বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ
গতির ঝড় তুলে সাড়া জাগানো এই ফাস্ট বোলার শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেরও বড় সম্পদ হতে পারেন।
Published : 03 Dec 2024, 09:52 AM
বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রতিভাবান ক্রিকেটার অনেক এসেছেন। সম্ভাবনার মশাল বয়ে আবির্ভাব হয়েছে অনেকের। আশার ঝিলিক দেখিয়েছেন অনেকে। তবে নাহিদ রানার মতো কেউ আগে কখনও আসেননি। ফুল স্টপ!
জ্যামাইকা টেস্টের দ্বিতীয় দিনের একটি ওভার দিয়েই উদাহরণ দেওয়া যাক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের সেটি ত্রয়োদশ ওভার, নাহিদের তৃতীয় ওভার। প্রথম ডেলিভারির গতি ছিল ১৫০.১ কিলোমিটার। পরেরটির গতি ১৪৯.২। পরের তিন ডেলিভারির দুটি আবারও ছাড়িয়ে গেল দেড়শ কিলোমিটার। এক ওভারে তিন দফায় তো দূরের কথা, গোটা ক্যারিয়ারে এমন গতিতে বোলিং করা ফাস্ট বোলার কি আগে কখনও দেখেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট?
বাংলাদেশের একজন বোলার গতি আর বাউন্সে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের মনে কাঁপন ধরাচ্ছেন, ম্যাচের পর ম্যাচ গতি দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছেন, এমন কিছুও তো এ দেশের ক্রিকেটে অভূতপূর্ব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছেলেটিকে দেশের ক্রিকেটে ‘চাঁপাই এক্সপ্রেস’ নামে ডাকা হয় মাঝেমধ্যেই। জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপ সোমবার ধারাভাষ্যে বললেন, ‘বাংলাদেশ এক্সপ্রেস।’ যে নামেই ডাকা হোক, তার মূল পরিচয় ‘এক্সপ্রেস।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটে এরকম নাম অবশ্য প্রথম নয়। একজন মাশরাফি বিন মুর্তজা তো ক্যারিয়ারের শুরুতে প্রবল পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নামেই।
মাশরাফিও ছিলেন গতির মশাল বাহক। তখনও পর্যন্ত অমন গতির বোলার আর ছিল না বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই সময়টায় স্পিড গান এখনকার মতো সব ম্যাচে থাকত না। এত খুঁটিনাটি তথ্যও তখন রাখা হতো না। মাশরাফির সর্বোচ্চ গতি, গড় গতির শতভাগ সঠিক তথ্য তাই নেই। তবে ১৪৫ কিলোমিটারের আশেপাশে তিনি একসময় নিয়মিতই করতেন বলে ধারণা করা হয়। পরে তো বারবার চোটের থাবায় তিনি হয়ে গেলেন স্রেফ মিডিয়াম পেসার।
মাশরাফির পরপর এসেছিলেন আরেক গতিময় পেসার তালহা জুবায়ের। তার সম্ভাবনাও পূর্ণতা পায়নি চোটের আঘাতে। পরে গতির বার্তা নিয়ে এসেছেন রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমেদরা। তবে দেড়শ কিলোমিটার স্পর্শ করা তাদের কাছেও বরাবরই ছিল কিংবা আছে স্বপ্ন হয়ে।
নাহিদ এখানেই আলাদা। নাহিদ এখানেই অনন্য। নাহিদ এজন্যই সত্যিকারের রত্ন। শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেরই বড় সম্পদ।
এই শতাব্দীর শুরুর দিকে শোয়েব আখতার, ব্রেট লি ও শেন বন্ড নিয়মিতই দেড়শ কিলোমিটার গতি ছাড়াতেন। পরে গতির উৎসবে যোগ দেন শন টেইট। সেই সময়টায় দেড়শ কিলোমিটার গতিতে বল করাকে নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিলেন তারা। পরবর্তী সময়েও বেশ কজন বোলার এসেছেন এমন গতিময়। তবে এখন, এই সময়ে নিয়মিত দেড়শ কিলোমিটার ছাড়ানোর মতো বোলার খুব একটা নেই। নাহিদ আছেন।
গতিই তো শেষ কথা নয়। লাইন-লেংথ, স্কিলের সঙ্গে গতির সংযোগে উইকেট শিকারের কার্যকারিতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছোট্ট ক্যারিয়ারে সেই সাফল্যও দেখিয়েছেন নাহিদ। সেখানেও ছাপ রাখছেন ধারাবাহিক উন্নতির। অভিষেক টেস্টে দেখিয়েছিলেন। মাস তিনেক আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে দেখিয়েছেন। এবার জ্যামাইকায় দেখিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেটের স্বাদ পেয়ে গেলেন ২২ বছর বয়সী ফাস্ট বোলার।
১৬৪ রানের পুঁজি নিয়েও বাংলাদেশ যে ১৮ রানের লিড পেল, সেটির মূল কারণ নাহিদ। ৫ উইকেট নিয়ে তিনিই ভেঙে দেন ক্যারিবিয়ান ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড।
ঘরোয়া ক্রিকেটে গতির নমুনা দেখিয়ে আর উইকেট শিকারের প্রবণতা প্রমাণ করে গত মার্চে টেস্ট অভিষেক হয় তার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিলেটে সম্ভাবনার ঝলক কিছুটা দেখিয়ে দুই ইনিংস মিলিয়ে উইকেট শিকার করেন পাঁচটি। লাইন-লেংথে তখন অবশ্য একটু অগোছালো ছিলেন তিনি। সময়ের সঙ্গে উন্নতি হয় সেখানেও।
অগাস্টে পাকিস্তান সফরে প্রথম টেস্টে গতি দেখালেও কার্যকারিতায় সফল হননি। পরের টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে তার চার উইকেট ঘুরিয়ে দেয় ম্যাচের মোড়। মূলত ওই পাকিস্তান সফর থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটের নজর কাড়তে শুরু করেন তিনি। পরে ভারত সফরেও সেখানকার সংবাদমাধ্যমের তুমুল আগ্রহ ছিল তাকে নিয়ে।
গতি ব্যাপারটিই এমন, সবাইকে আকর্ষণ করবেই।
ভারতে একটি টেস্ট খেলে খুব ভালো কিছু তিনি করতে পারেননি। পারলেন এই জ্যামাইকায়।
এই সিরিজের প্রথম টেস্টে তাকে বিশ্রাম দিয়েছিল দল। তরতাজা ও চনমনে হয়ে এই টেস্টে নেমে তিনি ঘুম হারাম করলেন ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদের। গতিতে কাঁপন ধরিয়ে তিনি শিকার করলেন একের পর এক ব্যাটসম্যানকে।
তিনটি ডেলিভারিতে দেড়শ ছাড়ানো যে ওভারটি কথা বলা হলো, সেখানেই গতি দিয়ে মিকাইল লুইকে নড়বড়ে করে ওভারের শেষ বলে আউট করে দিলেন তিনি ১৪৭ কিলোমিটার গতির ডেলিভারিতে।
দ্বিতীয় দিনে ৯ ওভার বোলিং করে তার উইকেট ছিল একটিই। তবে কতবার যে ব্যাটসম্যানদের বিপাকে ফেললেন, পরাস্ত করলেন, সেসবের ইয়ত্তা নেই।
তৃতীয় দিন সকালে আবারও শুধু দারুণ বোলিংই করলেন না, এবার প্রাপ্য পুরস্কারও পেলেন। ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট ও কাভেম হজরা হিমশিম খেলেন তার গতির সামনে। বৈচিত্রও তো রপ্ত করতে শুরু করেছেন, সেটির প্রমাণ দিতেই যেন স্লোয়ার ডেলিভারিতে আউট করলেন আলজারি জোসেফকে।
নাহিদের বোলিংয়ে চেখে পড়ার মতো ব্যাপার এটিও। তরুণ গতিময় পেসাররা সাধারণত গতির নেশায় বুঁদ থাকেন। কিন্তু স্রেফ ছয় টেস্টের ক্যারিয়ারেই নাহিদ দেখিয়েছেন, ব্যাটসম্যান বুঝে বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংও করতে পারেন তিনি। স্রেফ একমুখি বোলার নন তিনি। লাইন-লেংথ আর নিয়ন্ত্রণে উন্নতির ছাপ রাখছেন তিনি নিয়মিতই।
গতিময় ও আগ্রাসী বোলারদের প্রভাব কখনও কখনও স্রেফ নিজের বোলিং পারফরম্যান্সের চেয়েও বেশি। অনেক সময় তারা ব্যাটসম্যানদের মনে ভয় ধরিয়ে দেন, সতীর্থ বোলারদের উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দেন, ম্যাচের পারিপার্শ্বিকতায় প্রভাব রাখেন নানাভাবে। এই ম্যাচেই যেমন, নাহিদের পঞ্চম শিকারে পরিণত হওয়ার আগে নাহিদের দুটি ডেলিভারি কিমার রোচের গায়ে লাগে।
সেই চোটের কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে শুরু থেকে মাঠে নামতে পারেননি রোচ। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ পেসার ও মূল সুইং বোলারকে নতুন বলে কাজে লাগাতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের দ্রুত রান তোলার কাজটি তাই সহজতর হয় নিশ্চিতভাবেই।
সত্যিকারের একজন ফাস্ট বোলার তাই স্রেফ কিছু সংখ্যা বা উইকেটের চেয়ে বেশি কিছু। সাদা চোখের দৃষ্টির চেয়েও তারা রঙিন।
অবশ্যই নাহিদের সামনে আরও কঠিন পরীক্ষা আসবে। শরীরের ওপর ধকল যাবে। চোট হানা দেবে। গতি ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ থাকবে। স্কিল শাণিত ও সমৃদ্ধ করার লড়াই চলবে। তাকে উপযুক্তভাবে সামলানোর কাজটিও যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে করতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে।
তবে, আপাতত বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে শিহরণ জাগানিয়া ব্যাপার বোধহয় এটিই যে, বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর উঠতি ফাস্ট বোলারদের একজন এদেশেরই, নাহিদ রানা!