৫ হাজার ছোঁয়ার দিনে মুশফিকের মন্থরতম সেঞ্চুরি

শরীর তাক করে আসা বল গ্ল্যান্স করে মুশফিকুর রহিম ছুটলেন রান নিতে। তবে বেশিক্ষণ ছুটতে হলো না, বলই পেরিয়ে গেল বাউন্ডারি। ব্যস, হয়ে গেল সেঞ্চুরি। বোলার আসিথা ফার্নান্দোর খুব কাছেই তখন মুশফিক। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত প্রবলভাবে বাড়িয়ে বোলারের দিকে তাকিয়ে তিনি ছুঁড়লেন হুঙ্কার। চোখ দিয়ে তখন যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে হচ্ছে আগুন।

ক্রীড়া প্রতিবেদকচট্টগ্রাম থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2022, 11:22 AM
Updated : 18 May 2022, 11:22 AM

ব্যাট-বলের লড়াইয়ের পাশাপাশি ফার্নান্দোর সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক একটি লড়াইও চলছিল মুশফিকের। সেই লড়াইয়ে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করতেই হয়তো তার অমন উদযাপন। তবে উদযাপন যতটা খ্যাপাটে হলো, তার ইনিংস কিন্তু ততটাই নিস্তরঙ্গ।

চট্টগ্রাম টেস্টের চতুর্থ দিনে প্রথম সেশনে একটি মাইলফলক ধরা দেয় তার। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৫ হাজার রান পূর্ণ করেন তিনি। ইনিংসটি শেষ পর্যন্ত থামে ২৮২ বলে ১০৫ রান করে।

এই ইনিংসের পথে সেঞ্চুরিতে পা রাখেন তিনি ২৭০ বলে। ৮১ টেস্টের ক্যারিয়ারে যা তার অষ্টম সেঞ্চুরি, সবচেয়ে ধীরগতির সেঞ্চুরি এটিই। ২০১৭ সালে ভারতের বিপক্ষে হায়দরাবাদে করা ২৩৫ বলের সেঞ্চুরি ছিল তার আগের সবচেয়ে মন্থর শতরান।

গোটা ইনিংসে তিনি বাউন্ডারি মেরেছেন স্রেফ চারটি। তার ক্যারিয়ারে আর কোনো সেঞ্চুরিতে এত কম বাউন্ডারি নেই।

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা এখনও পর্যন্ত টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন ৭১টি। শতরানের কোনো ইনিংসেই নেই এত কম বাউন্ডারি। ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১০১ রানের ইনিংসে মাহমুদউল্লাহও চারটি চার মেরেছিলেন, তবে সঙ্গে ছক্কাও ছিল দুটি।

বল আর বাউন্ডারির সংখ্যাই বলে দিচ্ছে, কতটা ধৈর্য নিয়ে তিনি ব্যাটিং করেছেন। ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন তিনি তৃতীয় দিনে। শুরু থেকেই ছিলেন ভীষণ সাবধানী। কোনো সুযোগই দেননি প্রতিপক্ষকে। নেননি সামান্যতম ঝুঁকিও। ফিফটি স্পর্শ করেন ১২৫ বলে। দিন শেষ করেন ১৩৪ বলে ৫৩ রান নিয়ে।

বুধবার চতুর্থ দিনেও তার ব্যাটিংয়ে দেখা যায় একই ধারা। আগের দিনের মতোই সতর্ক ব্যাটিংয়ে আঁকড়ে রাখেন উইকেট। ৬৮ রান পেরিয়ে যেতেই ৫ হাজারের ক্লাবে তিনি প্রবেশ করেন। তবে তার খেলার ধরনে তাতে পরিবর্তন আসেনি। একই মনোসংযোগে এগিয়ে যান সামনে। সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন দ্বিতীয় সেশনে।

সবশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে লাঞ্চের চার মিনিট আগে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে প্রবল সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন মুশফিক। তার রিভার্স সুইপ নিয়ে এই টেস্ট শুরুর আগেও ছিল আলোচনা। এই টেস্টে ৪৪৯ মিনিট উইকেটে থেকে রিভার্স সুইপ খেলেননি একটিও। এমনকি প্রিয় সুইপ শটও খেলেছেন কদাচিৎ।

তাকে প্রলুব্ধ করতে লঙ্কান স্পিনাররা বল ঝুলিয়ে দিয়েছেন, ঝুঁকি নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মুশফিক ফাঁদে পা দেওয়া তো বহুদূর, নিজের শৃঙ্খলার বৃত্ত থেকে নড়েননি একটুও। পেসাররাও চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। শর্ট বলে নাড়িয়ে দেওয়া, পুল খেলিয়ে ভুল করানোর চেষ্টা, অফ স্টাম্পের বাইরে শট খেলতে আহবান জানানো, ছিল এমন অনেক কিছুই। মুশফিক বের হননি নিজের ‘জোন’ থেকে।

কতটা আত্মনিয়ন্ত্রণ ছিল তার এই টেস্টে, তা কিছুটা বোঝা যাবে তার বাউন্ডারি শটগুলোর মাঝের বিরতি থেকে। প্রথম বাউন্ডারি মারেন তিনি ৩৪ বল খেলে। পরের বাউন্ডারি মারেন আরও ২৪ ওভার পর!

ফিফটির পথে বাউন্ডারি ছিল দুটিই। সেখান থেকে সেঞ্চুরিতে যেতেও বাউন্ডারি দুটি। দ্বিতীয় বাউন্ডারির পর তৃতীয়টি পেতে অপেক্ষা করেন তিনি ১৭ ওভারেরও বেশি। বুধবার প্রথম সেশনে বাউন্ডারি তার ওই একটিই। পরের বাউন্ডারি মারেন বিস্ময়কর লম্বা অপেক্ষার পর। ৩৯ ওভার বিরতির পর মারেন একটি বাউন্ডারি!

ওই বাউন্ডারিতেই পূর্ণ হয় সেঞ্চুরি। এরপর আসিথার চোখের সামনে সেই তেতে ওঠা উদযাপন। আসিথা অবশ্য ক্রীড়াসুলভ মানসিকতায়ই নিলেন ওই উদযাপন। লঙ্কান পেসার অভিনন্দন জানালেন তালি দিয়ে। পরে তার মুখে দেখা গেল চওড়া হাসি।

সেই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন অঙ্ক ছুঁয়েছিলেন। এরপর ১৮ ইনিংস পর পেলেন আরেকটি টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ। অপেক্ষার পালা শেষ হওয়ার ব্যাপার তো ছিলই। সঙ্গে সাম্প্রতিক নানা সমালোচনা-বিতর্ক আর প্রতিকূল হাওয়ার মধ্যে একটু সুখ ছোঁয়া হয়েও এলো এই ইনিংস। তার মুখে চওয়া হাসি তো থাকারই কথা!