জীবনের সেরা সময় কাটাচ্ছি: শাহাদাত

সাড়ে তিন বছর আগে ঢাকা টেস্টের প্রথম দিন স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়ার সময়ই শাহাদাত হোসেন জানতেন, তার সামনে অপেক্ষা করছে অনেক সংগ্রাম। তবে সেটা যে এতো বেশি হবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। অস্ত্রোপচারের পর মাঠে ফিরতে না ফিরতে গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে ঘরোয়া ক্রিকেটে হন নিষিদ্ধ। কিছু দিন থাকতে হয় জেলে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর পাচ্ছিলেন না দল। অনেক মুটিয়ে যাওয়ায় তার ওপর আস্থা রাখতে পারছিল না কেউ। কঠোর পরিশ্রমে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সেখান থেকে। স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের প্রথম পেসার হিসেবে টেস্টে একশ উইকেট নেওয়ার।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2018, 03:01 PM
Updated : 28 Oct 2018, 03:01 PM

বিসিবি একাদশের হয়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে খেলতে রোববার চট্টগ্রাম এসেছেন শাহাদাত। ৩২ বছর বয়সী এই পেসার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনালেন কঠিন লড়াইয়ের গল্প, জানালেন টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা।

একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। ২০১৫ সালে মিরপুরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টের প্রথম দিন লাঞ্চ বিরতিতে বোলিংয়ের সময় চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার সময় ঠিক কি ভাবছিলেন?

শাহাদাত: সেটা খুব কঠিন একটা সময় ছিল। দুই বল করার পর চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম। পরে মাঠে ফিরে একটা ক্যাচও নিয়েছিলাম। লাঞ্চের সময় কিছুক্ষণ বোলিং করতে চেয়েছিলাম। তখনই ওই বিপত্তি, ছিঁড়ে গেল লিগামেন্ট। ছিটকে গেলাম লম্বা সময়ের জন্য।  

অস্ত্রোপচার হল। এরপর পড়লাম ঝামেলায়। যেতে হল জেলে। একেবারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। সামনে কোনো আশার আলো দেখছিলাম না। ছিল না কোনো অনুপ্রেরণা। জীবন যেন হয়ে পড়েছিল দুঃস্বপ্ন। সেখান থেকে মাশরাফি ভাইয়ের কথায় ফিরে পাই মনোবল। তার দেখানো পথ ধরে অনেক পরিশ্রম করে, অনেক চেষ্টায় ফিরে পেয়েছি নিজেকে। শুধু মাশরাফি ভাই না সাকিব, মুশফিকসহ অন্যরাও আমাকে এই লড়াইয়ে অনেক সহায়তা করেছে।

অনেক দিন পর বিসিবির কোনো দলে এলেন। গত কিছু দিনে যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন, এটা কী তারই ফল?

শাহাদাত: হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। সবচেয়ে বড় কথা আপনারা সবাই দেখেছেন, এই সময়ে কতটা কঠোর পরিশ্রম করেছি আমি। আমার সতীর্থদের সঙ্গে আমি সব সময় বলেছি, আমরা পরিকল্পনা হচ্ছে দিন দিন উন্নতি করা। তো আশা করি, এখন খুব কাছাকাছি আছি....। প্রায় তিন বছর পর একটা সুযোগ পেলাম, যারা সুযোগটা দিয়েছেন তাদের ধন্যবাদ। আমি অবশ্যই খুশি তবে এই সুযোগটা কাজে লাগানো আমার জন্য আরও বেশি জরুরি।

এই সময়ে বোলিংয়ে নতুন কি যোগ হয়েছে?

শাহাদাত: তিন বছরে অনেক-অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে আমার ফিটনেস নিয়ে অনেক কথা হতো। আমার বলের পেস নিয়ে অনেক কথা হতো। বলা হতো, আমি পুরান বলে তেমন অ্যাফোর্ড দিতে পারি না। বল পুরান হলে আমি খুব একটা জোরে বোলিং করতে পারি না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে আমার এখনকার ফিটনেস। সে সময়ে আমার ওজন ছিল অনেক। ৯২/৯৩ কেজি ওজন ছিল আমার। এখন আমার ওজন বড়জোর ৭৮/৭৯। এখন বোলিংয়ে গতিও বেশ ভালো। নতুন বলের চেয়ে পুরানো বলে এখন আরও বেশি জোরে বোলিং করতে পারছি। আর ফিটনেসও আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো। অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছি। তবে অনেক কিছু পরিবর্তন করার চেয়ে তা ধরে রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চেষ্টা করব যত দিন খেলব তত দিন যেন এটা ধরে রাখতে পারি।

২০০৫ সালে অভিষেক হওয়ার পর এখন পর্যন্ত খেলা ৩৮ টেস্টে নিয়েছেন ৭২ উইকেট। বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে আপনার চেয়ে বেশি উইকেট কেবল মাশরাফির (৭৮)। সুযোগ পেলে কতদূর যেতে চান?

শাহাদাত: আর মাত্র ৬ উইকেট হলে ধরে ফেলব মাশরাফি ভাইকে। আর ২৮ উইকেট হলে বাংলাদেশের প্রথম পেসার হিসেবে নিতে পারবো ১০০ উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটে আবার ফিরতে চাওয়ার এটা একটা বড় কারণ। আমাদের কোনো পেসার তো এখন পর্যন্ত টেস্টে একশ উইকেট নিতে পারেনি। সুযোগ পেলে আমি অবশ্যই এই অপূর্ণতা দূর করার চেষ্টা করব।

টেস্টের ৭২ উইকেট আমার কাছে অনেক বড় একটা অর্জন। এই ব্যাপারটা আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করে। আমি যখন আমার বোলিং স্পেলগুলো দেখি, নিজের স্ট্যাটস দেখি সেগুলো আমাকে খুব উজ্জীবিত করে। অবশ্যই সেই সময়টা আমার খুব ভালো কেটেছিল, সে সময় টেস্টে খুব ভালো খেলছিলাম। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি টেস্ট ক্রিকেট সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। এখনও প্রথম শ্রেণির ম্যাচ বলেন বা টেস্ট বলেন আমি খুব উপভোগ করি। হয়তো এই কারণেই আমি টেস্ট ক্রিকেটে বেশি সফল হয়েছি। আমি আবার সেই জায়গায় ফিরে যাওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি।

টেস্টে পেস বোলিংয়ের সঙ্কট কি আশা দেখাচ্ছে?

অবশ্যই। টেস্টে তো সব সময়ই আমাদের পেস বোলিংয়ে একটা সঙ্কট ছিল। মাশরাফি ভাই চোট পাওয়ার পর সেই সঙ্কট আরও তীব্র হয়। তারপর আমি এলাম, সৈয়দ রাসেল খেলল অনেক দিন। তারপর (রবিউল ইসলাম) শিবলু ছিল কয়েক দিন। তারপর আমি যখন চোটে পড়লাম তখন আর সেভাবে টেস্টের জন্য ফাস্ট বোলার আসেনি। একেবারে আসেনি বললে ভুল হবে। মুস্তাফিজ এসেছে এই সময়ে। ওর সামর্থ্য সম্পর্কে সারা বিশ্বই জানে। তবে এখনও টেস্টে আমাদের পেস বোলারের সঙ্কট আছে। কাকে খেলাবে সেটা ঠিক করতে হিমশিম খেতে হয়। চেষ্টা করছি আবারও বাংলাদেশের হয়ে খেলার। আশা করি, অবশ্যই (টেস্ট ক্রিকেটে) আসব। এই ম্যাচ আমার জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ। এখন একটাই চাওয়া কালকের ম্যাচে যেন ভালো বোলিং করতে পারি।

গত মৌসুমের মতো এবার দল পেতে অপেক্ষা করতে হয়নি। বিপিএলে আপনাকে ডেকেছে ঢাকা ডায়নামাইটস।

শাহাদাত: আমাকে দলে নেওয়ার জন্য আমার বন্ধু সাকিব আল হাসানকে আমি ধন্যবাদ দিব। বিপিএল অনেক বড় একটা টুর্নামেন্ট। বিশেষ করে কামব্যাক করার জন্য এটা বড় একটা টুর্নামেন্ট। এই বছর সাকিব আর অন্য সবাইও দেখেছে, আমি কতটা কঠোর পরিশ্রম করেছি। জাতীয় ক্রিকেট লিগে কেমন বোলিং করছি সবাই দেখেছে। এটা হবে আমার জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ। আর ঢাকা দলে যখন আছি তখন আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও হয়তো থাকবে। ভালো দলের সঙ্গে ভালো অনুশীলন, ভালো প্রস্তুতির এই সুযোগ অবশ্যই কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।

হ্যামিল্টন মাসাকাদজা-ব্রেন্ডন টেইলরদের বিপক্ষে তিন দিনের এই প্রস্তুতি ম্যাচকে কী টেস্ট দলে নিজের দাবি জানিয়ে রাখার সুযোগ হিসেবে দেখছেন?

শাহাদাত: অবশ্যই। আমি ধাপে ধাপে এগোতে চাচ্ছি। আমার জন্য অবশ্যই এটা অনেক বড় একটা সুযোগ। চেষ্টা আছে, আমি আত্মবিশ্বাসী, ভালো কিছু করবো।

এই আত্মবিশ্বাসের মূলে কী? এই সময়ে বোলিং নিয়ে কি কি কাজ করেছেন?

শাহাদাত: বোলিংয়ে মূলত গতিটা বাড়িয়েছি। যখন আপনার ফিটনেস লেভেল উঁচুতে থাকবে তখন আপনি পেসও কিছুটা বাড়াতে পারবেন। এখন ফিটনেস যেহেতু খুব ভালো বলের পেস নিয়ে অনেক কাজ করছি। জিমে অনেক বেশি কাজ করছি। আর সুইংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। চেষ্টা করছিলাম সুইং নিয়ে বাড়তি কিছু করার জন্য। এখন সুইংটাও ভালো হচ্ছে।

এনসিএলের প্রথম রাউন্ডে নিলেন ৮ উইকেট। কেমন কাটছে এবারের আসর?

শাহাদাত: আমি মনে করি, আমার সেরা সময় কাটছে এখন। একজন ফাস্ট বোলারের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় পেস জেনারেশন। আমি সেটা এখন ভালোভাবে করতে পারছি। সেটা হয়তো আমাদের নির্বাচকরা দেখেছেন। জাতীয় ক্রিকেট লিগের প্রথম দুই ম্যাচে আমার পেস জেনারেশন ছিল খুব ভালো। ফতুল্লায় এনসিএলের দুটি ম্যাচে নতুন বলে যত জোরে বোলিং করেছি পুরান বলে তার চেয়ে বেশি জোরে বোলিং করেছি। আমাকে (প্রস্তুতি ম্যাচের দলে) ডাকার কারণ হয়তো এটা যে, বোলিংটা খুব ভালো হচ্ছে।

টেস্ট ক্রিকেটে নতুন বলের পাশাপাশি পুরান বলটাও হতে পারে খুব কার্যকর। পুরান বলে বোলিংয়ের সময় আপনি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের পেতে পারেন, আসতে পারে টেল এন্ডাররাও। তাই এটা নিয়ে আপনার কাজ করে যেতেই হবে।”

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক আছে। টেস্টে সবচেয়ে ভালো স্মৃতি কোনটা?

শাহাদাত: ব্রেন্ডন টেইলরের বিপক্ষে আমি অনেক দিন খেলেছি। হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, শন উইলিয়ামসের বিপক্ষেও অনেক খেলেছি। সিকান্দার রাজার বিপক্ষে সেভাবে খুব একটা খেলা হয়ে উঠেনি। পরিচিত একটা প্রতিপক্ষই পেয়েছি।

ওদের বিপক্ষে টেস্টে সেরা স্মৃতিটা ব্যাটিংয়ে। ছোট (১০১ রানের) লক্ষ্য তাড়ায় ঢাকায় গত সিরিজের প্রথম ম্যাচ আমরা হারতে হারতে জিতেছিলাম। সেই ম্যাচটা টেস্ট ক্রিকেটেই আমার জন্য অনেক বড় একটা স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমাকে নামানো হয়েছিল তাইজুলের আগে। (সেই সময়ের কোচ) চন্দিকা হাথুরুসিংহে আমাকে নামার আগে বলেছিল, ‘তোমার কাছ থেকে আমি ২০ রান চাই। তুমি যদি ২০ রান করতে পার আমরা ম্যাচ জিতে যাব।’ কোচ যদি এভাবে বলে যে কোনো ক্রিকেটার অনুপ্রাণিত হবে। আমি নেমে প্রথম বলেই চার মারি, পরে ছক্কা মারলাম! অন্য প্রান্তে ছিল মুশফিক, ও খুব হেল্প করেছিল। আমি শেষ করে আসতে পারিনি। মুশফিক-তাইজুল শেষ করে এসেছিল ম্যাচ, আমরা জিতেছিলাম ৩ উইকেটে।  

জিম্বাবুয়ে অনেক চেনা এক প্রতিপক্ষ। প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার আগে সেই সব স্মৃতি ভীড় করছে নিশ্চয়ই?

শাহাদাত: আমার কাছে শুধু এই ম্যাচ না যখনই যেখানে খেলি খুব ভালো লাগে। জাতীয় ক্রিকেট লিগে প্রথম ম্যাচ যখন খেলছিলাম তখন মনে হচ্ছিল যেন আমি টেস্ট ম্যাচ খেলছি। আমি তেমনই একটি পরিবেশ তৈরি করে খেলার চেষ্টা করি। ধরুন, আমি একটা টেস্ট ম্যাচে খেলার সুযোগ পেলাম। তখন কিন্তু আমার আবার সব নতুন করে শুরু হবে। সাড়ে তিন বছর পর একটা ম্যাচ খেলা মানে তো আবার অভিষেক হওয়া। আমি তেমন কোনো চাপ নিতে চাই না। আমি মনে করি, কালকের প্রস্তুতি ম্যাচটাও আমার জন্য একটা টেস্ট ম্যাচ। আমি সেভাবেই মাঠে নামবো।

কোনো টুর্নামেন্টে বা ম্যাচ খেলার আগে আমার প্রথম লক্ষ্য থাকে, সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার। আমি যত দিন খেলব বাঘের মতো খেলব, নয়তো খেলব না। এটা হল আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা। গত ছয় মাসে আমি যত পরিশ্রম করেছি আমার মনে হয় না, বাংলাদেশের আর কোনো ফাস্ট বোলার অতটা পরিশ্রম করেছে। আমার ইচ্ছা, ওই পর্যায়ের কঠোর পরিশ্রম করে যাওয়া। আর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়মিত খেলা। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা আর তার জন্য যা যা করতে হয় আমি করব।

বয়স হয়ে গেছে ৩২। সর্বোচ্চ পর্যায়ে কত দিন খেলা সম্ভব?

শাহাদাত: কত বছর খেলে যেতে পারব এটা বলা খুব কঠিন। মাশরাফি ভাই তো অনেক দিন ধরেই খেলছেন। আমি যদি নিজেকে মেইনটেইন করতে পারি তাহলে তার কাছাকাছি যাওয়া তো সম্ভব। ইচ্ছা আছে আর পাঁচ/ছয় বছর দেশের হয়ে খেলার। দেশকে তো এখনও কিছু দিতে পারিনি। ইচ্ছা আছে বাংলাদেশ দলকে কিছু দেওয়ার। তার জন্যই এতো পরিশ্রম করছি। নিজের দেশের জন্য তো কিছুই করতে পারিনি, দেশ তো আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আজকে যে মানুষ আমাকে চেনে সেটাও তো দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার জন্যই। নইলে শাহাদাত হোসেনকে কেউ চিনতো না।           

অবশ্যই সুযোগ পেলে দেশের হয়ে তিন ফরম্যাটে খেলতে চাই। তবে ফিট থাকার জন্য সবার আগে খেলতে চাই টেস্ট। এরপর সুযোগ পাই যদি তাহলে ওয়ানডে আর এরপর আছে টি-টোয়েন্টি।