হাসিমুখে হেলসের প্রায়শ্চিত্তের পথে যাত্রা

কিছুদিন আগে যিনি ছিলেন না দলের ধারেকাছেও, বিশ্বকাপ দলেও জায়গা পাননি শুরুতে, তিনিই এখন ইংল্যান্ডের ফাইনালে ওঠার নায়ক।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিঅ্যাডিলেইড থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2022, 03:41 PM
Updated : 10 Nov 2022, 03:41 PM

অ্যালেক্স হেলসের হাসি যেন থামেই না। জুটির পঞ্চাশে হাসি। নিজের পঞ্চাশে হাসি। দলের শতরানে হাসি। উইকেটে সঙ্গী জস বাটলার কোনো একটা কৌতুক করলেন বোধহয়, হেলস আবার হাসেন। সবচেয়ে চওড়া হাসি দেখা গেল দলের জয়ের পর। অ্যাডিলেইড ওভালের রাত উদ্ভাসিত তার ব্যাটের হাসিতে, তার মুখের হাসিতে। কত কাতর অপেক্ষার পর, কত যন্ত্রণাময় দিন-রাত পেরিয়ে তবে এসেছে এই হাসির ফোয়ারা! 

সাড়ে তিন বছর ইংল্যান্ড দলের ধারেকাছে আসতে দেওয়া হয়নি তাকে। তার নিজের ভুলেই। শৃঙ্খলাভঙ্গের একের পর এক ঘটনায় দলের বিশ্বাসই ভেঙে গিয়েছিল তাকে নিয়ে। দেশের মাঠে ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন মিলিয়ে গিয়েছিল হাওয়ায়। আরেকটি বিশ্বকাপ খেলা তো বহুদূর, আর কখনও জাতীয় দলে খেলার আশাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন নিজেই। এবার বিশ্বকাপ দলেও ছিলেন না শুরুতে। 

সেই হেলস, জীবন মঞ্চের নানা নাটকের মঞ্চায়নের পালায় এখন তিনি ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার নায়কদের একজন! 

আগের দুই ম্যাচেও ভালো করার পর সেমি-ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৪৭ বলে ৮৬ রানের অপরাজিত ইনিংস। জস বাটলারের সঙ্গে রেকর্ড গড়া জুটি। ৩ চারের সঙ্গে ছক্কা ৭টি! 

এই যে লম্বা সময় বাইরে থাকতে হয়েছে, সেই জ্বালা জুড়াচ্ছেন এমন ব্যাটিংয়ে? একেকটি শটে ক্ষোভগুলো ঝেরে ফেলা? প্রশ্ন শুনে আবার হাসলেন হেলস।  

“নাহ, আমার তা মনে হয় না। মাঠে নামার সময় এসব তো মাথায় থাকে না। আমি স্রেফ মুখে হাসি নিয়ে ইংল্যান্ডের জার্সিতে আবার খেলছি। বিশ্বকাপের শিরোপা জিততে পারা হবে দারুণ স্পেশাল কিছু।” 

দলের বাইরে থাকার সময়টায় আত্মোপলব্ধি হয়েছে বলে দাবি করেছেন নানা সময়ে। মাঠের ক্রিকেটেও নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন। সাদা বলে রানের স্রোত বইয়ে দিয়েছেন। নিজ দেশে। দেশের বাইরে নানা লিগে। কিন্তু ওই যে অতীত! বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দল থেকে এতটাই দূরে ছিটকে দেওয়া হয়েছিল তাকে, পরে ফিরে এসে কড়া নাড়লেও আর দুয়ার খোলেনি। 

জেসন রয়ের পড়তি ফর্ম তার মনের কোণে আবার একটু আশা জাগিয়েছিল, এবার হয়তো হতে পারে। কিন্তু হয়নি। জায়গা পাননি বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। হতাশ ও বিষণ্ন হয়ে ইংল্যান্ড দলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রব কি-কে ফোন করে কারণও জানতে চান।

পরে সেই দুয়ারের খিল খুলে গেল অভাবনীয়ভাবে। 

গলফ খেলতে গিয়ে চোটে পড়ে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেল জনি বেয়ারস্টোর। বান্ধবীর সঙ্গে কেপ টাউনে ছুটির পরিকল্পনায় থাকা হেলসের ফোন বেজে উঠল। জাতীয় দলের একজন হয়ে পাকিস্তানের বিমানে চেপে বসলেন। অস্ট্রেলিয়ার উড়ানেও জায়গা হলো। ২২ গজেও উড়তে থাকলেন তিনি। 

বিশ্বকাপে শুরুর দুই ম্যাচে যদিও পূরণ করতে পারেননি প্রত্যাশা। এরপর দলের ছুটে চলার রথে তিনি শুরুর সারথি। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪০ বলে ৫২। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩০ বল ৪৭। এরপর সেমি-ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৪৭ বলে ৮৬ রানের খুনে ইনিংস। দলের ফাইনালে ওঠার ম্যাচে তিনিই ম্যান অব দা ম্যাচ। 

ম্যাচ শেষে তিনি বললেন, এমনি দিনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন বলেই প্রাপ্তির আনন্দ অনেক বেশি। 

“ভাবতেও পারিনি, আবারও বিশ্বকাপে খেলতে পারব। সেই সুযোগটি পাওয়া স্পেশাল অনুভূতি। আমার ক্যারিয়ারের সেরা রাতগুলির একটি এটি।” 

“যখন মনে হচ্ছিল, জীবনের সেরা টি-টোয়েন্টি খেলছি, সেই সময়েই ইংল্যান্ডের হয়ে আবার খেলতে পারা অসাধারণ এক অনুভূতি। ভাবতেও পারিনি এই সুযোগ আবার আসবে। সুযোগের সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে মুখিয়ে আছি আমি।” 

ইংল্যান্ডের রান তাড়ায় এ দিন শুরুটা আগ্রাসী করেন জস বাটলার। ৪ ওভার পর্যন্ত রানে এগিয়ে ছিলেন তিনিই। এরপর হেলস দুর্দান্ত সব শটের প্রদর্শনীতে এতটা এগিয়ে গেলেন, অধিনায়ককে পেছনে ফেলে ফিফটি করে ফেললেন আগেই। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেন শেষ পর্যন্ত। কোনো সুযোগই দিলেন না ভারতকে। যেন ভিডিও গেমসের মতো মাঠের চারপাশে আছড়ে ফেললেন বোলারদের। 

নিজের ব্যাটিংয়ে তিনি নিজেও যে তৃপ্ত, তা ফুটে উঠছিল চোখ-মুখে। উঠে এলো কণ্ঠেও। 

“বিশাল উপলক্ষ এটি, বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনাল ভারতের বিপক্ষে… অনেক বড় উপলক্ষ। যেভাবে খেলেছি, সত্যিই খুশি। যতটা স্পেশাল হওয়া সম্ভব, এটা ততটাই।” 

প্রায়শ্চিত্তের প্রসঙ্গও এসে যায় অবধারিতভাবে। তার ওপর ভরসা করে ভুগেছে দল। এখন দলকে সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেওয়ার পালা! 

তিনি অবশ্য আপত্তি করলেন এখানেও। সেই হাসি-মজা-আনন্দের কথা তুলে ধরলেন আবার। শোনালেন নতুন জীবন দর্শনের গল্প। সঙ্গে স্বপ্নের কথাও। 

“নাহ, এটাও (প্রায়শ্চিত্ত) মনে করি না। এটাও আমার মাথায় নেই। আমি স্রেফ নিজের ক্রিকেট, ইংল্যান্ডের হয়ে ফেরা উপভোগ করছি। উপভোগ করেই যেতে চাই, সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলে যেতে চাই। আজকে স্পেশাল একটি রাত ছিল। বিশ্বকাপ জিততে পারলে তা হবে সোনায় সোহাগা।” 

তিনি যতই এড়িয়ে যান, নিজেও নিশ্চয়ই জানেন, এই অভিযান যতটা উপভোগের, ততটাই প্রায়শ্চিত্তের। হাসির পথ ধরে চূড়ান্ত ঠিকানাও এখন দেখতে পাচ্ছেন। অপেক্ষা স্রেফ আর একটি ম্যাচে জ্বলে ওঠার।