অ্যামব্রোস-মাশরাফি-তাসকিনের আড্ডায় পেস বোলিংয়ের ব্যবচ্ছেদ

তিন প্রজন্মের তিন পেসারের কথোপকথনে উঠে এলে পেস বোলিংয়ের নানা দিক।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2023, 05:01 AM
Updated : 17 Jan 2023, 05:01 AM

দিনের আলো তখন অনেকটাই মিলিয়ে গেছে। জ্বলে উঠেছে জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামের কৃত্রিম আলো। তবে রোশনাইয়ে ঝলমল করছিল মাঠের একটি প্রান্ত। স্যার কার্টলি অ্যামব্রোস, মাশরাফি বিন মুর্তজা আর তাসকিন আহমেদ যেখানে ডুবে ছিলেন আড্ডায়, আর তাদের দিকে নিমগ্ন সহস্র চোখ। তিন প্রজন্মের তিন ফাস্ট বোলার, তাদের আলোচনার উপজীব্য তো আর অন্য কিছু হতে পারে না!

নস্টালজিয়া স্পর্শ করল, সেই সময় থেকে এই সময় হয়ে বাস্তবতার প্রসঙ্গ এলো, ছোট্ট সেই কথোপকথনে হাসি-মজার সঙ্গে মিশে থাকল পেস বোলারদের আক্ষেপও। আর থাকল পরামর্শ। যেখানে শিক্ষক অ্যামব্রোস, ছাত্র তাসকিন, আর মাধ্যম মাশরাফি।

চট্টগ্রামে বিপিএলের দুই ম্যাচের ফাঁকে তিন পেসারের আলাপচারিতার সেই মুহূর্ত যেন ম্লান করে দিল মাঠের ক্রিকেটকেও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মাশরাফি বললেন, মূলত তাসকিনকে ঘিরেই ছিল এই আলোচনার উদ্যোগ।

“আরেকদিন টসের সময় অ্যামব্রোসের সঙ্গে টুকটাক কথা হয়েছিল। এবার একটু সময় নিয়ে কথা হলো। আমরা ওয়ালশ-অ্যামব্রোসদের দেখে বড় হয়েছি। তারা কত বড় বোলার, আমার বলার কিছু নেই। সবাই জানে। অনেক কিছু শেখার আছে তাদের কাছ থেকে। বিসিবি থেকেই বলল তাসকিনকে নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে। আমার তো শেষ প্রায় (ক্যারিয়ার), তাসকিনের অনেক কিছু নেওয়ার আছে তার কাছ থেকে।”

অ্যামব্রোস সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন। এক যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৬৩০ উইকেট শিকারি  বোলার খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করেছেন সেই ২০০০ সালে। এখন টুকটাক কোচিং করান। কখনও কখনও তাকে দেখা যায় মাইক্রোফোন হাতে। এবারের বিপিএলে এসেছেন ধারাভাষ্যকার হয়েই।

তার অবসরের বছরখানেক পরে শুরু মাশরাফির। বৈশ্বিক ক্রিকেটের বাস্তবতায় তিনি বড় কিছু করতে পারেননি। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি কিংবদন্তি, সেটি রেকর্ড-পরিসংখ্যান ছাপিয়ে। গতির ঝড় তুলে এদেশের ক্রিকেটে তার আবির্ভাব। চোটাঘাত আর নানা বাস্তবতায় সেই সম্ভাবনা পূর্ণতা পায়নি। আরও অনেক পরে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁকবদলের নায়ক হয়েছেন তিনি নেতৃত্ব দিয়ে। কিন্তু পেস বোলার সত্ত্বা তো রয়েই গেছে। এখন তিনি ক্যারিয়ার সায়াহ্নে। তবে এদেশের অসংখ্য কিশোর-তরুণকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন পেস বোলিংয়ে আসতে।

তাদেরই একজন তাসকিন। মাশরাফিকে তাকে আদর্শ মেনেই পেস বোলিংয়ের কঠিন পথে ছুটতে শুরু করেন তিনি। গতি আর প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে আশা জাগানোর পর হারিয়ে যাওয়া, ক্রিকেট ও জীবনের অনেক লড়াইয়ে পোড় খেয়ে আবার নিজেকে ফিরে পাওয়া, এভাবেই চলছে তার। গত দুই বছরে বলা যায় নিজেকে নতুন করে মেলে ধরেছেন তিনি।

তাদের তিনজনের কথোপকথনের চুম্বক অংশ ধরা পড়ল বিসিবির ভিডিওতে। অ্যামব্রোসের কথায় ফুটে উঠল, তাদের যুগ থেকে এই সময়ে পেস বোলারদের হাত-পা কতটা বাঁধা।

“ক্রিকেট অনেক বদলে গেছে। আমি যখন খেলতাম, এটা ভিন্ন ছিল। অবশ্যই টি-টোয়েন্টি ছিল না, শুধু ওয়ানডে ও টেস্ট ছিল। তবে নিয়ম এত বেশি বদলে গেছে…এখন ক্রিকেট মূলত ব্যাটসম্যানদের খেলা। বোলারদের জন্য খুব কঠিন। পিচগুলোও খুবই শোচনীয় (বোলারদের জন্য), বিশ্বজুড়েই…। একতরফা ব্যাটসম্যানদের খেলা হয়ে গেছে…।”

সেই বিষাদ সঙ্গীতে কণ্ঠ মেলালেন মাশরাফিও, “টেস্টেও এখন ৪০০, ৫০০ নিয়মিতই হচ্ছে…।”

এবারের আগে একবারই বাংলাদেশে এসেছিলেন অ্যামব্রোস। খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ দিকে দুটি ওয়ানডে খেলেছিলেন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। সেই স্মৃতি মনে করলেন মাশরাফি, “আপনাকে দেখেছি, ১৯৯৯ সালে ঢাকায় বোলিং করতে…।”

যেখানে মাশরাফি আছেন, সেখানে মজা হবে না, তা কী আর হয়! অ্যামব্রোসের ধারাভাষ্য নিয়ে কথা বলার মাঝখানো বলেই উঠলেন, “আপনাকে ধারাভাষ্য নিয়ে কেন জিজ্ঞেস করছি জানেন? শিগগিরই আমি আপনার সঙ্গী হব…!” হাসিতে ফেটে পড়লেন তিনজনই।

সেই হাসির রেশ মিলিয়ে যেতেই মাশরাফি ঢুকে গেলেন মূল প্রসঙ্গে। তাসকিনকে দেখিয়ে তিনি বললেন, “তবে এই ছেলেটি অনেক বদলে গেছে। সবশেষ দুই বছরে সে বিশ্বের সব জায়গায় পারফর্ম করছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫ উইকেট নিয়েছে, নিউ জিল্যান্ডে দারুণ বোলিং করেছে...। তার সঙ্গে যদি আপনার কিছুটা কথা বলার সময় মেলে…।”

তাসকিন বিশ্বের নানা জায়গায় পারফর্ম করেছেন জেনে বড় প্রেরণা জোগালেন অ্যামব্রোসও।

“এটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমি সাধারণত ক্রিকেটারদের বিচার করি, বিশ্বের জায়গায় কারা ভালো করছে। অনেকেই দেশে ভালো করে, বিদেশে গিয়ে ধুঁকতে থাকে। গ্রেট ক্রিকেটার হতে গেলে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় টিকে থাকতে হবে। তুমি সঠিক পথেই আছো।”

মাশরাফি বললেন তাসকিনের গতির কথা, “ও নিয়মিত ১৪২-১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বল করছে…।” শুনে অ্যামব্রোস যোগ করলেন, “এমন গতিতে বোলিং করছে সে মন্থর উইকেটে। সহায়ক উইকেট পেলে গতি বাড়ার সুযোগ আছে।”

একসময় মাশরাফিও ছিলেন দুরন্ত গতির ফাস্ট বোলার। অনেকেই তাকে মনে করেন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গতিময় বোলার। একের পর এক চোট আর অস্ত্রোপচারের থাবায় সেই গতি পরে হারিয়ে গেছে। টিকে থাকার জন্য মাশরাফির আশ্রয় হয়েছে লাইন-লেংথ, অফ কাটার আর বুদ্ধি। তাসকিনকেও চোটের নিত্য লড়াই করতে হচ্ছে। তবে কাঁধ বা হাঁটুর বড় কোনো অস্ত্রপচারের ধাক্কা সইতে হয়নি তার, গতিটা এখনও তিনি ধরে রাখতে পেরেছেন।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই মাশরাফি বললেন, “ আমি ওকে বলেছি, ফিটনেসটা ধরে রাখতে। ফিটনেস মানে স্ট্রেংথ…”

সেই কথাটুকুই কেড়ে নিয়ে অ্যামব্রোস ব্যাখ্যা করলেন আরও বিস্তারিত।

“এখন দেখি অনেক ক্রিকেটারই জিমে অনেক সময় কাটায়। আমার তা নিয়ে আপত্তি নেই। জিমে যাও, শক্তিশালী হও। তবে মনে রাখতে হবে, বডিবিল্ডার হওয়ার চেষ্টা করো না। কারণ ফাস্ট বোলার হিসেবে নমনীয়ও থাকতে হবে। শক্তি বাড়ানোর জন্য জিমে কাজ করো, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অনেক বেশি রানিং ও অনেক বেশি বোলিং।”

“জিমে গিয়ে পেশি বানানো মানেই তুমি ফিট নও। ম্যাচ রেডি ও ম্যাচ ফিট হতে প্রচুর রানিং ও প্রচুর বোলিং করতে হবে। এভাবেই শরীর পোক্ত হয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপ মেটানোর উপযুক্ত হয়। প্রচুর ওভার বোলিং করার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে।”

অ্যামব্রোসদের যুগের প্রায় সব ফাস্ট বোলারই ফিটনেসকে দেখতে এভাবেই। ওয়াসিম আকরাম, কোর্টনি ওয়ালশরা নানা সময়ই বলেছেন, তাদের কাছে ফিটনেস ট্রেনিং মানেই ছিল দৌড়ানো আর দৌড়ানো। বোলিংয়ে ম্যাচ ফিট হতেন তারা নেটে ক্লান্তিহীন বোলিং করে।

এখন সেসব বাস্তবতা বদলে গেছে অনেকটাই। ট্রেনার-ফিজিওদের নানা গবেষণার এই যুগে জিমের গুরুত্ব বেড়েছে। ক্রিকেট এখন অনেক বেশি হয়, শরীরকে রিকভারির সময় দেওয়া যায় কম। দল থেকেই পেস বোলারদের মেপে দেওয়া হয়, নেটে কোনদিন কে কত ওভার বোলিং করবে।

তবে অ্যামব্রোস এখনও বিশ্বাস করেন, ফাস্ট বোলারদের টিকে থাকার ও লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হওয়ার সেরা উপায় তাদের সময়ের সেই ভাবনাগুলোই।

“অনেকেকেই দেখেছি জিমে গিয়ে অনেক পেশি বানিয়ে এনেছে। কিন্তু মাঠে গিয়ে ৪ ওভার বোলিং করেই শেষ! মনে রেখো, পা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তোমার কাঁধ কখনও ক্লান্ত হবে না। কিন্তু পা যখন শক্তিশালী হবে, তখন সব ঠিক চলবে।”

“১০ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়াতে হবে না তোমাকে। এটা তোমার কাজ নয়। কিন্তু অনেক দৌড়াতে হবে, স্ট্যামিনা বাড়াতে হবে এবং পা শক্তিশালী করতে হবে যেন শরীরের ভার বইতে পারে। পাশাপাশি প্রচুর বোলিং করতে হবে। তাহলের শরীরের সব পেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।”

এভাবেই কথার স্রোত ছুটতে থাকে বাধাহীন। তিন প্রজন্মের ভাবনা নানা বাঁক পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মিশে যায় ফাস্ট বোলিংয়ের একই মোহনায়।