বাঁচা-মরার লড়াইয়ে পরিণত হওয়া ম্যাচে মোহাম্মদ নাঈম শেখের সেঞ্চুরিতে খুলনার জয়, টানা আট জয়ে শুরু করা রংপুর রাইডার্স হেরে গেল টানা চার ম্যাচে।
Published : 30 Jan 2025, 05:37 PM
অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ আগের দিনই বলেছেন, সব ম্যাচই এখন তাদের জন্য নক-আউট। বাস্তবতাও তেমনই। এই ম্যাচ হেরে গেলেই যেমন এক ম্যাচ বাকি থাকতে শেষ সব আশা। এমন সমীকরণের ম্যাচে নিজের সেরাটা উপহার দিলেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ। চমৎকার সেঞ্চুরিতে এই ওপেনার খুলনা টাইগার্সকে এনে দিলেন বড় পুঁজি। পরে সৌম্য সরকারের হুঙ্কার সামলে তারা হারিয়ে দিল রংপুর রাইডার্সকে।
বাঁচা-মরার লড়াইয়ের পরিণত হওয়া ম্যাচে খুলনার জয় ৪৬ রানে। ১১ ম্যাচে ১০ পয়েন্ট নিয়ে প্লে-অফের লড়াইয়ে টিকে থাকল তারা। ফলে অপেক্ষা আরও বাড়ল দুর্বার রাজশাহীর। আর টানা আট জয়ে সেরা চার নিশ্চিত করা রংপুর হেরে গেল পরপর চার ম্যাচ। তাদের শীর্ষ দুইয়ে থাকাও এখন অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল।
মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নাঈমের সেঞ্চুরিতে ৪ উইকেটে ২২০ রান করে খুলনা। দেশের হোম অব ক্রিকেটে এর চেয়ে বড় দলীয় স্কোর আছে আর একটি। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে মিনিস্টার রাজশাহীর ২২০ রানে টপকে ২২১ রান করেছিল ফরচুন বরিশাল।
পাঁচ বছর পর আর তেমন কিছু করতে পারেনি রংপুর। সৌম্য সরকারের একার লড়াইয়ে ৯ উইকেটে ১৭৪ পর্যন্ত যেতে পারে দলটি।
ওপেনিংয়ে নেমে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন নাঈম। ৭ চারের সঙ্গে ৮টি ছক্কা মেরে ৬২ বলে খেলেন ১১১ রানের ইনিংস।
পরে বল হাতে ২৪ রানে ৩ উইকেট নেন প্রায় ৯ মাস পর স্বীকৃত ক্রিকেটে ফেরা মুশফিক হাসান।
মিরাজের ঝড় ও বিদায়
টস জিতে ব্যাটিং নিয়ে প্রথম ওভারেই সাইফ উদ্দিনের বলে দুটি ছক্কা মারেন মেহেদী হাসান মিরাজ। পরের ওভারে শেখ মেহেদি হাসানের বল ছক্কায় ওড়ান নাঈম। মিরাজের ব্যাট থেকে আসে চার। দুই ওভারে খুলনা করে ২৭ রান।
ঝড়ো শুরু বড় করতে পারেননি মিরাজ। মেহেদির বলে প্যাডেল সুইপের মতো খেলে ফাইন লেগে ক্যাচ দেন খুলনা অধিনায়ক (১২ বলে ২১ রান)।
ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট
মিরাজের বিদায়ের পর একই গতিতে রান করতে পারেননি নাঈম ও অ্যালেক্স রস। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে মেহেদির বলে ছক্কা-চার মেরে কিছুটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন নাঈম। পরের ওভারে রস মারেন নিজের একমাত্র বাউন্ডারি।
অষ্টম ওভারে ভুল বোঝাবুঝিতে ভাঙে এই জুটি। রান আউট হয়ে নারাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মাঠ ছাড়েন ১৪ বলে ১২ রান করা রস।
নাঈম-বসিস্টোর ঝড়
চার নম্বরে নামা উইলিয়াম বসিস্টোকে নিয়ে বড় জুটি গড়েন নাঈম। জুটির শুরুতে দুজনই সময় নেন। দশ ওভার শেষে খুলনার সংগ্রহ দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৭৪ রান। তখনও ত্রিশ ছুঁতে পারেননি নাঈম। ১১ বলে ১০ রানে ছিলেন বসিস্টো।
পরের দশ ওভারে রংপুরের বোলারদের ওপর তাণ্ডব চালান খুলনার ব্যাটসম্যানরা। এই সময়ে ২ উইকেট হারিয়ে তারা করে ১৪৬ রান।
দ্বাদশ ওভারে ইফতিখারের আহমেদের বলে ডানা মেলার সুযোগ পেয়ে যান নাঈম। লং অন ও লং অফ দিয়ে মারেন তিনটি ছক্কা। তৃতীয় ছক্কায় ৩৩ বলে পৌঁছে যান ক্যারিয়ারের ষোড়শ পঞ্চাশে।
পরের ওভারে নাহিদ রানার গতিময় ডেলিভারি স্কুপ করে ছক্কা মারেন নাঈম। ওভারের শেষ বল ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে ছক্কায় ওড়ান বসিস্টো। চতুর্দশ ওভারে আক্রমণে ফিরে দুটি 'নো' বল করেন সাইফ উদ্দিন, হজম করেন দুটি বাউন্ডারি।
এরপর আকিফ জাভেদের বলে ছক্কা মারার ড্রেসিং রুমে ফিরে যান বসিস্টো। ৩ চার ও ২ ছক্কায় অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ২১ বলে করেন ৩৬ রান।
নাঈমের সঙ্গে তার তৃতীয় উইকেট জুটির সংগ্রহ ৪৭ বলে ৮৮ রান।
নাঈমের সেঞ্চুরি
৩১ বল বাকি থাকতে ক্রিজে গিয়ে হাত খুলতে সময় নেননি মাহিদুল ইসলাম। তৃতীয় বলে চার মারেন কিপার-ব্যাটসম্যান। মেহেদির ওই ওভারে নাঈমের ব্যাট থেকেও আসে দুটি বাউন্ডারি।
অষ্টাদশ ওভারে সাইফ উদ্দিনকে আবার বোলিংয়ে আনেন নাঈম। এই সুযোগের অপেক্ষায়ই যেন ছিলেন নাঈম। শুরু থেকেই এলোমেলো বোলিং করতে থাকা সাইফ উদ্দিন প্রথম পাঁচ বলে করেন একটি 'ওয়াইড' ও 'নো' ডেলিভারি।
এক বল পর আরেকটি 'নো' বল পেয়ে ছক্কা মেরে নব্বইয়ে পৌঁছে যান নাঈম। পরের দুই বল গড়িয়ে সীমানায় পাঠিয়ে তিনি টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৫৫ বলে।
পরে আকিফ জাভেদের বলে চার-ছক্কা মেরে দলের দুইশ পূর্ণ করেন মাহিদুল। শেষ ওভারে ইফতিখারের প্রথম বল ছক্কায় ওড়ান নাঈম। বাকি পাঁচ বলে আর বাউন্ডারি হয়নি। ১৫ বলে ২৯ রান করে ড্রেসিং রুমে ফেরেন মাহিদুল।
ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসে অপরাজিত থাকেন নাঈম। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে বেক্সিমকো ঢাকার হয়ে ৬৪ বলে ১০৫ রান করেছিলেন বাঁহাতি ওপেনার।
বিবর্ণ নাহিদ, খরুচে মেহেদি-সাইফ উদ্দিন
টুর্নামেন্টে দারুণ শুরু করে প্রথম পাঁচ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন নাহিদ। এরপর থেকে যেন উইকেটের সঙ্গে বিচ্ছেদ তার। টানা খেলার ধকলে বলের গতিও কমেছে অনেক। শুরুর মতো ব্যাটসম্যানদের মনেও ভয় জাগাতে পারছেন না তরুণ পেসার।
এই ম্যাচে ৪ ওভারে খরচ করেছেন ৩৮ রান, নেই উইকেট। এ নিয়ে টানা তিন ম্যাচে উইকেট পেলেন না নাহিদ। সবশেষ ছয় ম্যাচে তার উইকেট মাত্র একটি, ওভারপ্রতি রান খরচ সাড়ে নয়ের বেশি।
দেদার রান দিয়েছেন মেহেদি ও সাইফ উদ্দিন। ওভারপ্রতি ১৮.৩৩ রান খরচায় ৩ ওভারে ৫৫ রান দেন সাইফ উদ্দিন। বিপিএলে অন্তত ৩ ওভার বোলিং করা ইনিংসে এটিই সবচেয়ে খরুচে। গত আসরে রংপুরের বিপক্ষে খুলনার হয়ে ৩ ওভারে ৫৫ রান দিয়েছিলেন নাসুম আহমেদও।
৪ ওভারে ১ উইকেট নিতে মেহেদির খরচ ৪৬ রান। ১৭৩ ম্যাচের ক্যারিয়ারে এটিই তার সবচেয়ে খরুচে বোলিং। ২০২১ সালে নিউ জিল্যান্ড ও গত বছর ভারতের বিপক্ষে ৪৫ রান দিয়েছিলেন অফ স্পিনার।
শুরুতেই হোঁচট রংপুরের
দুই বিদেশি নিয়ে একাদশ সাজানো রংপুরের রান তাড়ার শুরুটা ভালো হয়নি। একাদশে ফেরার সুযোগ কাজে লাগতে ব্যর্থ তৌফিক খান। দ্বিতীয় ওভারে নাসুম আহমেদের বলে এলবিডব্লিউ হন তিনি।
নাসুমের পরের ওভারে চারের পর দুটি ছক্কা মেরে রানের চাকায় দম দেন সৌম্য। কিন্তু পঞ্চম ওভারে মোহাম্মদ নাওয়াজের সরাসরি থ্রোয়ে সাইফ হাসান রান আউট হলে আরও বাড়ে রংপুরের বিপদ।
পাওয়ার প্লেতে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৪৫ রান।
ইফতিখার-মেহেদির চেষ্টা
চার নম্বরে নেমে রানের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন ইফতিখার আহমেদ। তবে তেমন সফল হননি। অন্য প্রান্তে সৌম্যই সচল রাখেন রানের চাকা। অষ্টম ওভারে চারের পর ছক্কা মারেন ড্যাশিং ওপেনার।
পরের ওভারে মুশফিক হাসানের বল ছক্কায় ওড়ান ইফতিখার। এক বল পর ডিপ স্কয়ার লেগে নাঈমের চমৎকার ক্যাচে ড্রেসিং রুমে ফেরেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান (১৫ বলে ১৯ রান)।
পরে ক্রিজে গিয়ে আবু হায়দারের বলে দুটি চার ও একটি ছক্কা মারেন মেহেদি। নাওয়াজের স্পিনও ছক্কায় ওড়ান তিনি। কিন্তু টিকতে পারেননি। পরের বলেই মিরাজের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ১৪ বলে ২৭ রান করা মেহেদি।
এক বল পর সৌম্যকে একা করে দিয়ে ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন অধিনায়ক সোহানও।
সৌম্যর একার লড়াই
এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের একের পর এক বিদায় দেখা সৌম্য চতুর্দশ ওভারে পূর্ণ করেন নিজের পঞ্চাশ। আবু হায়দারের পরের বলেই তার ক্যাচ ছেড়ে দেন মিরাজ। তবে এর মাশুল তেমন দিতে হয়নি খুলনাকে।
জীবন পেয়ে আরও কিছু চার-ছক্কা মারেন সৌম্য। কিন্তু সেগুলো পরাজয়ের ব্যবধান কমানো ছাড়া আর কাজে লাগেনি।
সপ্তদশ ওভারে পরপর দুই বলে মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন ও আজিজুল হাকিমকে আউট করেন মুশফিক। সীমানা থেকে অনেকটা দৌড়ে সামনে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচে সাইফ উদ্দিনের বিদায় নিশ্চিত করেন নাঈম।
পরের বলে ফাইন লেগে ক্যাচ দেন আজিজুল। এ নিয়ে বিপিএলে সুযোগ পাওয়া চার ম্যচের তিনটিতে শূন্য রানে আউট হলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক। অন্য ম্যাচে তিনি করতে পারেন মাত্র ৫ রান।
ইনিংসের শেষ ওভারে হাসান মাহমুদের চমৎকার ইয়র্কারে বিদায়ঘণ্টা বাজে সৌম্যর। ৬ চার ও ৫ ছক্কায় ৪৮ বলে তিনি করেন ৭৪ রান।
মুশফিকের স্মরণীয় ফেরা
চোট কাটিয়ে প্রায় ৯ মাস পর এই ম্যাচ দিয়েই স্বীকৃত ক্রিকেটে ফেরেন মুশফিক। ম্যাচের ঘণ্টাখানেক আগে তাকে দলে নেওয়ার খবর আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় খুলনা। চমৎকার বোলিংয়ে নিজের ফেরা স্মরণীয় করে রাখেন তরুণ পেসার। ৪ ওভারে মাত্র ২৪ রানে তার শিকার ৩ উইকেট।
দারুণ বোলিং করেন হাসান মাহমুদও।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
খুলনা টাইগার্স: ২০ ওভারে ২২০/৪ (মিরাজ ২১, নাঈম ১১১*, রস ১২, বসিস্টো ৩৬, মাহিদুল ২৯, আবু হায়দার ১*; সাইফ উদ্দিন ৩-০-৫৫-০, মেহেদি ৪-০-৪৬-১, আকিফ ৪-০-৩১-১, নাহিদ ৪-০-৩৮-০, ইফতিখার ৪-০-৩৯-১, রকিবুল ১-০-১০-০)
রংপুর রাইডার্স: ২০ ওভারে ১৭৪/৯ (তৌফিক ৯, সৌম্য ৭৪, সাইফ হাসান ৬, ইফতিখার ১৯, মেহেদি ২৭, সোহান ০, সাইফ উদ্দিন ১৮, আজিজুল ০, রকিবুল ১৪, আকিফ ০*, নাহিদ ১*; আবু হায়দার ৪-০-৫৪-০, নাসুম ২-০-১৮-১, হাসান ৪-০-২০-১, মিরাজ ৪-০-৩৩-০, মুশফিক ৪-০-২৪-৩, নাওয়াজ ১-০-৮-২, আফিফ ১-০-১৬-০)
ফল: খুলনা টাইগার্স ৪৬ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: মোহাম্মদ নাঈম শেখ