হাওয়ায় নাড়িয়ে দেওয়া মানসিকতা

বে ওভাল থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে মাউন্ট মঙ্গানুই সৈকত। মাঠের একপাশে, সবুজ গাছগাছালির পেছন দিয়ে উঁকি মারছে বন্দরের স্থাপনা। সাগর খুব কাছেই বলে হাওয়ার জোর এখানে তীব্র। প্রশান্তির বাতাস মন জুড়িয়ে দেয় মুহূর্তেই। তবে বাংলাদেশ দলের কাছে সেই বাতাসই আতঙ্কের নাম।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনি মাউন্ট মঙ্গানুই থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2017, 12:39 PM
Updated : 6 Jan 2017, 01:58 PM

সফর শুরুর আগে দেশে থাকার সময়ই অবশ্য নিউ জিল্যান্ডের বিভিন্ন মাঠের বাতাস নিয়ে দুর্ভাবনার কথা বেশ কবার বলেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। বেশিরভাগ মাঠেই বাতাসের জোর অনেক। দিক পরিবর্তনও হয় মাঝেমধ্যেই। এখানে সাফল্যের জন্য দারুণ জরুরি বাতাসের সঙ্গে মিতালী। ব্যাটসম্যান হিসেবে বাতাসের অনুকূলে বড় শট খেলে সুবিধাটা নিতে জানতে হয়, বোলারদেরও বাতাসে বোলিংয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয় খুব দ্রুত।

স্বাভাবিকভাবে নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা বাতাসটা খুব ভালো বোঝেন, জানেন। সমস্যাটুকু সামলে সুবিধাটুকু নিতে জানেন। বাংলাদেশ এই জায়গাটায় ধুঁকছে এবং ভুগছে সফরের শুরু থেকেই। এক মাঠে যেহেতু খেলা বেশি নেই, ভোগান্তিও চলছেই। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে যেমন বাতাসের অনুকূলে বল ভাসিয়ে দিয়ে মাঠের নানা প্রান্তে আছড়ে ফেললেন কলিন মানরো, টম ব্রুসরা। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে সাব্বির রহমান ও সৌম্য সরকারের জুটির সময়টুকুতে কিছু শট ছাড়া বাতাসকে কাজে লাগাতে পারেননি আর কেউ।

সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণায় আছেন মাশরাফি। তার বোলাররা বাতাসে বোলিংই করতে চান না! সফরের প্রথম ম্যাচ থেকেই এটি চলে আসছে। বাতাসে বোলিং করতে কেউই মন থেকে রাজি না হওয়ায় অধিনায়ক নিজেই প্রতি ম্যাচে বাতাসে বোলিং করে আসছেন পরের দিকে। শুক্রবারও একই অবস্থা। বে ওভালে তীব্র বাতাসের প্রান্ত থেকে বোলিং করতে রাজি নন পেসারদের কেউই। যথারীতি প্রান্ত বদলাতে হয়েছে অধিনায়ককেই।

মাশরাফির বিশ্বাস, এই ম্যাচে দুদলের মাঝে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে বাতাসকে কাজে লাগানো আর না লাগাতে পারাই।

“এক পাশ থেকে যেহেতু বাতাস ছিল, ওই পাশ দিয়ে ওরা টার্গেট করেছে। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। ওই পাশ দিয়ে বোলিং করা একটু কঠিন ছিল। হয়তো আরেকটু সুশৃঙ্খল বোলিং করলে... উইকেট নিষ্প্রাণ, তারপরেও আমরা যদি আরেকটু বুদ্ধি করে, ইয়র্কার বেশি মেরে যদি ব্যাটসম্যানদের দশের নীচে (ওই সময়ে রান তোলার রেট) রাখতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো।”

বাতাসে বোলিং করতে না চাওয়াটা দলের মানসিকতার এক টুকরো প্রতিফলন। যে মানসিকতা দেখা যাচ্ছে সফরের শুরু থেকেই। লড়াই করতে না চাওয়া। প্রতিকূলতার চ্যালেঞ্জটাকে আপন করে নিয়ে জয় করার চেষ্টা। ব্যাটিং হোক বা বোলিং, চোয়ালবব্ধ প্রতিজ্ঞার ছাপ দেখা যায়নি এখনও কারও মাঝে, কোনো পারফরম্যান্সে।

সফরের পাঁচ ম্যাচ চারটি ভেন্যুতে খেলল বাংলাদেশ, সবকটিতেই উইকেট ছিল ব্যাটিংবান্ধব। নিউ জিল্যান্ডের সহজাত বাউন্স ও খানিকটা গতি তো থাকবেই। তবে সমান বাউন্স ও বল ব্যাটে দারুণভাবে আসে বলে ব্যাটিংয়ে আরও সুবিধা। অথচ প্রায় প্রতিটি ম্যাচে ব্যাটিং হয়েছে ব্যর্থ। এখনও পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচে বাংলাদেশের অর্ধশতক মোটে পাঁচটি, সবোচ্চ ইনিংস মাত্র ৫৯!

অথচ ব্যাটসম্যানদের স্কিলে খুব বেশি সমস্যা চোখে পড়েনি। টেকনিকের ঘাটতিতে আউট হওয়ার ব্যাপারও নেই। সমস্যা বা ঘাটতি, প্রায় সবটুকুই মাথায়। চিন্তা-ভাবনার জগতে নেতিবাচকতার ঘোরাঘুরি। কন্ডিশন-উইকেট যতোই অনুকূল বা নিজেদের মত হোক, নিউ জিল্যান্ড নামটিই হয়ত মানসিকভাবে সংকুচিত করে রেখেছে ব্যাটসম্যানদের। 

কিউইদের স্পিনে বাংলাদেশের ব্যাটিংও এই মানসিকতার উদাহরণ। স্যান্টনার-প্যাটেল-উইলিয়ামসনদের সাদামাটা স্পিনেও রঙ ছড়াতে পারছে না বাংলাদেশ। অথচ এর চেয়ে অনেক ভালো মানের স্পিনার অনায়াসে খেলতে পারে এই ব্যাটসম্যানরা। অথচ এখানে ব্যর্থ।

সমস্যাটি যে ক্রিকেটারদের মানসিকতার, সেটি অকপটেই স্বীকার করে নিলেন মাশরাফি।

“হতে পারে মাইন্ড সেটআপের জন্য... এখানে এসে হয়তো পেস বোলিং বেশি সামলানোর কথা, তখন স্পিনাররাও এখানে ভালো করে, এটা মাথায় না থাকলে কাজটা কঠিন হয়ে যায়।”

অধিনায়কের ব্যাখ্যাতেও ফুটে ওঠে দলের মানসিকতার দৈন্য। ভয়ঙ্কর পেস খেলতে হবে, এই দুশ্চিন্তায় নিরীহ স্পিনেও কুপোকাত!

বাতাসের দুর্ভাবনা থেকে মানসিকতা নড়ে যাওয়ার সেই যে শুরু, সেটি এখন ডালপালা গজিয়ে মন-মাথা-শরীর সব কিছুতে ছড়িয়ে পড়েছে প্রবলভাবে। মানসিকভাবে হেরে যাওয়া দলকে তো জেতাতে পারবেন না স্বয়ং ক্রিকেট বিধাতাও!