকা রেখেছেন। 

আমরা কখনোই আমার কোনো অর্জনকে উদযাপন করিনি। সবাই খুব খুশি হয়েছে, প্রেরণা জুগিয়েছে, যা করতে চেয়েছি, পাশে থকেছে। তবে কখনোই বড় উদযাপন বা পার্টি হয়নি। আমরা স্রেফ বলেছি, ‘ভালো একটি মুহূর্ত, স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা’, মিষ্টিমুখ করেছি, এরপর সামনে এগিয়েছি। বাড়িতে সবসময়ই একটি মন্ত্র আমরা অনুসরণ করেছি, ‘গোটা বিশ্ব গত ম্যাচটি নিয়ে কথা বলুক, আমরা ভাবব পরের ম্যাচ নিয়ে।’ স্কুল জীবন থেকেই এটা ছিল মন্ত্র। 

বেড়ে ওঠার শিক্ষাই আমাকে মাটিতে পা রাখতে সহায়তা করেছে। বাড়ির মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় আমার কাছে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যেত। মাঠে কী হয়েছে, সেটির মূল্য আর নেই তখন। 

মাঠের ক্রিকেটে যে দিকটি মিস করেন…. 

টেন্ডুলকার: দেশের হয়ে খেলার সময়ের গর্ব, মাঠের ভেতরে চ্যালেঞ্জগুলো, টিম মিটিং, ড্রেসিং রুমের বন্ধুত্ব এবং অন্য সবকিছু সহজাতভাবেই হয়। তবে কিছুই স্থায়ী নয়। দলে থাকার সময় এসব হয়ই। সম্প্রতি আমরা গোটা দুই রোড সেফটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট (সাবেকদের আসর) খেলেছি। আবার মাঠে ফেরা ও খেলতে পারা ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। 

এর বাইরে, আমার বিদায়টা (আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে) ছিল দারুণ। আমার সবসময়ই মনে হতো, শেষ ম্যাচের অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে। শেষ পর্যন্ত সেই দিনটিতে (বিদায়ের দিন) যা হয়েছে, আমার কাছে তা স্পেশালেরও বেশি কিছু। এই কারণেই মূলত কোনোকিছু আমি মিস করি না। কারণ সক্রিয় ক্রিকেটার হিসেবে মাঠ ছাড়ার শেষ দিনটির স্মৃতি আমাকে রোমাঞ্চিত করে। 

যখন ওদের (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) ৮ উইকেট পড়ে গেল, ৯ উইকেট পড়ে গেল, আমি আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে বলছিলাম, ‘মাঠে আমার শেষ কয়েকটি মূহূর্ত এসব… আক্ষরিক অর্থেই গুণতে শুরু করছিলাম আমি.. এরপর আর কিছুই আগের মতো থাকবে না। আর সক্রিয় ক্রিকেটার থাকব না আমি, সবসময়ই অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচনা করা হবে আমাকে।’ এই মুহূর্তটা এতটা স্পেশাল ছিল যে, আমার কোনো আক্ষেপ নেই। 

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আবির্ভাব আরও আগে হলে টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের পরের ভাগ অন্যরকম হতো কি না… 

টেন্ডুলকার: সত্যি বলতে, আমি জানি না। উত্তর দেওয়া কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় না তেমন কিছু হতো। কারণ একটা সময় ছিল, অনেকে বুঝতেই পারত না টি-টোয়েন্টি কী জিনিস এবং না বুঝেই এটাকে বলত তরুণদের খেলা। এমন অনেক বিশেষজ্ঞ ছিল, যারা নিজেরা একটি বলও জীবনে খেলেনি, কিন্তু তাদের গলা ছিল ক্রিকেট খেলা অনেকের চেয়েও উঁচু। 

আমি উপলব্ধি করেছিলাম, এটা এতটা আরোপিত নয়। বরং আমি বলব, টি-টোয়েন্টিই সবচেয়ে সহজ সংস্করণ। ওয়ানডেতে পুরো একটি দিন কাটাতে হয়, শারীরিকভাবে এটিই তাই সবচেয়ে কঠিন সংস্করণ। টি-টোয়েন্টি এতটা কঠিন নয়। টেস্ট ক্রিকেটে যখন প্রচণ্ড গরমে একজন ফাস্ট বোলারকে লম্বা স্পেল করতে হয়, কিংবা একজন ব্যাটারকে তেতে থাকা সূর্যের নিচে সারাদিন ব্যাট করতে হয়, তখন তা কঠিন হয়ে ওঠে।

এইরকম পরিস্থিতিতে শারীরিকভাবে অনেক সময় নুইয়ে পড়তে হয়। নিজের হাইড্রেশনের খেয়াল না রাখলে বা পুরো ফিট না হলে, প্রথমেই যা হয়, তা হলো মনোযোগ ও ফোকাস নড়ে যায়। এখানেই পরিপূর্ণ ফিটনেসের ব্যাপারটি আসে। 

ক্যারিয়ারের কোনো সময় বা ঘটনা অন্যরকম হতে পারত বলে ভাবেন… 

টেন্ডুলকার: হ্যাঁ, ২০০৭ বিশ্বকাপ। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই সময়টা ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য খুব ভালো ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগটুকুও, ভারতীয় ক্রিকেটে যা ছিল অন্ধকার এক সময়। এই দুটি (বদল চাইতাম) অবশ্যই….। 

নব্বইয়ের দশকের শেষ সময়টায় তো মিলে যাচ্ছে… 

টেন্ডুলকার: আমার অধিনায়কত্বের সময়ও! 

আপনার নেতৃত্বের নাজুক রেকর্ডে অন্য বিতর্কগুলোকে উপেক্ষা করা হয় কি না… 

টেন্ডুলকার: কোনো সংশয় নেই! আমার তা মনে হয়। তবে আমি আঙুল তুলতে চাই না। আমার মনে হয়, অনেকেই এটা নিয়ে কথা বলতে চায় না, অনেকে না জানার ভান করে। 

ছেলে অর্জুন টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা… 

টেন্ডুলকার: আমার বাবা-মা কিংবা ভাইরা কখনও আমাকে চাপ দেননি। নিজে যা করতে চেয়েছি, তা করার স্বাধীনতা আমি পেয়েছি। সারা (মেয়ে) ও অর্জুনের ক্ষেত্রে আমিও তেমনটিই করি। ওদেরকে কখনোই চাপ দেওয়া হয় না। তবে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার কথা বলা হয়। যেটাই তারা করবে, জীবনে যা হতে চাইবে, দ্বিতীয় হয়ে যেন ওরা সন্তুষ্ট না হয়। 

আমি ওদেরকে বিচার করি ওদের প্রচেষ্টা দিয়ে, ফলাফল দিয়ে নয়। নিজেকে যখন সামনে এগিয়ে নিতে হয়, তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, ‘এটিই কি সবচেয়ে সেরা, যা আমি করতে পারতাম?’ আমার মতে, এটিই জয়ী মানসিকতা। এরপর ফলাফলের কোনো নিশ্চয়তা নেই। চেষ্টা করাই কেবল নিজের হাতে আছে। সেদিন থেকে নিজের সবটুকু দিতে পারলে, আমি তাতেই খুশি। 

পঞ্চাশে পৌঁছে এমন কিছু আছে কি না, যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু করা হয়নি… 

টেন্ডুলকার: সত্যি বলতে, না। আমার প্রথম ইনিংস ২৪ বছর টিকেছে (খেলোয়াড়ী জীবন), দ্বিতীয় ইনিংসে স্রেফ ১০ বছর পার করলাম। আগে যেমনটি বলেছি, দ্বিতীয় ইনিংসে আরও অনেক কিছু অর্জন করতে চাই।