এক হাঁটুতে তিন অস্ত্রোপচার করিয়ে ফিরেছেন নাসির

লিগামেন্ট ছেঁড়া ছিল দুটি। অস্ত্রোপচার জরুরি ছিল একটিতে। অস্ট্রেলিয়ায় শল্যবিদ দেখে বললেন, অস্ত্রোপচার করতে হবে অন্যটিতেও। পরীক্ষায় ধরা পড়ল শুধু দুটি লিগামেন্টই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিনিস্কাস। সেখানেও লাগবে অস্ত্রোপচার। সব মিলিয়ে নাসির হোসেনের এক হাঁটুতে করা হলো তিনটি অস্ত্রোপচার।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2018, 04:28 PM
Updated : 26 June 2018, 05:06 PM

মেলবোর্নে গত ৮ জুন ৪ ঘণ্টা ধরে তিনটি অস্ত্রোপচার করা হয় নাসিরের হাঁটুতে। যিনি করেছেন, এর আগে মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল, শাহাদাত হোসেন, আবুল হাসানদের অস্ত্রোপচার করিয়ে তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে অতি পরিচিত নাম। ডাক্তার ডেভিড ইয়াং।

নাসির চেয়েছিলেন অস্ত্রোপচারের পরপরই ফিরতে। কিন্তু ১০ দিন পর আবার হাঁটুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন বলে থেকে যেতে বলেছিলেন ডাক্তার ইয়াং। পরে ২০ জুন ইয়াংকে আরেকবার দেখিয়ে গত শুক্রবার দেশে ফিরেছেন নাসির।

তার অস্ত্রোপচারে গল্পটা অনেকটা মাশরাফি বিন মুর্তজার মতোই। ডান হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় ২০০৩ সালে মেলবোর্নে ইয়াংয়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল মাশরাফিকে। ইয়াং পরীক্ষা করে দেখেছিলেন, মাশরাফির অন্য হাঁটুর লিগামেন্টও ছেঁড়া। সেবার দুটি অস্ত্রোপচার করানো হয়েছিল মাশরাফির। সেই ইয়াংয়ের কাছেই নাসিরের লাগল তিনটি অস্ত্রোপচার।

মেলবোর্নে গিয়ে নিজের হাঁটুর অবস্থা জেনে বেশ ভড়কে গিয়েছিলেন নাসির। তবে এখন স্বস্তিটাই বেশি, জানালেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।

“আমি তো জানতাম একটি অপারেশন লাগবে। ডাক্তার বলল এসিএল তো বটেই, পিসিএলও ছেঁড়া। আর মিনিস্কাসও ড্যামেজ হয়েছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথমবার অপারেশন। সেখানে এত বড় কিছু।”

“ডেভিড ইয়াং খুব সাহস জুগিয়েছেন, বলেছেন একসঙ্গে করে নিলেই ভালো। এখন মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে। ঝামেলা সব একসঙ্গে চুকে গেল।”

গত এপ্রিলের শুরুতে এই চোটে পড়েন নাসির। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছিল, ফিটনেস ট্রেনিংয়ের সময় চোট পেয়েছেন। তবে নানা সূত্র থেকে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, বন্ধুর বিয়েতে সিরাজগঞ্জ গিয়ে ফুটবল খেলার সময় চোট পান এই অলরাউন্ডার।

তখন জানা গিয়েছিল শুধু এসিএল (এন্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট) ছিড়েছিল নাসিরের। মেলবোর্নে গিয়ে তিনটি অস্ত্রোপচার কেন লাগল, সেই ব্যাখ্যা দিলেন বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী।

“এসিএলে অপারেশনটাই জরুরি ছিল। এখানে এমআরআইতে ধরা পড়েছিল তার পিসিএলও (পস্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট) ছেঁড়া। তবে আমরা ভেবেছিলাম, এটার অপারেশন লাগবে না। কারণ পিসিএল ইনজুরিতে অপারেশন সাধারণত করা হয় না বাংলাদেশে। ফুটবলারদের লাগে, ক্রিকেটারদের লাগে না অতটা। ওখানে উনি (ডাক্তার ইয়াং) হাঁটু খোলার পর দেখে ওটাও করে দিয়েছেন।”

“মেলবোর্নের ডাক্তার বলেছেন, এবারের ইনজুরির আগে থেকেই ওর পিসিএল ছেঁড়া ছিল। অনেক পুরোনো এটা। এই ইনজুরি অনেক সময় যার হয়েছে, সে বুঝতে পারে না। নাসিরও আগে বুঝতে পারেনি। আর মিনিস্কাসে হালকা ইনজুরি ছিল। ডাক্তার সেলাই করে ঠিক করে দিয়েছেন।”

মিনিস্কাস ক্ষতিগ্রস্ত কি এবার চোট পাওয়ার সময়ই হয়েছে নাকি আগে থেকেই ছিল, সেটা নিয়ে নিশ্চিত নন ঢাকা বা মেলবোর্নের ডাক্তাররা।

অপারেশনের পর নাসির

আপাতত নাসিরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী দুটি ক্রাচ। গত দুই দিন ক্রাচে ভর দিয়ে বিসিবিতে এসে দেখিয়ে গেছেন চিকিৎসককে। কিছুদিন থাকতে হবে বিছানায়। মঙ্গলবারই রাতেই তাই যাওয়ার কথা নিজ শহর রংপুরে। জানালেন, অস্থির সময়ে স্বস্তির খোঁজেই মূলত বাড়িতে যাচ্ছেন।

“আপাতত ৭ থেকে ১০ দিন মোটামুটি বিছানায় থাকতে হবে। শুয়ে-বসেই কিছু এক্সারসাইজ করতে হবে। একা থাকলে খারাপ লাগে। বাড়ি গেলে সবার সঙ্গে থাকলে ভালো লাগবে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেই যাচ্ছি। ৭ থেকে ১০ দিন পর হয়ত ক্রাচ ছাড়া চলতে পারব। তখন আবার এসে দেখিয়ে যাব।”

অপারেশনের পর নাসিরের হাঁটুর অবস্থা ও আপাতত করণীয় আরও বিস্তারিত জানালেন বিসিবির প্রধান চিকিৎসক।

“ক্ষত প্রায় পুরোটা শুকিয়ে গেছে। হাড়গুলো ভালো আছে। ইনফেকশন হয়নি। ফোলা নেই, যেটি ভালো দিক। ব্যথাও খুব বেশি নেই।”

“গত ৮ তারিখে অপারেশন হয়েছে, পরের মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত নন ওয়েট বিয়ারিং এক্সারসাইজ করবে। এক মাস যাওয়ার পর থেকে ফিজিওথেরাপি শুরু করব। আর তখন থেকে এক্সারসাইজ বদলে ওয়েট বিয়ারিং এক্সারসাইজ দেব।”

যে কোনো ইনজুরি কিংবা অস্ত্রোপচারের পর সবচেয়ে বেশি কৌতুহল থাকে, ফেরার দিনক্ষণ নিয়ে। দেবাশীষ চৌধুরী জানান, এধরনের চোট সারতে সাধারণত যেরকম সময় লাগে, নাসিরের ক্ষেত্রেও সেরকমই লাগবে।

“৬ মাসের আগে সাধারণত ফেরা যায় না। নাসিরেরও ৬-৭ মাস লাগবেই। তারপর ওই সময়টায় গেলে অগ্রগতি বোঝা যাবে। ৩-৪ মাস পর মাঠের কাজ, ফিল্ড ড্রিল করতে পারবে। হয়ত টুকটাক ব্যাটিং বা নক করতে পারে, কিন্তু রানিং করতে অনেক সময় লাগবে।”

নাসিরও বাস্তবতা মেনেই ঠিক করেছেন নিজের ভবিষ্যত। দৃষ্টি তার বিপিএলে। জাতীয় নির্বাচনের কারণে আগামী জানুয়ারির আগে বিপিএল হচ্ছে না। নাসির তাকিয়ে সেই টুর্নামেন্টেই।

“আমি আপাতত টার্গেট করেছি বিপিএলকে। আশা করি পুরো ফিট হয়ে বিপিএল দিয়ে ফিরতে পারব। তবে পুরো ফিট না হলে আরও অপেক্ষা করব। তাড়াহুড়া করে কোনো ঝুঁকি নেব না।”

বাস্তবতার মুখোমুখি

এপ্রিলের শুরুতে চোট পাওয়ার পর জুনের শুরুতে অস্ত্রোপচার। মাঝের দুই মাস সময় নাসিরের কেটেছে হতাশায়। অস্থিরতায়। অনিশ্চয়তায়। অস্ত্রোপচার করাতে অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে, এটা একদম শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বিসিবির চিকিৎসক। তারপরও নানা সিদ্ধান্তহীনতা ও জটিলতায় দেরি হয়ে যায় দুই মাস।

অস্ত্রোপচারের পর থেকে ৬-৭ মাস লাগবে ফিরতে, এটা জানাই ছিল। অস্ত্রোপচারের দেরিতে তাই পিছিয়ে যাচ্ছিল মাঠে ফেরার সময়ও। কিন্তু অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করার ছিল না নাসিরের। চোটে যেহেতু নিজের দায় ছিল অনেক বেশি, আক্ষেপও তাই ছিল বেশি।

নাসির জানালেন, এই সময়টায় নিজে যেমন অনেক কিছু শিখেছেন, অনেক বাস্তবতার উপলব্ধিও হয়েছে। দুঃসময়ে চিনতে পেরেছেন মানুষ।

“দিনের পর দিন বসে থাকতে হয়েছে, খারাপ তো লেগেছেই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। অনেক কিছু বুঝতে পেরেছি এই সময়। নিজের ভুলগুলোও উপলব্ধি করেছি। অনেক কিছু শিখেছি।”

“সবচেয়ে বেশি শিক্ষা হয়েছে, অনেককে চিনতে পেরেছি। অনেক বাস্তবতাও বুঝেছি এই সময়। অনেক মানুষকে হয়ত কাছের ভেবেছি, কিন্তু আমার খারাপ সময়ে একটা ফোনও করেনি। খোঁজখবর নেয়নি খুব বেশি কেউ। খুব খারাপ লেগেছে। তবে ভালোও হয়েছে। জগত কতটা কঠিন, সেটা বুঝতে পেরেছি। জীবনে সব শিক্ষারই প্রয়োজন আছে।”

এই চোট একদিক থেকে তাই জীবনবোধে সমৃদ্ধ করেছে নাসিরকে। দুঃসময়ের শিক্ষাগুলোই কাজে লাগাতে চান ক্যারিয়ার আর জীবনের পথচলায়। আপাতত অপেক্ষা, আবার ফিরবে সুদিন!