চমকে-রোমাঞ্চে ভরা বিশ্বকাপ

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এবারের আসরে একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়েছে শক্তিতে পিছিয়ে থাকা দলগুলো। 

মো: হাসিবুল করিমমো: হাসিবুল করিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2022, 02:12 PM
Updated : 7 Nov 2022, 02:12 PM

সেমি-ফাইনাল ও ফাইনাল এখনও বাকি, তবে অনেকের চোখেই অস্ট্রেলিয়া আসর হয়ে গেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেরা। এর মূল কারণ জমজমাট সব ম্যাচ। শক্তিতে পিছিয়ে থাকা দলগুলোর দারুণ সব সাফল্য। টুর্নামেন্টের বাঁকে বাঁকে মিলেছে অসাধারণ সব রোমাঞ্চের দেখা। 

এসবের শুরু একেবারে প্রথম থেকে। উদ্বোধনী ম্যাচ, প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা-নামিবিয়া। শক্তি-সামর্থ্য, ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতা; দুই দলের পার্থক্য সব দিকেই আকাশ-পাতাল। নিজেদের পায়ের নিচে মাটি কেবলই পেতে শুরু করেছে নামিবিয়া। আর লঙ্কানরা সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, এবারের বিশ্বকাপে অংশ নেয় তারা এশিয়া কাপ জিতে। কিন্তু সব পরিসংখ্যান, ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দেয় নামিবিয়া! অবিশ্বাস্য জয়ে সাড়া ফেলে দেয় ক্রিকেট বিশ্বে। 

বিস্ময় জাগানো জয়ে শুরু হওয়া অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে এমন ‘আপসেট’ ঘটেছে বেশ কয়েকটি। এক কথায় আসরটিকে বলা যায়, অঘটনের বিশ্বকাপ। যেখানে শুধু নামিবিয়া নয়, চমক দেখিয়েছে নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড। 

নামিবিয়ার লঙ্কান-বধ 

দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে খেলতে নেমেই সবাইকে অবাক করে দেয় নামিবিয়া। দাপুটে পারফরম্যান্সে ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে স্রেফ উড়িয়ে দেয় আফ্রিকার দেশটি। লঙ্কানদের সঙ্গে দ্বিতীয় দেখায়ই তুলে নেয় জয়। 

ভারত, পাকিস্তানের মতো ক্রিকেটের পরাশক্তিদের হারিয়ে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিশ্বকাপ শুরু করে লঙ্কানরা। আবার প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষ নামিবিয়ার মতো শক্তিতে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা দল। স্বাভাবিকভাবেই জয় প্রত্যাশিত ছিল তাদের। 

কিন্তু শ্রীলঙ্কাকে পাত্তাই দেয়নি নামিবিয়া। উজ্জীবিত ক্রিকেটে নিজেদের মেলে ধরে উপহার দেয় বিস্ময় জাগানো ৫৫ রানের বড় জয়। 

নামিবিয়াকে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে প্রথমে চেপেই ধরেছিল লঙ্কানরা। একশর আগে তুলে নিয়েছিল ৬ উইকেট। কিন্তু সপ্তম উইকেটে ইয়ান ফ্রাইলিঙ্ক ও জেজে স্মিথের ৩৩ বলে ৬৯ রানের জুটিতে ১৬৩ রানের পুঁজি গড়ে নামিবিয়া। 

শ্রীলঙ্কার জন্য এই রান তাড়া করা অসম্ভব কিছু ছিল না। এশিয়া কাপে একের পর এক রান তাড়ার রেকর্ড গড়েই শিরোপার পথে এগিয়ে গিয়েছিল তারা। 

কিন্তু ব্যাটিংয়ের পর নামিবিয়ার ক্রিকেটাররা বল হাতেও ছিলেন উজ্জ্বল। টানা দুই বলে পাথুম নিসানকা ও দানুশকা গুনাথিলাকাকে ফিরিয়ে জয়ের ভিত গড়ে দেন বেন শিকোঙ্গো। তার মতো দুটি করে উইকেট নেন শ্রীলঙ্কাকে ১০৮ রানেই গুটিয়ে দেন ডেভিড ভিসা, বের্নার্ড শুলজ ও ফ্রাইলিঙ্করা। লঙ্কানদের কাউকে ৩০ রানও ছুঁতে দেননি তারা। 

স্কটল্যান্ডের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হার 

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দুইবার জেতা একমাত্র দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু এই সংস্করণে সময়টা অনেকদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না তাদের। গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আসরে সরাসরি সুপার টুয়েলভে খেললেও এবার তাদের পড়তে হয় প্রাথমিক পর্বের পরীক্ষায়। সেখানে ব্যর্থ হয়ে শেষ হয়ে যায় এবারের বিশ্বকাপে তাদের পথচলা। 

প্রথম রাউন্ড থেকে নিকোলাস পুরানদের ছিটকে পড়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের হার। প্রাথমিক পর্বে প্রথম খেলতে এসে ক্যারিবিয়ানরা প্রথম ম্যাচেই পায় চমক। তাদেরকে কোনো ধরনের লড়াইয়ের সুযোগ না দিয়ে ৪২ রানের বড় জয় তুলে নেয় স্কটিশরা। দুই দলের প্রথম দেখায় উল্লাসে মাতে তারা। 

গত বছর আমিরাতের বিশ্বকাপের পর চলতি বৈশ্বিক আসরে খেলার আগে স্রেফ দুটি টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ পেয়েছিল স্কটল্যান্ড। স্বল্প এই প্রস্তুতি নিয়েই তারা ঘটিয়ে দেয় ‘অঘটন।’ ম্যাচে শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পেছনে ছুটে দলটি। অভিজ্ঞ জর্জ মানজির ফিফটি ও বাকিদের টুকটাক অবদানে গড়ে ফেলে ১৬০ রানের পুঁজি। 

শক্ত ভিত কাজে লাগাতে ভুল করেননি বোলাররা। মার্ক ওয়াট, ব্র্যাড উইল, মাইকেল লিস্কদের নৈপুণ্যে স্রেফ ১১৮ রানেই অলআউট হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাদের হয়ে কেউ যেতে পারেননি চল্লিশের ঘরে। 

সেই ধাক্কা সামাল দিয়ে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে তবুও সুপার টুয়েলভে খেলার আশা বেঁচেই ছিল ক্যারিবিয়ানদের। কিন্তু ২০১২ ও ২০১৬ সালের চ্যাম্পিয়নদের সেই স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয় আয়ারল্যান্ড। প্রাথমিক পর্বের শেষ ম্যাচে আইরিশদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাদের ১৪৬ রান ৯ উইকেট ও ১৫ বল বাকি থাকতেই তাড়া করে ফেলে অ্যান্ডি বালবার্নির দল। 

আয়ারল্যান্ডে ধরাশায়ী ইংল্যান্ড 

বিশ্বকাপের হট ফেভারিট দল ইংল্যান্ড। জায়গা করে নিয়েছে তারা সেমি-ফাইনালে। কিন্তু তাদের শেষ চারে ওঠার পথ কঠিন করে তুলেছিল আয়ারল্যান্ড। সুপার টুয়েলভ পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই হেরে বসে ইংলিশরা। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে ৫ রানে জিতে চমক দেখায় আইরিশরা। 

টি-টোয়েন্টিতে দুই দলের যা ছিল দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। ২০১০ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে প্রথম দেখায়ও বাগড়া দিয়েছিল বৃষ্টি। ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের পর আয়ারল্যান্ড ইনিংসের চতুর্থ ওভারে বৃষ্টি নামলে ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। তবে এবার টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয় নিয়েই মাঠ ছাড়েন আয়ারল্যান্ড। 

বালবার্নি ও লর্কান টাকারের বিধ্বংসী দুটি ইনিংসে ১৫৭ রানের সংগ্রহ দাড় করায় আইরিশ। পরে চমৎকার বোলিংয়ে ইংল্যান্ডের ৫ উইকেট দ্রুত তুলে নিয়ে জয়ের আশা জাগায় তারা। পঞ্চদশ ওভারে বৃষ্টি নামলে তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়। ম্যাচ শেষে আইরিশ অধিনায়কও বলেছিলেন, বৃষ্টি দেখে এতো খুশি আগে কখনও লাগেনি তার। 

পাকিস্তানকে হারিয়ে জিম্বাবুয়ের চমক 

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গত আসরে খেলা হয়নি জিম্বাবুয়ের নিষেধাজ্ঞায় থাকায়। বাছাই পর্ব পেরিয়ে এবার তারা ফিরে বিশ্ব মঞ্চে। উজ্জীবিত ক্রিকেট উপহার দিয়ে প্রথমবার জায়গা করে নেয় সুপার টুয়েলভে। 

আর সেখানে তারা দেখায় বড় চমক। রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে ১ রানের জয়ে তারা জানান দেয় নিজেদের উত্থানের। পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ১৮ বারের লড়াইয়ে যা ছিল জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় জয়। 

প্রথমে ব্যাট করে খুব বড় পুঁজি গড়তে পারেনি জিম্বাবুয়ে। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে স্রেফ করতে পারে ১৩০ রান। কে জানত, স্বল্প এই সংগ্রহ নিয়েই ম্যাচ জিতে নেবে জিম্বাবুয়ে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেটাই করে দেখাল তারা। 

জিম্বাবুয়ের আঁটসাঁট বোলিংয়ে হাত খুলে খেলা তো বহু দূর, রান নিতেই ধুঁকছিল পাকিস্তান। রোমাঞ্চের নানা বাঁক পেরিয়ে ম্যাচ গড়ায় শেষ ওভারে। যেখানে বাবর আজমদের দরকার ১১ রান, হাতে তখনও ৪ উইকেট। 

ব্র্যাড ইভান্সের করা ওভারের প্রথম তিন বলে এক বাউন্ডারি, একটি তিন রান ও একটি সিঙ্গেলে রান চলে আসে ৮। শেষ ৩ বলে চাই ৩ রান। উইকেটে মোহাম্মদ নাওয়াজের মতো দলটির অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার থাকার পরেও সহজ সেই সমীকরণ মেলাতে পারেনি পাকিস্তান। উল্টো হারায় তারা দুই উইকেট। 

অবিশ্বাস্য জয়ে বাঁধনহারা উল্লাসে মাতে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা। 

দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন ভেঙে ডাচদের ঐতিহাসিক জয়

এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় বিস্ময় জাগানিয়া জয়টি বোধহয় নেদারল্যান্ডসের। বাছাই পেরিয়ে বিশ্বকাপে খেলতে এসে প্রথমবার সুপার টুয়েলভে জায়গা করে নিয়ে তারা হারিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে! যারা কিনা টুর্নামেন্টের ফেভারিট দলগুলোর একটি। 

জিতলেই সেমি-ফাইনাল, সহজ এই সমীকরণ নিয়ে ডাচদের বিপক্ষে খেলতে নামে প্রোটিয়ারা। কিন্তু তাদেরকে স্তম্ভিত করে ঐতিহাসিক এক জয় উপহার দেয় নেদারল্যান্ডস। এই হারে শেষ চারে যাওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় টেম্বা বাভুমার দলের। বিদায় নেয় তারা সুপার টুয়েলভ থেকেই। 

বিশ্বকাপে পথচলা আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল নেদারল্যান্ডসের। তাদের সামনে হাতছানি ছিল সরাসরি পরের আসরে জায়গা করে নেওয়ার। ১৩ রানের স্মরণীয় জয়ে সেই লক্ষ্য পূরণ করে দলটি। 

টি-টোয়েন্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এটি ছিল নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় ম্যাচ। ২০১৪ সালে প্রথম দেখায় চট্টগ্রামে স্রেফ ৬ হারে হেরেছিল ডাচরা। এবার আর সেই ভুল করেনি তারা। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে তুলে নিল অসাধারণ এক জয়। 

শুরুর চার ব্যাটসম্যানের দারুণ পারফরম্যান্সে ১৫৮ রানের পুঁজি গড়ে নেদারল্যান্ডস। পরে নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে চেপে ধরে শুরু থেকেই। ম্যাচের ষোড়শ ওভারে যখন ডেভিড মিলারকে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচে ফেরত পাঠান রুলফ ফন ডার মেরওয়া, তখনই জয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় নেদারল্যান্ডসের। শেষ পর্যন্ত ১৪৫ রান থামে দক্ষিণ আফ্রিকা। 

এবারের বিশ্বকাপে শুরু থেকেই দারুণ খেলে আসছে নেদারল্যান্ডস। প্রাথমিক পর্বে নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচে নামিবিয়া ও আমিরাতকে হারিয়ে তারা গড়ে ফেলে সুপার টুয়েলভে যাওয়ার ভিত। পরে সুপার টুয়েলভে এসে ছন্দে থাকা জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দিয়ে তুলে নেয় সুপার টুয়েলভে নিজেদের প্রথম জয়। 

এসবের বাইরেও আছে চমক জাগানো পারফরম্যান্স। এর একটি উপহার দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ৭ বছর পর বিশ্বকাপে খেলতে আসা দলটি প্রাথমিক পর্বে নামিবিয়াকে হারিয়ে স্বাদ নেয় বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম জয়ের।