প্রথম বলেই রাশিদ খানকে ছক্কা : সাড়ে ৮ কোটি রুপির ঝলক দেখালেন চেন্নাইয়ের ‘ডানহাতি রায়না’

আইপিএলে প্রথমবার ব্যাটিংয়ে নেমেই সামির রিজভি বুঝিয়ে দিলেন, কেন তাকে ৮ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে দলে নিয়েছে চেন্নাই সুপার কিংস আর কেন তাকে বলা হয় ‘ডানহাতি সুরেশ রায়না।’

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2024, 06:06 AM
Updated : 27 March 2024, 06:06 AM

উনিশতম ওভারের খেলা চলছে তখন। ঝড়ো ফিফটি করে মাত্রই আউট হলেন শিভাম দুবে। রবীন্দ্র জাদেজা কিংবা মাহেন্দ্র সিং ধোনির ব্যাটিংয়ে নামার অপেক্ষায় তখন চিদাম্বারাম স্টেডিয়ামের দর্শকেরা। কিন্তু ক্রিজে গেলেন সামির রিজভি! চমকের শেষ নয় সেখানেই। তরুণ এই ব্যাটসম্যান প্রথম বলেই স্লগ সুইপে ছক্কায় উড়িয়ে দিলেন টি-টোয়েন্টির সেরা বোলার রাশিদ খানকে। 

৩৩ হাজার দর্শকে ভরা চিদাম্বারামের গ্যালারি তখন উত্তাল। চেন্নাইয়ের ডাগ আউটে সবার তালি যেন থামছেই না। ধারাভাষ্যকক্ষে সাঞ্জায় মাঞ্জরেকার চিৎকার করে চলেছেন, “ব্যাট-বলের কী দারুণ সংযোগ… চিন্তা করে দেখুন, আইপিএলে প্রথমবার ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম বলেই এমন শট!” 

বয়স ২০। আইপিএল অভিজ্ঞতা শূন্য। কাঁধে অবিশ্বাস্য অঙ্কের পারিশ্রমিকের চাপ। সামনে রাশিদ। রিজভি তোয়াক্কা করলেন না কোনো কিছুর। প্রথম বলে ছক্কাতেই শেষ নয়, রাশিদের ওই ওভারের শেষ বলেও ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে দুর্দান্ত শটে ছক্কা মারলেন তিনি লং অফ দিয়ে। যেন ঘোষণা দিলেন, “আমি এসে গেছি…।” 

তারুণ্যের যে দুঃসাহস আর প্রতিভার যে দ্যুতি, প্রথম সুযোগেই তা দেখালেন রিজভি। কেন তাকে বলা হয় ‘ডানহাতি সুরেশ রায়না, কেন নিলামে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল, সবকিছুর খানিকটা ঝলক দেখালেন তিনি। 

নবীন এই তারকার প্রথম আইপিএল ইনিংস নিয়ে উচ্ছ্বসিত চেন্নাইয়ের ব্যাটিং কোচ ও সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান মাইক হাসি। 

“তার সহজাত সামর্থ্য দারুণ, বড় শট খেলার সহজাত সামর্থ্য। অনুশীলনে আমরা তা দেখেছি, বিশেষ করে স্পিনারদের বিপক্ষে সে দুর্দান্ত। সে অনেক দূরে বল পাঠাতে পারে এবং প্রতিটি বলই খুব পরিষ্কারভাবে হিট করতে পারে।” 

“তবে যত কিছুই বলি, তরুণ একজন ক্রিকেটার, আইপিএলে প্রথম বলেই মুখোমুখি হচ্ছে তর্কযুক্তভাবে সর্বকালের সেরা টি-টোয়েন্টি বোলার রাশিদ খানের এবং প্রথম বলেই তাকে ছক্কা মেরে দিচ্ছে, এটা চাট্টিখানি কথা নয়। স্রেফ পাগলাটে ব্যাপার, তাই না? আমরা তাকে নিয়ে দারুণ রোমাঞ্চিত।” 

তাকে ঘিরে রোমাঞ্চটা আগে থেকেই ছিল। তার দলের, ভারতীয় ক্রিকেটেরও। তার ওপর চেন্নাইয়েরর আস্থা প্রমাণ মিলেছে অবশ্য শুধু এই ম্যাচেই, সেই নিলাম থেকেই। গত ডিসেম্বরে আইপিএলের নিলামেই তিনি তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। আইপিএলে আগে কখনোই দেখা যায়নি যাকে, ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতেও যার অভিজ্ঞতা স্রেফ ১১ ম্যাচের, সেই ব্যাটসম্যানকে নিয়ে ঝড় ওঠে নিলামের টেবিলে। শেষ পর্যন্ত ৮ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে তাকে নিজেদের করে পায় চেন্নাই। প্রায় অচেনা একজন ক্রিকেটারের জন্য চোখধাঁধানো অঙ্কের পারিশ্রমিক। 

স্পিনের বিপক্ষে বড় শট খেলতে পারার দক্ষতা দিয়েই রিজভি মূলত নিজেকে আলাদা করে চিনিয়েছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। নিলামের মাস দুয়েক আগে সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফির এক ম্যাচে উত্তর প্রদেশের হয়ে ৪৬ বলে ৭৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তামিল নাড়ুর হয়ে, যেখানে প্রতিপক্ষে ছিলেন ভারুন চক্রবর্তী, সাই কিশোর, ওয়াশিংটন সুন্দারের মতো স্পিনাররা। 

তবে প্রথম সাড়া জাগিয়েছিলেন তিনি উত্তর প্রদেশ টি-টোয়েন্টি লিগে বিধ্বংসী ব্যাটিং করে। ৯ ম্যাচে দুটি সেঞ্চুরিতে ৪৫৫ রান করেছিলেন, তবে নজর কেড়েছিলেন মূলত টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরে। পরে উত্তর প্রদেশের অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে রাজস্থানের বিপক্ষে একটি একদিনের ম্যাচে ৬৫ বলে ৯১ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে দলকে জেতান ৫০ বলে ৮৪ রানের ইনিংস খেলে। 

আইপিএল দলগুলির স্কাউটদের চোখে পড়তে সময় লাগেনি খুব একটা। ১০টি ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকেই ট্রায়ালে ডাক পান তিনি। অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলার ব্যস্ততার কারণে স্রেফ তিনটির ট্রায়ালে তিনি যোগ দিতে পারেন-পাঞ্জাব কিংস, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ও রাজস্থান রয়্যালস। নিলামে তাকে নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর এত আগ্রহ ছিল এই কারণেই। 

উত্তর প্রদেশের মিরাটের ছেলে রিজভির ক্রিকেট শুরু সেই ছোট্টবেলায়। মামা ও ক্রিকেট কোচ তানকিব আখতারের হাত ধরে গিয়েছিলেন তার ক্রিকেট একাডেমিতে। মিরাটে রঞ্জি ট্রফির একটি ম্যাচ খেলতে গিয়ে সুরেশ রায়না ৫ বছর বয়সী রিজভির ফিল্ডিং দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে একটি সানগ্লাস উপহার দিয়েছিলেন। 

তখন কে জানত, একদিন রায়নার সঙ্গেই জুড়ে যাবে রিজভির নাম! 

ব্যাটিংয়ের ধরনে মিল থাকার কারণে উত্তর প্রদেশের ক্রিকেটে ‘ডানহাতি রায়না’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন রিজভি। উত্তর প্রদেশের টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে একটি আসরে সর্বোচ্চ রান করার পর রিজভির হাতে ‘অরেঞ্জ ক্যাপ’ তুলে দিয়েছিলেন সেই রায়নাই। 

অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যায় পর্যন্তও রিজভি ছিলেন ওপেনার। তবে স্পিন বোলিংয়ে বড় শট খেলার সামর্থ্যের কারণে এক কোচের পরামর্শে মিডল অর্ডারে নেমে আসেন তিনি। তার ক্যারিয়ারের বাঁক বদলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল সেটি। 

ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন তিনি ১৬ বছর বয়সেই। তবে টিকতে পারেননি মূল দলে। বিশ্বকাপ স্কোয়াডেও জায়গা পাননি। ১৬ বছর বয়সে রঞ্জি ট্রফিতেও অভিষেক হয়ে যায় তার। সেখানেও পারেননি থিতু হতে। তবে ক্রমেই তাই বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে উত্তর প্রদেশের ক্রিকেটের। 

সেই পথ ধরেই তিনি চলে আসেন আইপিএলে। চেন্নাই সাধারণত উঠতি ক্রিকেটারদের ওপর এত বেশি অঙ্কের বাজি ধরে না নিলামে। তরুণদের ম্যাচ খেলানোর ক্ষেত্রেও তারা অনেক সতর্ক। কিন্তু রিজভি যে বিশেষ প্রতিভা, সেটি অনুধাবন করেছে তারাও। নিলামে উচ্চমূলে তাকে দলে নেওয়ার পর এবার আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই তাকে একাদশে রাখা হয়। সেদিন তিনি ব্যাটিং পাননি। দ্বিতীয় ম্যাচেই প্রথম ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে সামর্থ্যের কিছুটা ঝলক তিনি দেখালেন। 

চেন্নাইয়ের ব্যাটিং কোচ মাইক হাসি জানালেন, স্পিনে ঝড় তোলার সামর্থ্যের কারণেই ধোনিদের আগে রিজভিকে নামিয়ে দেন তারা। 

“মাঠে নামতে রোমাঞ্চিত ছিল সে, বিশেষ করে এই চিপকে অসাধারণ দর্শকের সামনে। তারুণ্যের দারুণ ব্যাপারটিই এটি, মাঠে নামতে ও পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে খেলতে তাদের কোনো ভয়ডর নেই।”

“ম্যানেজমেন্টের দিক থেকেও এটা মাস্টারস্ট্রোক। কারণ, সবাই আশা করছিল এমএসডি (মাহেন্দ্র সিং ধোনি) মাঠে নামবে এবং ওরকম কিছু শট খেলবে। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট জানত যে, স্পিনের বিপক্ষে তার (রিজভি) সহজাত সামর্থ্য আছে এবং এজন্যই এই তরুণকে পাঠানো হয়। শেষ দিকে দুটি ছক্কা মেরেছে যা তার আত্মবিশ্বাসের জন্য দারুণ।” 

রিজভির ঝলকের দিনে গুজরাট টাইটান্সকে ৬৩ রানে হারায় চেন্নাই।