শেন ওয়ার্নের চেয়ে আমি এক জায়গায় এগিয়ে : হগ

গত দশকে অস্ট্রেলিয়ার অসাধারণ দলটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, চায়নাম্যান বোলিং নামক কঠিন শিল্পের সম্ভবত সবসময়ের সেরা বোলার। দুটি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার অপরাজেয় শিরোপায় যার ছিল বড় অবদান, রঙিন পোশাকে অস্ট্রেলিয়াকে বুঝতে দেননি শেন ওয়ানের্র শূন্যতা। সেই ব্র্যাড হগ বিপিএলে এসেছেন ধারাভাষ্য দিতে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া দীর্ঘ একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক স্পিনার কথা বললেন অস্ট্রেলিয়ার অপ্রতিরোধ্য সেই দল, দুটি বিশ্বকাপ জয়, ওয়ার্নের ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়া ও চায়নাম্যান বোলিংয়ের নানা দিক নিয়ে….

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2019, 08:04 AM
Updated : 29 Dec 2019, 11:59 AM

খেলোয়াড়ি জীবনে আপনাকে মাঠে দেখা গেল দারুণ প্রাণবন্ত। এখন ধারাভাষ্যেও তেমন দেখা যায়। আপনার জীবন দর্শনই এমন?

হগ:  দেখুন, ক্রিকেট খেলাটা আমি ভালোবাসি। ক্রিকেটে যা কিছুই করি, হৃদয় দিয়ে করি। জীবনের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। যা করতে ভালো লাগে, সেটিকেই আমি জীবিকা হিসেবে নিতে পেরেছি, এখনও সেই জগতেই আছি। আমি ঘুরতে পছন্দ করি। ক্রিকেট আমাকে সেই সুযোগও করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে, খুব কম লোকই এতটা ভাগ্যবান হয়। প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করি। সেটিই আমার কথায়, আচরণে প্রকাশ পায়।

এখনও পর্যন্ত এবারের বিপিএলের অভিজ্ঞতা কেমন?

হগ: অসাধারণ। সবচেয়ে ভালো লাগছে এত সব তরুণ ক্রিকেটারকে দেখে। অনেককেই আমি প্রথম দেখছি এবং চমকে গেছি। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে যেতে দেখতে ভালো লাগছে। এত প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের দেখে আমি রোমাঞ্চিত, বাংলাদেশের ক্রিকেটের রোমাঞ্চের কারণ আছে যথেষ্টই।

চট্টগ্রামে খেলা আমি দারুণ উপভোগ করেছি। শুধু রান হয়েছে বলেই নয়। উইকেট সেখানে বেশ প্রাণবন্ত ছিল। গতিময় ছিল, বাউন্স ছিল। বাংলাদেশের উচিত, ওই ধরনের উইকেটে বেশি খেলা। এসব উইকেটে নিয়মিত খেললে দেশের বাইরে ভালো খেলবে বাংলাদেশ।

প্রথম বিপিএলে আপনি খেলেছিলেন, পারফরম্যান্স যদিও খুব ভালো ছিল না (সিলেট রয়্যালসের হয়ে ৭ ম্যাচে ৩ উইকেট)। কতটা মনে পড়ে?

হগ: খুব ভালো যে করিনি, মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ (হাসি)। সত্যি বলতে, আমি উপভোগ করেছিলাম। যেটা বললাম, ঘুরতে ভালো লাগে আমার। ক্রিকেট খেলার জন্য দুনিয়া জুড়ে ঘুরতে আমার আপত্তি নেই। আর ক্রিকেটার হিসেবে আমরা চ্যালেঞ্জ পছন্দ করি। বিদেশি কন্ডিশনে, স্পিন ভালো খেলে এমন জায়গায় খেলাটা চ্যালেঞ্জিং। স্কিলের পরীক্ষাও।

ভালো মানের চায়নাম্যান বোলার ক্রিকেট খুব বেশি দেখেনি। চাক ফ্লিটউড-স্মিথ ও ডেভিড সিনকক ছিলেন আপনার দেশের, জনি ওয়ার্ডল ও স্যার গ্যারি সোবার্স অর্থোডক্সের পাশাপাশি চায়নাম্যান করতেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনশান আলি ও ডেভ মোহাম্মেদ কিছুদিন খেলেছেন, পরে পল অ্যাডামস, এখনকার কুলদীপ… সর্বকালের সেরা সেরা চায়নাম্যান কি ব্র্যাড হগ?

হগ:  নাহ, অবশ্যই না। আরও ভালো নিশ্চয়ই ছিল…

ছবি: বিসিসিআই।

আপনিই তো সফলতম। আপনার ১৮০ উইকেটের চেয়ে বেশি আর কেউ পায়নি…

হগ:  আমি জানি না। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মোটামুটি লম্বা সময় খেলেছি। দলে অবদান রেখেছি। তাতেই খুশি। আর সত্যি বলতে, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স তো আছেই। তবে দিনশেষে, দলের সাফল্যই শেষ কথা। অস্ট্রেলিয়া দলে, বিগ ব্যাশে পার্থ স্কর্চার্সের হয়ে যে সাফল্য আমি পেয়েছি, সেসবই বড় প্রাপ্তি। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ জয়, দুটি বিশ্বকাপ জয়, এসবের চেয়ে তৃপ্তির কিছু নেই।

চায়নাম্যান বোলারদের সবসময়ই বড় চ্যালেঞ্জ বলের ‘কন্ট্রোল।’ কিন্তু আপনার নিয়ন্ত্রণ তো অসাধারণ ছিল। কিভাবে আয়ত্ত করেছিলেন?

হগ:  পরিশ্রম, পরিশ্রম, পরিশ্রম...। নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ওভারের পর ওভার বোলিং, সিম্পল! দলের অনুশীলন নেই? নিজেই করেছি। টার্গেট রেখে বোলিং করেছি। শুধু কষ্ট করে গেলেই হবে না, অর্থপূর্ণ অনুশীলন করতে হবে। একটা একটা করে অস্ত্র নিজের বোলিংয়ে যোগ করতে হবে। নেটেও নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যতটা সম্ভব, ম্যাচের মতো করেই বোলিং করতে হবে। নিজেকে চাপে রাখতে হবে। এভাবেই আমি উন্নতি করেছি।

আপনার ফ্লিপার ও রং আন ছিল অসাধারণ। কঠিন এই শিল্প কিভাবে রপ্ত করেছিলেন?

হগ:  লোকে বলে এটা কঠিন শিল্প। তবে সত্যিকার অর্থে পরিশ্রম করলে, ধারাবাহিকভাবে কাজ করলে এবং সেটি উপভোগ করলে, একটা পথ বের হয়েই যায়। আমার যেমন হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট ব্যাপারটিই এমন। শুধু ক্রিকেট নয়, যে কোনো কাজই। সত্যিই করতে চাইলে, যত কঠিনই হোক, আয়ত্ত করা সম্ভব। কোচদের সঙ্গে খেটেছি, নিজে কাজ করেছি, আমার পথ বের হয়ে গেছে। রিস্ট স্পিন সাধনার ব্যাপার। সাধনা করেই পেয়েছি, যা কিছু পেরেছি।

ফ্লিপারের প্রসঙ্গ যখন এলোই, ২০০৩ বিশ্বকাপে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে বোল্ড করা সেই ফ্লিপারটি আপনার ক্যারিয়ারের সেরা ডেলিভারি? অ্যান্ডির মতো স্পিনে দারুণ দক্ষ ব্যাটসম্যানও পুরো বোকা বনে গিয়েছিলেন!

হগ: নাহ, ওটা আমার দ্বিতীয় সেরা ডেলিভারি। সেরা ডেলিভারিতে আউট করেছিলাম ব্রায়ান লারাকে। কিন্তু আম্পায়ার আউট দেননি!

২০০৩ বিশ্বকাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এক ম্যাচে ছিল সেই ডেলিভারি। দারুণ এক ব্যাক স্পিন ডেলিভারি। নিশ্চিত এলবিডব্লিউ ছিল লারা। আম্পায়ার দেয়নি। ওই ডেলিভারির পর থাকবে অ্যান্ডিরটা। 

২০০৭ বিশ্বকাপে অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফকে আউট করা ডেলিভারিও ভোলার নয়। দুর্দান্ত এক রং আনে তাকে একবার বোকা বানানোর পরের ডেলিভারিতে আবার রং আনে স্টাম্পড…

হগ: ব্যাটসম্যানকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই! ফ্রেডির উইকেটে সেই মজা পেয়েছিলাম। পরপর দুটি রং আন হয়তো সে ভাবতেও পারেনি। ফ্রেডি অনেকবারই আমাকে ছক্কায় উড়িয়েছে। রং আনেও মেরেছে। সেদিন ওকে চিন্তায় হারিয়ে দেওয়াটা ছিল দারুণ।

ক্রিকেট খেলার মজাই এটা। আজ সে জিতবে তো কাল আমি। তবে সেই লড়াইয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে।

২০০৩ বিশ্বকাপ দিয়েই আপনার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে গেল। অথচ সেই বিশ্বকাপে আপনি ছিলেন রিজার্ভ স্পিনার, দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনে ম্যাচ খুব বেশি খেলার কথা ছিল না। শেন ওয়ার্ন ড্রাগ নিয়ে নিষিদ্ধ হওয়ার পর আচমকা আপনি মূল স্পিনার হয়ে গেলেন। ওই ধাক্কায় দলের অবস্থা কেমন ছিল? হঠাৎ বড় দায়িত্বে আপনার মানসিক অবস্থা ছিল কেমন?

হগ: ওয়ার্নির ওই ঘটনা নিয়ে আমি খুব গভীরে যেতে চাই না। জীবনে অনেক কিছুই ঘটে। আমরা কেউই চাই না কারও জীবনে অমন কিছু হোক। অবশ্যই একটা ধাক্কা ছিল দলের জন্য। তবে টুর্নামেন্টের ফলই বলছে, আমরা সেই ধাক্কা সামাল দিয়েছিলাম!

ছবি: বিসিসিআই।

আমার কথা বললে, বিশ্বকাপে যখন গিয়েছি, খেলার আশা তো ছিলই। সত্যি বলতে, প্রথম ম্যাচে (পাকিস্তানের বিপক্ষে) আমাদের দুজনেরই একসঙ্গে খেলার কথা ছিল। ম্যাচের আগের ঘটনায় আমিই একমাত্র স্পিনার হয়ে গেলাম। দায়িত্বটা বেড়ে গেল, এই তো!

আমরা অস্ট্রেলিয়ানরা সবসময় চ্যালেঞ্জের জন্য মুখিয়ে থাকি। আমিও মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। চাপ তো ছিলই। তবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, চাপকে পেয়ে বসতে না দেওয়া।

অধিনায়ক রিকি পন্টিং বা কোচ জন বুকানন বিশেষ কিছু বলেছিল আপনাকে?

হগ: বিশেষ কিছু না। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে যখন ছিলাম, তার মানে আমার সেই যোগ্যতা ছিল। আমার স্কিলে দলের ভরসা ছিল। আমরা দারুণ পেশাদার দল ছিলাম, সবাই নিজেদের করণীয় জানতাম। পান্টার স্রেফ বলেছিল, ‘গুলিয়ে ফেলো না।’ মানে নিজের কাজটা যেন করতে পারি। সৌভাগ্যবশত, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছিলাম আমি।

বিশ্বকাপে ১৩ উইকেট নিলেন, টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সফলতম স্পিনার (মুরালিধরনের ছিল ১৭ উইকেট)। বিশ্বকাপের পরেও আপনার পারফরম্যান্স দেখেই হয়তো অস্ট্রেলিয়া বুঝে গেল, ওয়ানডেতে ওয়ার্নকে খেলানো আর আবশ্য প্রয়োজনীয় নয়!

হগ: হতে পারে। ওয়ার্নি তো এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরেই নিজের জাত দেখাল। ফেরার পর প্রথম দুই টেস্টেই ১০টি করে মোট ২০ উইকেট (শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে)। ওর টেস্ট ক্যারিয়ার আরও লম্বা করার জন্যই হয়তো ওয়ানডের ভার থেকে মুক্তি দিয়েছিল দল।

ওই বিশ্বকাপে থেকে আপনি ওয়ানডেতে নিয়মিত হয়ে গেলেন। ওই দলে খেলার অনুভূতি কেমন ছিল। গিলক্রিস্ট-হেইডেন-পন্টিং-মার্টিন-সাইমন্ডস-লি-ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি…তারকার শেষ ছিল না দলে!

হগ: দেশকে বিশ্ব পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করাই অনেক বড় ব্যাপার। আমি আরও বেশি সৌভাগ্যবান, অমন একটা অপ্রতিরোধ্য দলে খেলেছি। কী দাপুটে ক্রিকেটই না আমরা খেলেছি!

আমার মনে হয় না, ওই ১৫ বছরে অস্ট্রেলিয়া যা খেলেছে, তার চেয়ে ভালো অস্ট্রেলিয়া দল ছিল। দুটি বিশ্বকাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন, ম্যাচের পর ম্যাচ জয়। টেস্টেও দুই দফায় টানা ১৬ জয়ের বিশ্বরেকর্ড, ভারত-শ্রীলঙ্কায় সিরিজ জয়, কী করেনি ওই দল! স্যার ডনের ‘ইনভিন্সিবল’ দলটির (১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ড সফরের সর্বজয়ী দল) কথা বলতে পারেন। তবে আমাদের সময়ের দলটা সত্যিই ছিল স্পেশাল। একসঙ্গে এত অসাধারণ ক্রিকেটার, কয়টা প্রজন্মে আসে!

একটা বড় ব্যাপার হলো ছাপ রেখে যাওয়া। নিজে ক্রিকেটার হিসেবে, দলগতভাবে। আমাদের দলটা যেমন ছাপ রেখেছিল, আমরাও চেষ্টা করেছি রাখতে।

মাঠের সাফল্যের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল মাঠের বাইরের সময়। দারুণ সব সময় কেটেছে আমাদের। অসংখ্য স্মৃতি জমা হয়েছে। 

ড্রেসিং রুমে সবচেয়ে বেশি মজা কে করতেন? ড্রেসিং রুমের ‘জোকার’!

হগ:  জিমি মা’র (সাবেক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান) যতদিন খেলেছেন, দুষ্টুমিতে তাকে ছাড়াতে পারেনি কেউ। অ্যান্ডি বিকেল আরেকজন, দেখে বোঝা যেত না কতটা মজাপ্রিয়। অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস তো ছিলই। তিনজনই কুইন্সল্যান্ডের, একসঙ্গে হলে সে একটা ব্যাপার হতো!

ওই দলের সবাই ছিল আলাদা চরিত্র। এজন্যই ড্রেসিং রুম আরও বেশি প্রাণবন্ত ও বৈচিত্র্যময় ছিল। 

কোচ হিসেবে বুকাননকে নিয়ে অনেক ধরনের মত প্রচলিত আছে। কাগজে-কলমে সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম কোচ তিনি। তবে অনেকেই বলেন, সেটি কেবল ওই দলের ক্রিকেটারদের কারণেই। অনেকেই তাকে কোচ হিসেবে পাত্তা দেন না, যেমন স্বয়ং শেন ওয়ার্ন!

হগ:  আমার কাছে, বুকানন কোচ হিসেবে ছিলেন খুব ভালো। অবশ্যই এক ঝাঁক অসাধারণ ক্রিকেটার ছিল দলে। তবে সেই তারকাদের চ্যালেঞ্জ করার মতো একজন কাউকে দরকার ছিল। তাদেরকে একাট্টা করা, মসৃণভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা, গুছিয়ে রাখার মতো কাউকে দরকার ছিল। বুকানন যা খুব ভালোভাবে করেছেন।

এমন কিছু সময় এসেছে, আমরা একটা সংশয়ে পড়েছি। হয়তো টানা দুটি ম্যাচ হেরেছি, দ্বিধার জন্ম নিয়েছে, বুকানন সেসব মুছে দিতেন নিমিষেই। কোথাও ছন্দপতন হলে দ্রুত ধরে ফেলতেন। সমাধান বের করতেন।

সেদিক থেকে বুকানন দারুণ কোচ ছিলেন। আমি অবশ্য কোচের চেয়ে তাকে বলব ‘ম্যান ম্যানেজার।’ ওই দলে আসলে এমন একজনকেই দরকার ছিল। সেই কাজটি বুকানন অবিশ্বাস্য সফলতায় করেছেন।

২০০৭ বিশ্বকাপে দলের মূল স্পিনার হিসেবেই গেলেন। অসাধারণ পারফর্ম করলেন (২১ উইকেট, এবারও তার বেশি উইকেট নেওয়া স্পিনার ছিলেন কেবল মুরালিধরন, ২৩ উইকেট)। উইকেট নিয়েছেন, ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছেন, ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং কি ওই বিশ্বকাপেই করেছিলেন?

হগ:  নাহ, ২০০৩ বিশ্বকাপেই সেরা বোলিং করেছি। মূল কারণ, তখন চাপটা ছিল প্রবল। চ্যালেঞ্জ ছিল কঠিন। দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে বোলিং করাও সহজ ছিল না। ২০০৭ বিশ্বকাপ নাগাদ আমি দলে প্রতিষ্ঠিত, অনেক কিছু বুঝে ফেলেছি,। নিজের ওপর বিশ্বাস প্রবল। ক্যারিবিয়ানের উইকেটে স্পিনারদের জন্য সহায়তাও ছিল। আর অনেক অভিজ্ঞও ছিলাম তখন, কঠিন পরিস্থিতিগুলো সামলাতে শিখে গেছি। ২০০৩ বিশ্বকাপে অতটা পোক্ত ছিলাম না। সেই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের মূল্য তাই আমার কাছে বেশি। 

তবে একটা কথা, ওয়ার্নি যতই কিংবদন্তি হোক, ওর চেয়ে কিন্তু একটা জায়গায় আমি এগিয়ে। ও একটি বিশ্বকাপ জিতেছে, আমি দুটি…হাহাহাহাহা। জোকস অ্যাপার্ট, আমি এই অর্জনে দারুণ গর্ব খুঁজে পাই। দুটি বিশ্বকাপ খেলেছি, একটি ম্যাচও হারিনি। কজনের এমন সৌভাগ্য হয়!

২০০৮ সালে অবসরের পর ২০১১ সালে বিগ ব্যাশ দিয়ে বিস্ময়করভাবে ক্রিকেটে ফিরলেন ৪০ বছর বয়সে। অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি দলেও ফিরে খেললেন ২০১২ ও ২০১৪ বিশ্বকাপ। ফেরা নিয়ে অনেকবারই অনেক কথা বলেছেন আগে। তার পরও আবার পেছন ফিরে তাকিয়ে, ভাবনাটা কি ছিল?

হগ: ওই সময়টায় আমার ডিভোর্স হয়ে গেল। নতুন সঙ্গিনী পেলাম। আমার মানসিক অবস্থা দেখেই হয়তো সে বললো গ্রেড ক্রিকেটে খেলতে। পার্থে গ্রেড ক্রিকেট খেলতে থাকলাম। সেখানে পারফরম্যান্স দেখেই হয়তো বিগ ব্যাশে পার্থ স্কর্চার্স আগ্রহ দেখাল। আামি দ্বিতীয়বার ভাবিনি। উপভোগ করছিলাম খেলা। আরেকটি অধ্যায় শুরু করলাম!

২০০৮ সালে অবসর নেওয়ার সময়ও আসলে আমি নিতে চাইনি অবসর। ওয়ার্নি তখন অবসরে, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল ইনজুরিতে। পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট দলে আমাকেই হয়তো মূল স্পিনার হিসেবে রাখা হতো। পরের বছর অ্যাশেজেও চোখ ছিল আমার। কিন্তু পারিবারিক জীবনে জটিলতা দেখা দিল। বিয়েটা বাঁচাতে চেয়েছিলাম, তাই ক্রিকেট ছেড়ে দিলাম।

কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। ডিভোর্স হয়ে গেল। এটাই জীবন। সবসময় ভাবনামতো সবকিছু হয় না। হয়তো ক্রিকেটের কাছে আমার পাওনা ছিল কিছু। এজন্যই তিন বছর পর আবার ফিরতে পেরেছিলাম।

পার্থের গ্রেড ক্রিকেটে আপনার ২৮৫ রানের রেকর্ড ইনিংস ছিল একসময় !

হগ:  একসময় আমি তো ব্যাটসম্যানই ছিলাম। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট তো মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেই শুরু করেছিলাম। পরে টনির (সাবেক অস্ট্রেলিয়ার লেগ স্পিনার টনি মান) পরামর্শে বোলিংয়ে মনোযোগ দিলাম।

গ্রেড ক্রিকেটের রেকর্ডটি ২০০১ সালে মনে হয়। তবে ততদিনে পুরোদস্তুর বোলার হয়ে গেছি।

অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি দলে ফিরলেন ৪১ বছর বয়সে। তখন বলেছিলেন, নিজের কাছে আপনার বয়স ২১ বছর। এখন তো বয়স ৪৯ ছুঁইছুঁই, আপনার নিজের কাছে কত?

হগ: এখনও ২১! অন্তত আমার ভাবনায় আমি এখনও ২১। আমি বিশ্বাস করি, চাইলে এখনও খেলে যেতে পারি। ফিটনেস খুব খারাপ নয়। গত বছরও তো খেলেছি বিগ ব্যাশে। থামতে হয় বলেই থেমেছি।

মাত্র ৭টি টেস্ট খেলেছেন, টেস্ট ক্রিকেটের সাফল্য কেন মরীচিকা হয়ে থাকল আপনার কাছে?

হগ:  টানা লম্বা সময় খেলতে পারিনি। খেলতে পারার কথাও নয়। ওই সময় ওয়ার্নি ও ম্যাকগিল ছিল। আমার সুযোগ কিভাবে হবে!

টেস্ট অভিষেক হলো ভারতে (ওয়ার্নের ইনজুরির কারণে, ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে)। স্পিনে দক্ষ ভারতীয়দের সামনে নবীন বোলারের কাজটা ছিল কঠিন। অভিষেকের পরে আবার টেস্ট খেলেছি ৭ বছর পর। সেই বছর তিনটি খেলে আবার চার বছর পর তিনটি। শেষবার আবার ভারতের বিপক্ষে। সব মিলিয়ে কঠিন ছিল। তার পরও হয়তো আরেকটু চেষ্টা করতাম। সুযোগও ছিল। কিন্তু ওই যে পারিবারিক সমস্যা, আর হলো না।

পার্ট টাইম চায়নাম্যান বোলার মাইকেল বেভানও টেস্টে ১০ উইকেট নিয়েছেন!

হগ:  হাহাহাহাহা… আমার চেয়ে ভালো রেকর্ড! সত্যি বলতে, ওর কিন্তু বোলার হিসেবে সম্ভাবনা ছিল। ভালো টার্ন করাত। দল থেকে বেভকে বলত বোলিং আরও বেশি অনুশীলন করতে। কিন্তু ও ব্যাটিংই বেশি করত। বড় ভুল করেছে, বোলিংটা ভালো করলে আমার জায়গা নিতে পারত (হাসি)!

পার্ট টাইমার হিসেবে পরে সাইমন ক্যাটিচও ভালো সার্ভিস দিয়েছে।

আপনার শেষ টেস্ট সিরিজে বড় একটা বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। সিডনি টেস্টে অনিল কুম্বলে ও মহেন্দ্র সিং ধোনিকে কটুকথা বলেছিলেন বলে অভিযোগ করেছিল ভারতীয় বোর্ড। নিষেধাজ্ঞার খাড়ায় ছিলেন। আক্ষেপ হয় এখন?

হগ:  একটুও নয়! ভুল তো আমার নয়, আম্পায়ারের ছিল! আমি বোলিং মার্কে ছিলাম। ভারতীয়রা কৌশল নিয়েছিল দেরি করার। ব্যাটিংয়ের জন্য প্রস্তুত হতে অনেক দেরি করছিল, আমাকে অস্থির করে তোলার জন্য। বারবার একই কাজ করছি। অনেক সময় নষ্ট হচ্ছিল। আমি গিয়ে আম্পায়ারকে বলেছিলাম, পরিস্থিতি সামাল দিতে, দায়িত্ব তো তার! তাছাড়া, আমরা ওভার রেটে পিছিয়ে পড়ছিলাম।

ছবি: আইসিসি।

আম্পায়ার সামাল দিতে পারেননি। আমিও বাজে কথা বলে ফেলেছিলাম। কাউকে আঘাত করার জন্য নয়, সরাসরি আক্রমণ করেও নয়। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো, নিজের হতাশা থেকেই। ওরা আমার ছন্দ নষ্ট করতে চেয়েছিল, সফলও হয়েছিল। আমাকে রাগিয়ে দিতে পেরেছিল। তবে ম্যাচ আমরাই জিতেছিলাম!

মাঠে উত্তেজনায় অনেক কিছুই হয়। ভারতীয়রা পরে অভিযোগ তুলে নিয়েছিল, সেজন্য তাদের তখন ধন্যবাদও জানিয়েছিলাম। ওই টেস্টে আরও অনেক কিছু হয়েছিল ( ক্রিকেট বিশ্ব নাড়িয়ে দেওয়া বর্ণবাদ বিতর্ক, দুই দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্কে প্রবল টানাপোড়েন উত্তেজনা), দয়া করে ওসব আর জানতে চেয়ো না!

বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে আপনার সাফল্য বেশ কৌতূহল জাগানিয়া। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশিবার আউট করেছেন সৌরভ গাঙ্গুলিকে (৬ বার, মাহেলা জয়াবর্ধনেকেও ৬ বার)। যুবরাজ সিংকে ৫ বার, কুমার সাঙ্গাকারা, ব্রায়ান লারা, রাসেল আরনল্ড ৪ বার করে…

হগ:  নিজেও জানতাম না এই তথ্য। ভাবিনি সেভাবে। আমি তো বরং ডানহাতিদের বিপক্ষে বোলিংয়েই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলাম!

সৌরভ, সাঙ্গাকারা, লারা, সবাই তো স্পিনে দারুণ ছিল। উইকেটের তালিকা তো দেখছি খারাপ নয়!

এই সময়ের সেরা চায়নাম্যান বোলার কাকে মনে করেন? কুলদীপ যাদব তো দারুণ করছে। লাকশান সান্দাক্যান আছেন, তাবরাইজ শামসি, আফগানিস্তানের জহির খান, নেদারল্যান্ডসের মাইকেল রিপন …

হগ: একজনের নাম বলে অন্য কাউকে বেজার করতে চাই না! আমি স্রেফ এই শিল্পটা দেখতে ভালোবাসি। সবারই আলাদা স্কিল আছে। চায়নাম্যান বোলিং দেখতেই আমার ভালো লাগে। এই সময়ে টেস্ট ক্রিকেট থেকে শুরু করে টি-টোয়েন্টি, পুরো বিপরীত দুই ঘরানার ক্রিকেটে চায়নাম্যান কার্যকর হচ্ছে, এটিই দারুণ লাগছে আমরা।

কুলদীপ ও শামসি হয়তো এগিয়ে। তবে আপনি যাদের কথা বললেন, ওদের বাইরেও টি-টোয়েন্টি লিগগুলোয় বেশ চায়নাম্যান বোলার দেখি। অস্ট্রেলিয়ায় ডার্সি শর্ট আছে, পার্ট টাইমার হলেও বেশ ভালো।

ইদানিং অনেকেই বলছেন, ‘চায়নাম্যান’ বোলিং বলা উচিত নয়। হয়তো বর্ণবাদের ছোঁয়া থেকে যায়। স্রেফ বাঁহাতি রিস্ট স্পিন বললেই হয়!

হগ: আমার মনে হয়, ইদানিং আমরা একটু বেশিই গভীরভাবে ভাবি। সবকিছু জটিল করে তুলি। অযথাই কোনো ইস্যু খুঁচিয়ে বড় করা হয়। ইতিবাচক অনেক কিছুরও নেতিবাচকতা খুঁজে বের করা হয়।

‘চায়নাম্যান’ তো একটি ক্রিকেটিং টার্ম। অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। নাম চালু হওয়ার পেছনে দারুণ মজার একটি ইতিহাসও আছে। ইতিহাসকে সম্মানের জায়গায় রাখার ব্যাপারও তো আছে। চাইলে অনেক কিছু নিয়েই বিতর্ক করা যায়। তার চেয়ে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে দেখলেই হয়!

বাংলাদেশ তো আপনার হৃদয়ে আলাদা একটি জায়গা নিয়ে থাকার কথা। ক্যারিয়ারে আপনার একটি অর্জন আছে, যেটি করতে পেরেছিলেন কেবল এখানেই!

হগ:  তিন ম্যাচে তিনটি করে উইকেট? নাহ, ওটা তো আরও পেয়েছি…. হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একমাত্র ম্যান অব দা সিরিজ! ২০০৬ সালের সিরিজে সেটি।

যেটি আগে বলেছি, আমি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। বিশ্বের নানা প্রান্ত। বাংলাদেশে প্রথম এসেছিলাম সেবার। প্রতিকূল কন্ডিশনের চ্যালেঞ্জ নিতে চেয়েছি। লোকে আমাদের দারুণ আন্তরিকতায় স্বাগত জানিয়েছিল। এত বছর পর এবারও দেখেছি এখানে সবাই কতটা আন্তরিক, কতটা বন্ধুত্বপূর্ণ। এবারের পর আবারও বাংলাদেশে আসার সুযোগ খুঁজব, এই মানুষগুলোর জন্য।