তীব্র গরমে মিরপুর টেস্টে বিরতি বাড়ানোর পরামর্শ বিসিবি চিকিৎসকের

সম্প্রতি সিলেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের সিরিজে দুই দলের সমঝোতায় বাড়ানো হয়েছিল বিরতির সংখ্যা।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2023, 12:27 PM
Updated : 7 June 2023, 12:27 PM

মিরপুর শের-ই বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাশাপাশি দৌড়াচ্ছিলেন তামিম ইকবাল, তাসকিন আহমেদ ও সৈয়দ খালেদ আহমেদ। মঙ্গলবার দুপুরে তাপমাত্রা তখন ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ড্রেসিংরুমের পাশে মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কয়েক চক্কর দেওয়ার পর ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে ঘাসেই শুয়ে পড়েন খালেদ। হাঁটুতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন তামিম। বারবার ঘাম মুছতে থাকেন তাসকিন। তাদের পাশে দৌড়ানো নাজমুল হোসেন শান্ত, মাহমুদুল হোসেন জয়, শরিফুল ইসলামরা গরমের কারণে গায়ের জার্সিই খুলে ফেলেন।

কয়েক দিন ধরে ক্রিকেটারদের অনুশীলনে নিয়মিত চিত্রই অবশ্য এমন। প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে লড়াই করেই চলছে তাদের অনুশীলন। আগের দিন প্রধান কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ইশারা করে দেখান, 'অনেক গরম...অনেক!'

অনুশীলনে তবু নিজেদের মতো করে চালানোর সুযোগ আছে। প্রয়োজনমত থাকে পানি পানের বিরতি। কিন্তু ম্যাচ চলাকালে নির্ধারিত সময়ের আগে কোনো বিরতির সুযোগ নেই। টেস্ট ম্যাচের আগে এমন অসহনীয় গরম সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই বড় ভাবনার জায়গা। বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশিষ চৌধুরি যেমন সম্ভাব্য করণীয় ভেবে রেখেছেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে পানি পানের বিরতি বাড়ানোর পরামর্শ তার।

পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচে সাধারণত দিনের খেলায় দুই ঘণ্টা পরপর থাকে সেশন বিরতি। আর প্রতি সেশনে এক ঘণ্টা পরপর দেওয়া হয় পানি পানের বিরতি।

তবে সিলেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ 'এ' দলের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত আনঅফিসিয়াল টেস্ট সিরিজে গরমের কারণেই বাড়তি রাখা হয়েছিল। খেলার মাঝেই বড় ছাতার নিচে বসে দুই দলের খেলোয়াড়দের পানি পান করতে দেখা গেছে প্রায় নিয়মিত। দুই দলের সমঝোতায় বাড়ানো হয়েছিল বিরতি।

আফগানদের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচেও একই পথ বেছে নেওয়া উচিত, বুধবার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে বললেন বিসিবির প্রধান চিকিৎসক।

“ওয়েস্ট ইন্ডিজ 'এ' দলের বিপক্ষে যে সিরিজটি ছিল, দুই দলের সম্মতির ভিত্তিতে আমরা বিরতির সংখ্যা বাড়িয়েছিলাম। টেস্ট ম্যাচেও এমন হবে কি না, সেটি ম্যাচ রেফারি অথবা দলের সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ক্রিকেটারদের স্বাস্থ্যগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা চাইব বিরতির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। অথবা কোনো ক্রিকেটার যখনই পানি বা ছায়ার জন্য ডাকবে, ওদের জন্য এই ছাড়টা যেন দেওয়া হয়।”

গত বেশ কিছু দিন ধরে সারা দেশে চলছে তাপপ্রবাহ। আগামী আরও এক-দেড় সপ্তাহ এই অবস্থা অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর মধ্যেই চলছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অনুশীলন।

এমন দাবদাহে ক্রিকেটারদের স্বাস্থ্যকে ভাবনায় রেখে কিছু ছাড় দিয়ে রেখেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। যার যতটুকু স্বচ্ছন্দ্য মনে হচ্ছে, ততটুকুই ব্যাটিং-বোলিং করছেন ক্রিকেটাররা। রানিং ও ফিটনেস সেশনে বাড়তি জোর দেওয়া হলেও সেটি বিসিবির চিকিৎসা বিভাগের সুনির্ধারিত নিয়মের মধ্যেই চলছে।

উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি বাতাসের আর্দ্রতার কারণে শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই ক্রিকেটারদের শরীরকে প্রস্তুত করার জন্য অনুশীলনের আগের সময়ের মতো পরের সময়েও সমান জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেবাশিষ।

“ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে আমরা ডিহাইড্রেশন প্রিভেন্ট করার জন্য প্রিহাইড্রেশন করতে বলি। অর্থাৎ খেলার আগের দিন থেকেই নিজেদের হাইড্রেশনের অবস্থাটা ধরে রাখতে হবে। এখন সূর্যের সে সরাসরি তাপটা, সেটা কমানোর জন্য আমরা সুযোগ পেলেই ঘন ঘন বিরতির ব্যবস্থা করি। ওই সময় ছায়া বা বড় ছাতার নিচে ওদের থাকতে বলি।”

“বিরতির সময় ওদের হাইড্রেশন দেখা হয়। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওদের সারা শরীরের অনাবৃত স্থানগুলো মুছে দেওয়া হয়। যখনই ওরা ভেতরে চলে আসে, তখনই আমরা শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় আমরা বরফ দিয়ে থাকি। বরফ দেওয়ার মাধ্যমে শরীরের ভেতরের তাপটাকে আমরা কমানোর চেষ্টা করি। এছাড়া আইস বাথেরও ব্যবস্থা আছে।”

অনুশীলন বা খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কেন শরীরের সমান যত্ন নিতে হবে, সেটিও ব্যাখ্যা করেছেন এই চিকিৎসক।

“এ ধরনের তাপের কারণে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা যে পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, সেটি বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত থেকে যায়। চামড়ার ওপরের তাপমাত্রা কমে গেলেও, ভেতরে আরও অনেক দিন থাকতে পারে। এজন্য খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।”

“সীমিত ওভারের খেলার সুবিধা হচ্ছে পরের দিন আমরা বিশ্রাম পাই, হিট ম্যানেজমেন্ট আমরা করতে পারছি। কিন্তু দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে আমাদের ৫ দিন টানা মাঠে থাকতে হয়। তখন ম্যানেজমেন্ট একটু কঠিন হয়। সব মিলিয়ে আমাদের ফিজিও, ট্রেইনার যারা আছে তারা এই ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আমাদের ক্রিকেটাররাও নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায়ই আমরা চেষ্টা করছি হিট রিলেটেড ইনজুরিগুলো কাটিয়ে নেওয়ার জন্য।”

মঙ্গলবার দৌড়ানোর সময় শান্ত, জয়রা খালি গায়ে থাকলেও জাকির হাসান, তাসকিন দৌড়েছেন ফুল হাতা জার্সি পরে। দুটির পার্থক্যও তুলে ধরেছেন দেবাশিস।

“খালি গায়ে থাকলে সূর্যের তাপ সরাসরি আমাদের গায়ে লাগছে। আমরা সরাসরি তাপ নিচ্ছি। আবার খালি গায়ে থাকার কারণে বাষ্পীভবন ভালো হচ্ছে। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ তাপ তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে। তো এটা একটা ভারসাম্য। সূর্যের তাপ ও বাষ্পীভবনের এই ভারসাম্যের মধ্যে সাধারণত বাষ্পীভবনই জেতে।”

গরমের মধ্যে ক্রিকেটারদের খাদ্যাভাসের জরুরি দিকটি তুলে ধরলেন বিসিবির প্রধান চিকিৎসক। আগামী শনিবার থেকে ক্রিকেটাররা যখন জাতীয় দলের তত্ত্বাবধানে ঢুকবেন, তখন বিসিবিই ঠিক করবে তাদের খাবারের মেন্যু ও রুটিন। এর বাইরে তারা যখন নিজেদের মতো থাকেন, ওই সময়ের জন্যও যথাযথ পরিকল্পনা দিয়ে দেওয়া হয়।

“খেলোয়াড়রা যখন ক্যাম্পের পরিস্থিতিতে থাকে, তখন ওদের খাবারের বিষয়টা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ওরা যখন বাসায় থাকে খাবারের প্ল্যান ওদের নিজেদেরই করতে হয়। সৌভাগ্যজনকভাবে আমাদের সঙ্গে যে ট্রেনাররা কাজ করে, ওরা এ ধরনের হিট স্ট্রেস বা হিট রিলেটেড ইনজুরিগুলো ম্যানেজমেন্টের বিষয়ে অভিজ্ঞ।”

“অবশ্যই হাইড্রেশন ও নিউট্রিশন বড় ভূমিকা রাখে, হিট স্ট্রেস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। মূলত যে খাবারগুলোর মধ্যে জলীয় অংশ বেশি আছে, সেগুলো আমরা বেশি ব্যবহার করতে বলি। এই সময়ে স্বাভাবিক খাদ্য তালিকার বাইরে প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজি যোগ করা হয়।”

তীব্র তাপদাহের কারণে শরীর থেকে ঘাম হিসেবে অনেক পানি বের হয়ে যায়। তাই কিছুক্ষণ পরপরই পানি পানের তৃষ্ণা পায়। তবে এক্ষেত্রে তেষ্টা পাওয়ার পর পানি পান করার চেয়ে আগেই তা নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ বিসিবির প্রধান চিকিৎসকের।

“পানি পানের ব্যাপারে আমরা বারবার বলে থাকি যে, তৃষ্ণা পেলে পানি পান করা যাবে না। তৃষ্ণা পাওয়ার আগেই পানি খেতে হবে। অর্থাৎ ডিমান্ড ফিডিং করা যাবে না। এটা ক্লক ফিডিং করতে হবে। এক ঘণ্টা পরপর পানি খেতে হবে। এটা তৃষ্ণার ওপর নির্ভর করবে না। যখনই আমাদের তৃষ্ণা পেয়ে যাবে, আমাদের ধরে নিতে হবে আমরা প্রায় দুই লিটারের মতো ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেছি।”

“এ ধরনের কিছু পরামর্শ ক্রিকেটাররাও জানে। ওদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া আমাদের ট্রেনারাও আছে, তারা অভিজ্ঞ। সার্বক্ষণিকভাবে তারা ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক, স্ল্যাশ বা বরফ দিয়ে চেষ্টা করছেন হিট স্ট্রেসটা ম্যানেজ করার।”

আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচটি শুরু আগামী ১৪ জুন।