চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি
প্রায় আট বছর পর নতুন করে শুরু হচ্ছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পথচলা, বুধবার উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি পাকিস্তান ও নিউ জিল্যান্ড।
Published : 18 Feb 2025, 06:17 PM
ভেন্যু নিয়ে অনেক টানাপোড়েন, নানা বিতর্ক আর অনিশ্চয়তার পর অবশেষে দুয়ারে কড়া নাড়ছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। প্রায় আট বছর পর নতুন করে পথচলা শুরু হচ্ছে এই টুর্নামেন্টের। নবম আসরের প্রথম দিনে বুধবার করাচিতে উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক পাকিস্তানের মুখোমুখি হবে নিউ জিল্যান্ড। পরদিন দুবাইয়ে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত।
শিরোপার লড়াইয়ে কোন দল এগিয়ে, কার সম্ভাবনা কতটা, বাংলাদেশ যেতে পারে কতদূর, এসব নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে চলছে আলোচনা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে নিজেদের মতামত জানালেন বাংলাদেশের তিন সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান, হাবিবুল বাশার ও খালেদ মাসুদ এবং দুই সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর ও তালহা জুবায়ের।
তাদের চোখে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকার। বাংলাদেশের জন্য টুর্নামেন্টে কঠিন সময়ই অপেক্ষা করছে, মনে করেন এই সাবেক অধিনায়ক ও ক্রিকেটাররা।
আকরাম খান :
সম্ভাবনায় এগিয়ে চার দল
“আমার মনে হয়, এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত ও নিউ জিল্যান্ড বাকিদের চেয়ে তুলনামূলক এগিয়ে থাকবে। তারা শক্তিশালী দল। ভারত তো বরাবরই ভালো ক্রিকেটারদের নিয়ে যায়। ভালো ফর্মেও আছে। অস্ট্রেলিয়া হয়তো কয়েকজন ক্রিকেটারকে হারিয়েছে, তবু যারা আছে সবাই সামর্থ্যবান।”
“সাম্প্রতিক সময়ে নিউ জিল্যান্ড খুব ভালো করছে। মাত্রই পাকিস্তানে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতল ওরা। সব মিলিয়ে ওরা ভালো ছন্দে। সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকেও হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে। পাকিস্তানের কথাও বলা যায়। যেহেতু ঘরের মাঠে খেলবে। তবে তাদের আত্মবিশ্বাস কিছুটা কম মনে হচ্ছে।”
বাংলাদেশের সাফল্যের চাবি ব্যাটসম্যানদের কাছে
“বাংলাদেশের আমি খুব বেশি সম্ভাবনা দেখি না। প্রস্তুতি ম্যাচেও ভালো করতে পারেনি। আমার মনে হয়, ভালো করলে সর্বোচ্চ সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারবে। আমার আশা এটা।”
“দলকে ভালো করতে হলে ব্যাটিং বিভাগের অনেক ভালো করতে হবে। বেশ কিছু দিন ধরেই ব্যাটিংটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। দলের বোলিং ও ফিল্ডিং তুলনামূলক ভালো আছে। ব্যাটসম্যানরা পারফর্ম করতে পারছে না। তাদের অনেক উন্নতি করতে হবে। ব্যাটিংয়ে ভালো করতে পারলে দলের সম্ভাবনাটা বাড়বে।”
হাবিবুল বাশার
এগিয়ে ভারত, সম্ভাবনা আছে ইংল্যান্ড-নিউ জিল্যান্ডের
“চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সবসময় একটা সারপ্রাইজ নিয়ে আসে। বিশ্বকাপের চেয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চমকটা বেশি থাকে। তবে দল হিসেবে যদি দেখি ভারত খুব শক্তিশালী, ভারসাম্যপূর্ণ। ভালো ফর্মে আছে তারা। যতগুলো দল আছে এর মধ্যে ভারতীয় দলটাই এগিয়ে থাকবে।”
“ইংল্যান্ড দলও শক্ত দাবিদার। যদিও ভারতের কাছে (সিরিজ) হেরেছে। তবে তারা ভালো দল। নিউ জিল্যান্ড এবার মনে হচ্ছে শক্তিশালী। কদিন আগে ত্রিদেশীয় সিরিজও জিতল তারা। পাকিস্তানও থাকবে দৌড়ে। যদিও আগের বিশ্বকাপ ভালো যায়নি। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় লড়াইটা থাকবে ভারত, নিউ জিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে। এই তিনটা দলের ভালো সুযোগ থাকবে।”
বাংলাদেশের কঠিন পরীক্ষা
“বাংলাদেশ দলের জন্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটা খুব কঠিন হবে। এই গ্রুপটা খুব শক্তিশালী। দল একটু ফর্মহীনতায় ভুগছে। প্রস্তুতি ম্যাচটাও আমাদের তেমন সাহায্য করেনি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আমাদের ভালো কিছু করতে হলে এক্সট্রা অর্ডিনারি পারফরম্যান্স করতে হবে।”
“ব্যাটিং-বোলিং দুই দিকে আমাদের খুব ভালো করতে হবে। খুবই শক্ত একটা গ্রুপে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে। তাই সব মিলিয়েই ভালো খেলতে হবে। ব্যাটিংয়ের টপ-অর্ডার ভালো করলে বা বোলিংয়ে নির্দিষ্ট ধাপে ভালো করলে হবে না। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভালো কিছু করতে হলে দলগত পারফরম্যান্স লাগবে।”
খালেদ মাসুদ
শিরোপার দৌড়ে সবাই
“আমার মতে টুর্নামেন্টের ৮টা দলের যে কেউই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে থাকবে। প্রশ্ন আসতেই পারে যে, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানেরও সমান সম্ভাবনা আছে কি না। এক্ষেত্রে বলব, বাকি ছয় দলের চেয়ে তারা কিছুটা পিছিয়ে। বাকি ছয় দলকে দশে দশ দেব। বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান পাবে দশে আট। তবে ক্রিকেটে তো আসলে কাগজে-কলমের হিসেব চলে না।”
“গ্রুপ পর্বে মাত্র তিন ম্যাচ। দুটি জিতলে সেমি-ফাইনালে। এরপর তো নক-আউট। যে কোনো কিছুই হতে পারে। সাপলুডু খেলার মতো। কাটা পড়লে অনেকটা নেমে যেতে হবে। বড় দলের খারাপ দিনে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান বেশি ভালো খেলতে পারলে যে কোনো কিছুই সম্ভব। বড় দলগুলোর দশ যেদিন সাত-আট হবে আর বাংলাদেশ-আফগানিস্তান যদি আট থেকে দশে যেতে পারে, তাহলেই সব সমীকরণ বদলে যাবে।”
“তবু ফেভারিট চিন্তা করলে, অবশ্যই ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ড এগিয়ে থাকবে। নিউ জিল্যান্ড তো ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকা দলও খুব ভালো। তাদের হয়তো তেমন ট্রফি নেই। কিন্তু তাদের হারানো যে কোনো দলের জন্য কঠিন হবে। ইংল্যান্ড বা পাকিস্তানকেও বাদ দেওয়া যাবে না। পাকিস্তানের নিজের দেশেই খেলা।”
সম্ভাবনা কম বাংলাদেশের
“বাংলাদেশের সম্ভাবনা আসলে খুব কম। আমরা অনেক আবেগি। ভালো ভালো কথা বললে সবাই খুশি। কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে আমি বাস্তবতার কথা বলব। রিকি পন্টিং, এবি ডি ভিলিয়ার্সদের সঙ্গে একমত। বাংলাদেশের সম্ভাবনা খুব কম দেখি। তবে আশা করি, দোয়া করি তারা ভালো করবে। ভালো করার সম্ভাবনাও একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
“ব্যাটিং ভালো করতে পারলে সম্ভাবনা বাড়বে। বিপিএলে সব দলে এক-দুজন ভালো বোলার ছিলেন। তাই রান করতে বেশি চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়নি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সবাই মানসম্পন্ন বোলার। রান করা সহজ হবে না। মূল কাজটা তাই ব্যাটসম্যানদের করতে হবে। বোলিং বিভাগ নিয়ে তেমন চিন্তার কারণ নেই। তাসকিন-মুস্তাফিজের অভিজ্ঞতা, নাহিদ রানার গতি, স্পিনে মিরাজ-রিশাদ আছে। সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ। ব্যাটসম্যানরা রান করতে পারলে বোলাররা ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারবে।”
জাভেদ ওমর বেলিম
ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা-নিউ জিল্যান্ড এগিয়ে
“আমার মনে হয়, এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বোলিং খুব চ্যালেঞ্জিং হবে। বড় রানের খেলা হবে। তাই যারা বোলিংটা ভালো করতে পারবে, তাদের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আমার দৃষ্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং বাকিদের চেয়ে এগিয়ে আছে। অস্ট্রেলিয়া তুলনামূলক অনভিজ্ঞ আক্রমণ নিয়ে যাচ্ছে। তাদের স্পিনের ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে।”
“সব মিলিয়ে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউ জিল্যান্ডের সম্ভাবনা আমি বেশি দেখি। ভারত সব ম্যাচ যেহেতু দুবাইয়ে খেলবে, তাদের অনেক কিছুই চেনা। সাম্প্রতিক সময়ে ভালো ফর্মে আছে তারা। সবসময় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মানসিকতা নিয়ে নামে তারা। নিউ জিল্যান্ডও ভালো খেলছে। ত্রিদেশীয় সিরিজ জয় তাদের অনেক আত্মবিশ্বাস দেবে।”
বাংলাদেশের সামনে কঠিন সময়
“বাংলাদেশ যে লক্ষ্য নিয়ে গেছে, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট ভালো খেলে বিধায় সেই বিশ্বাসটা রাখতে চাই। তবে টুর্নামেন্টটা খুব কঠিন যাবে বাংলাদেশের জন্য। বোলিংটা ভালো করতে হবে। আমার বিশ্বাস ব্যাটিং ভালো করবে। ওয়ানডে হওয়ায় বেশি তাড়া নেই। আমাদের স্বাভাবিক ব্যাটিং করতে পারলেই হবে।”
“আরেকটা বিষয় হলো, বাংলাদেশ ঠিক গুছিয়ে যেতে পারেনি এবার। বিপিএলে পর্যাপ্ত ম্যাচ পায়নি নাজমুল হোসেন শান্ত। প্রস্তুতি ম্যাচটাও ভালো কাটেনি দলের। তবে পঞ্চাশ ওভারের খেলা হওয়ায় আসলে আশা রাখাই যায়। বাংলাদেশ যদি পরের পর্বে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অবশ্যই খুব কঠিন কাজ। গুছিয়ে খেলতে পারলে সম্ভব।”
তালহা জুবায়ের
সবাই সমান
“চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির চ্যাম্পিয়ন কারা হতে পারে, সেটা বলা মুশকিল। কারণ এই টুর্নামেন্টে সবগুলো দলই ভালো। কাউকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সবাই শক্তিশালী। সব দলকেই ভালো খেলতে হবে। বাকি সাত দলের চেয়ে যারা বেশি ভালো খেলতে পারবে, তারাই ট্রফিটা পাবে।”
“গ্রুপের খেলা, প্রথমে দুইটা ম্যাচ জিততেই হবে। এরপর সেমি-ফাইনাল। দল হিসেবে যদি সবাই ভালো খেলতে পারে, তাহলে ভালো ফল সম্ভব। কাগজে-কলমের হিসেবেও কাউকে ছোট করা যাবে না। বিশ্বকাপের মতো এখানে কয়েকটা তুলনামূলক দুর্বল দলও নেই। সব সেরা দলগুলো এখানে খেলবে। তাই বাকিদের চেয়ে ভালো খেলেই চ্যাম্পিয়ন হতে হবে।”
বাংলাদেশের সম্ভাবনা
“বাংলাদেশ দলের অবশ্যই সম্ভাবনা আছে। মুশফিক, মাহমুদউল্লাহর মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছে আমাদের দলে। মুস্তাফিজ-তাসকিনের মতো বোলার আছে। মিরাজ... যারাই আছে, তারা সবাই নিজেদের প্রমাণ করেছে। তানজিদ তামিম, সৌম্য খুব ভালো ফর্মে আছে। শান্ত হয়তো বিপিএলে ম্যাচ পায়নি, তবে মানসিক জায়গা থেকে ভালো অবস্থায় আছে।”
“সবাই ভালো ক্রিকেটার। এখন শুধু দেখার বিষয় হলো, নির্দিষ্ট দিনে আমরা কেমন ক্রিকেট খেলি, দল হিসেবে খেলতে পারি কিনা। দলগত পারফর্ম করতে পারলে, ইতিবাচক মানসিকতায় এগোতে পারলে অবশ্যই ভালো কিছু করতে পারব।”