ব্রিজবেনে ন্যাশনাল ক্রিকেট সেন্টারে আছে বিশ্বের সেরা সব সুযোগ-সুবিধা, যেখানে নিজেদের ঝালাই করেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা।
Published : 22 Oct 2022, 09:01 AM
একই শহরে একসঙ্গে বিশ্বকাপের ৮ দল। পর্যায়ক্রমে চলছে অনুশীলন। ক্রিকেট বিশ্বের সেরা সব অনুশীলন সুবিধা সব দলের জন্যই। সম্প্রতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অফিসিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচগুলির সময় ব্রিজবেনের চিত্র ছিল এটি। এতগুলি দলকে একসঙ্গে বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য এই সময়টায় বেছে নেওয়া হয়েছে ব্রিজবেনকে, যেটির কেন্দ্রে অ্যালান বোর্ডার ফিল্ড ও ন্যাশনাল ক্রিকেট সেন্টার (এনসিসি)।
কুইন্সল্যান্ড ক্রিকেটের সম্পদ অ্যালান বোর্ডার ফিল্ড। ঠিক এই মাঠ লাগোয়া এনসিসি কমপ্লেক্স, যেটি পরিচালনা করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। দুটি মিলিয়ে যা মেলে এখানে, এককথায় সেটিকে বলা যায় আদর্শ।
বাংলাদেশের প্রস্তুতি ম্যাচগুলি ছিল অ্যালান বোর্ডার ফিল্ডে। কুইন্সল্যান্ডের শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ, ঘরোয়া একদিনের ম্যাচের টুর্নামেন্টের ম্যাচগুলি হয় এখানে। মেয়েদের আন্তর্জাতিক ম্যাচের পাশাপাশি উইমেন’স বিগ ব্যাশের খেলা হয়। মাঠের এক পাশে অনুশীলনের সুবিশাল জায়গা, যেখানে দুই প্রান্তে ও মাঠের মাঝখানেও সারি সারি একের পর এক উইকেট। অনুশীলন নেটের সংখ্যা গুনে শেষ করা কঠিন!
যদি বৃষ্টি বাগড়া দেয়, তাহলে ছুট দিতে হয় মাঠের অন্য পাশে। যেখানে সগৌরবে দাঁড়িয়ে ন্যাশনাল ক্রিকেট সেন্টার কমপ্লেক্স। অনেকে হয়তো চট করে এই নাম শুনে পরিচয়টা বুঝে উঠতে পারবেন না। তবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের অনুসারী যারা, তাদের অবশ্যই জানা থাকার কথা অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ক্রিকেট একাডেমির কথা, একসময় যেটিকে ক্রিকেট বিশ্ব এক নামে চিনত ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ নামে। সেই একাডেমিরই বর্তমান রূপ ন্যাশনাল ক্রিকেট সেন্টার।
নব্বই দশক থেকে শুরু করে এই শতাব্দীর শুরুর দশকের অনেকটা সময় পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া যে ক্রিকেট বিশ্বে রাজত্ব করেছে, সেটির পেছনে বড় অবদান এই একাডেমির। অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস ও সেই সময়ের অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে অ্যাডিলেইডের উপকণ্ঠ হেনলি বিচে এটি প্রতিষ্ঠিত করা হয় ১৯৮৭ সালে।
তরুণ ক্রিকেটারদের ক্রিকেট স্কিল ঝালাই করার পাশাপাশি শৃঙ্খলা, জীবনবোধের শিক্ষা দিয়ে আদর্শ ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেওয়া হতো সেখানে। এই একাডেমির কয়েকজন গ্র্যাজুয়েটের নাম শুনলেই যে কারও কাছে পরিষ্কার হবে, কেন ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে এত নামডাক ছিল এই একাডেমির।
রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, গ্লেন ম্যাকগ্রা, মাইকেল বেভান, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, গ্রেগ ব্লিউয়েট, জেসন গিলেস্পি, ডেমিয়েন মার্টিন, মাইকেল স্ল্যাটার, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, ব্রেট লি, মাইকেল ক্লার্ক, মাইক হাসি, ডেভিড হাসি, শন মার্শ, শেন ওয়াটসন, ব্র্যাড হাডিন, ন্যাথান ব্র্যাকেন… তালিকা চলতেই থাকবে। বিশ্ব ক্রিকেটের আঙিনায় নিজেদের মেলে ধরার পথে তাদের পাথেয় ছিল এই একাডেমি।
একসময় বৃত্তি নিয়ে বিদেশি ক্রিকেটাররাও এখানে অনুশীলন করতেন। জিম্বাবুয়ের ডগলাস ম্যারিলিয়ার, মারি গুডউইন থেকে ভারতের সুরেশ রায়নাদের পা পড়েছে এই একাডেমিতে। শৃঙ্খলাজনিত কারণে এই একাডেমি থেকে বহিষ্কৃত হয়েও বড় খবরের জন্ম দিয়েছেন শেন ওয়ার্ন, ডেভিড ওয়ার্নার, অ্যারন ফিঞ্চরা।
সময়ের পরিক্রমায় সেই একাডেমির রূপ পাল্টেছে। বদলেছে অবস্থানও। অ্যাডিলেইড থেকে ২০০৪ সালে এটি চলে এসেছে ব্রিজবেনে বর্তমান ঠিকানায়। আগের মতো পূর্ণাঙ্গ সেই একাডেমি এটি নয়। বরং এটিকে গড়ে তোলা হয়েছে অত্যাধুনিক ও সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্র হিসেবে। অ্যালান বোর্ডার ফিল্ডে চলে মাঠের খেলা ও অনুশীলন। এনসিসি কমপ্লেক্সে ব্যবস্থা অসাধারণ ইনডোর সুযোগ-সুবিধার।
সেই সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অনেকটা ধারণা দিলেন এনসিসির ফ্যাসিলিট কো-অর্ডিনেটর কেভিন কেলা।
“অনেক কিছু আছে এখানে। অ্যাকুয়াটিক সেন্টারে হট ও কোল্ড সুইমিং পুল আছে, যেখানে আছে ১.২৫ মিটার ওয়াকিং লেন। ম্যাচ শেষে রিকভারির জন্য নেট ও জিম ফ্যাসিলিটি তো আছেই। ওপরের তলায় ৫টি লেইন আছে, নেট অনুশীলনের জন্য। প্রতিটিতেই বায়োমেকানিকস পরীক্ষার সুবিধা আছে, যা আইসিসি স্বীকৃত। বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা হয় এখানে।
“প্রায় পরিপূর্ণ জিম আছে এখানে। যেখানে পেশাদার অ্যাথলেটদের প্রয়োজন যেমন মেটে, তেমনি বাণিজ্যিক প্রয়োজনও মেটে।”
৫ লেইনের যে নেট সুবিধা, সেটিরও আলাদা বিশেষত্বের কথা জানালেন কেলা।
“পঞ্চম লেইনটি হলো পেস লেইন। এই উইকেট বাড়তি স্কিড ও বাউন্স করে। শুরুর লেইন হলো স্পিন লেইন, এখানে বল একটু গ্রিপ করে ও থমকে আসে। বাকি তিনটি লেইন সাধারণ, যেখানে আর্ম থ্রোয়ারে বা বোলিং মেশিন বা বোলারদের দিয়ে, নিয়মিত অনুশীলনগুলো করা যায়। সবকটি আর্টিফিশিয়াল টার্ফ উইকেট। ইনডোরে এর চেয়ে ভালো কিছু পাওয়া কঠিন।”
২০০৪ সালে এনসিসি এখানে আসার পর অ্যালান বোর্ডার মাঠের পাশে স্রেফ ছোট্ট একটি অফিস ছিল। ২০১৩ সালে সেখানে গড়ে তোলা হয় এখনকার এই সুবিশাল কমপ্লেক্স। ফ্যাসিলিটি কো-অর্ডিনেটর যেটিকে বলছেন, এক ছাদের নিচে সবকিছু।
“এটাকে বলতে পারেন ওয়ান স্টপ সলিউশন, সব আছে এখানে। বাইরে অনুশীলনের জন্য কুইন্সল্যান্ড ক্রিকেটের সুযোগ-সুবিধা আছেই। বৃষ্টি হলে আছে এই ইনডোর। সব মিলিয়ে আদর্শ জায়গা। মেলবোর্ন বা সিডনির মতো জায়গায় আবহাওয়া বিরূপ হলে অনুশীলন বাধাগ্রস্ত হয় অনেক। এখানে সেসবের বালাই খুব একটা নেই।”
“এই বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে ৮টি দল এখানে থাকল একসঙ্গে, সবগুলি দলকে খুব ভালোভাবে সার্ভ করা হয়েছে। এটা কেবল এখানেই সম্ভব।”
এছাড়াও এনসিসির তত্ত্বাবধানেই ব্রিজবেন শহরের অদূরে আছে ন্যাশনাল ক্রিকেট ক্যাম্পাস, যেখানে বিশাল তিনটি মাঠে বিভিন্ন ধরনের টার্ফ উইকেটের পাশাপাশি আছে অনুশীলনের নানা সুবিধা।
বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দল থেকে শুরু করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সব দল ও ক্রিকেটাররা এই সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে থাকে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ক্রিকেট দল, বধির দল, ব্লাইন্ড দলও এখানে অনুশীলন করে। এছাড়াও বাইরের যে কোনো ক্লাব বা দল কিংবা কোনো ক্রিকেটার ব্যক্তিগতভাবেও এখানে অর্থের বিনিময়ে অনুশীলন করতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যেই এখন একাডেমি আছে। তাই আগের সেই জাতীয় একাডেমি প্রয়োজন পড়ে না, আগের মতো সেই নামী গ্র্যাজুয়েটের তালিকাও তাই নেই। তবে ম্যাথু কেলা গর্ব নিয়ে শোনালেন কয়েকজনের কথা।
“মার্নাস লাবুশেন, অ্যালেক্স কেয়ারির মতো ক্রিকেটাররা নিজেদের হাত পাকিয়েছেন এখানেই। উঠতি ক্রিকেটারদের পাশাপাশি অনেক জাতীয় ক্রিকেটারও এখানে নিয়মিত অনুশীলন করেন। বিশেষ করে অফ-সিজনে অন্য রাজ্যগুলো থেকে ক্রিকেটাররা আসেন।”
বাংলাদেশের সেরা ইনডোর সুযোগ-সুবিধা মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে। স্রেফ ছাদের নিচে অনুশীলন করা ছাড়া আধুনিক ইনডোরের আর কোনো সুবিধা সেখানে নেই। এই এনসিসির ইনডোরের তুলনায় মিরপুরের ইনডোরকে বলা যায় স্রেফ গুদাম ঘর।
দুই দেশের ক্রিকেট অবকাঠামোর পার্থক্য বলতে শুরু করলে তা শেষ হবে না। তবে সেই এই এক ইনডোর সুবিধা থেকেই কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়, কেন ক্রিকেট বিশ্বে এই দুই দলের অবস্থানের পার্থক্য এমন আকাশ-পাতাল।