নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
বোলারদের দারুণ পারফরম্যান্সে জয় দিয়ে নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করল বাংলাদেশ।
Published : 03 Oct 2024, 07:33 PM
ম্যাচ শেষ হতেই হাঁটু গেড়ে বসে মাটিতে মাথা ঠেকালেন অধিনায়ক নিগার সুলতানা। সেভাবেই পড়ে রইলেন দীর্ঘক্ষণ। সতীর্থরা উল্লাস-উদযাপনের এক পর্যায়ে ছুটে গেলেন অধিনায়কের দিকে। কাছে গিয়ে টেনে তুললেন তাকে। রোদচশমা থাকায় ঠিক বোঝা গেল না, নিগারের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে কি না। তবে আবেগের সবটুকু ফুঠে উঠছিল তার মুখাবয়বেই। অবশেষে বিশ্বকাপে জয়ের স্বাদ মিলল!
স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টি প্রত্যাশিতই। তবে অধিনায়কের প্রতিক্রিয়া আর অন্য ক্রিকেটারদের উল্লাসেই ফুটে উঠল, কতটা কাঙ্ক্ষিত জয় এটি। বিশ্বকাপের আগে দলের চাওয়া, লক্ষ্য কিংবা আকুতি, সবই ছিল এই ম্যাচকে ঘিরে। পূর্ণ হলো সেসবের সবটুকুই। ১০ বছর পর নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।
স্কটল্যান্ডকে ১৬ রানে হারিয়ে এবারের বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করল বাংলাদেশ।
শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ ২০ ওভারে তোলে ৭ উইকেটে ১১৯ রান।
ব্যাট হাতে খুব ভালো করতে পারেননি কেউ। কোনো ব্যাটার করতে পারেননি ফিফটি, অর্ধশত রানের জুটি হয়নি একটিও। দলের সেরা ব্যাটার ও অধিনায়ক নিগার সুলতানাকে বিস্ময়করভাবে দেখা যায় পাঁচ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামতে।
তবে সেই পুঁজিকেই জয়ের জন্য যথেষ্টর বেশি প্রমাণ করে ছাড়েন বোলাররা। স্কটল্যান্ড আটকে যায় ১০৩ রানে।
২০১৪ আসরে দেশের মাঠে শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে দুটি জয়ের পর টানা চার বিশ্বকাপে ১৬ ম্যাচ হেরে অবশেষে আবার জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ। এবারের ম্যাচের একাদশে থাকা ফাহিমা খাতুন ও স্কোয়াডে থাকা জাহানারা আলম কেবল ছিলেন ১০ বছর আগের সেই জয়ে। দেশের বাইরে বিশ্বকাপে জয় এটিই প্রথম।
বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে একশ টি-টোয়েন্টি পূর্ণ করার ম্যাচে নিগার ব্যাট হাতে দারুণ কিছু করতে না পারলেও উপলক্ষ তার জন্য স্মরণীয় হয়ে রইল দলের জয়ে।
এক উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ১০০ টি-টোয়েন্টি উইকেট পূর্ণ করেন নাহিদা আক্তার। এক উইকেট নিয়ে ফাহিমা ৫০ উইকেট পূর্ণ করেন দেশের পঞ্চম বোলার হিসেবে। তবে চার ওভারে ১৫ রানে দুই উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডার রিতু মনি।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের শুরুটায় ছিল ভালো কিছুর ইঙ্গিত। প্রথম দুই ওভারে সাথি রানি বর্মনের দুটি ও পরের ওভারে মুর্শিদা খাতুনের একটি বাউন্ডারিতে তিন ওভারে রান আসে ২০।
এরপরই রানের গতি কমে আসে। উইকেটও হারাতে হয়। ১২ রানে সহজ ক্যাচ দিয়ে রক্ষা পেলেও কোনো রান যোগ না করেই আবার ক্যাচ দিয়ে ফেরেন মুর্শিদা।
পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশ তুলতে পারে ৩৫ রান।
সাথি রানির সঙ্গে জুটি গড়ে ওঠে তিনে নামা সোবহানা মোস্তারির। তবে দ্রুত রান তুলতে পারেননি কেউ। বাউন্ডারি আসেনি প্রত্যাশা মতো।
ঘরোয়া ক্রিকেটে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে দলে ফিরে এক বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে নামা সাথি চেষ্টা করেছেন আগ্রাসী শট খেলতে। কিন্তু টাইমিং ঠিকঠাক করতে পারেননি।
১০ ওভারে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ৫৫।
সাথি চেষ্টা করে গেছেন রানের গতিতে দম দিতে। ক্যাথেরিন ফ্রেজারের বলে একটি বাউন্ডারি আদায় করেন তিনি। ওই ওভারেই উড়িয়ে মারার চেষ্টায় তার ইনিংস থামে ৩২ বলে ২৯ রান করে। তার ছয় ম্যাচের ছোট্ট ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংস এটি।
ইনিংসের সেটি দ্বাদশ ওভার। নিগার ব্যাটিংয়ে নামেননি তখনও। বরং চারে পাঠানো হয় অভিষিক্ত তাজ নেহারকে। তবে জন্মদিনে কোনো রান না করেই রান আউট হয়ে যান ২৭ বছর বয়সী এই ব্যাটার।
নিগার ক্রিজে যান এরপর। ততক্ষণে উইকেটে জমে গেছেন সোবহানা। অনেক সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে না পেরে সমালোচনার মধ্যে থাকা এই ব্যাটার এ দিন খুব খারাপ করেননি। তবে বলপ্রতি রান তুললেও থিতু হওয়ার পর পারেননি ইনিংসকে আরও গতিময় করতে।
বড় শটের চেষ্টাতেই সোবহানার ইনিংস থামে ১৫ ওভারের পর। স্টাম্পড হয়ে যান তিনি অলিভিয়া বেলের বলে। ৩৬ রান করতে ৩৮ বল খেলেন এই ব্যাটার।
৩৯ ম্যাচের ক্যারিয়ারে প্রথমবার ৩০ রান ছাড়াতে পারলেন তিনি।
এরপর স্বর্ণা আক্তার ও রিতু মনি পারেননি সময়ের দাবি মেটাতে। একটি বাউন্ডারি ছাড়া দ্রুততায় রান তুলতে পারেননি নিগারও (১৮ বলে ১৮)। শেষ ওভারের প্রথম বলে জীবন পেয়ে আউট হয়ে যান তিনি পঞ্চম বলে।
শেষ দিকে স্কুপ শটে ফাহিমা খাতুনের দুটি বাউন্ডারিতে ১২০ রানের কাছে যেতে পারে বাংলাদেশ।
মাঝবিরতিতে টিভি সাক্ষাৎকারে সোবহানা মোস্তারি বলেন, ১৪০ রানের লক্ষ্য ছিল তাদের। তবে নিজেদের বোলিং সামর্থ্যে প্রবল আস্থার কথাও বলেন তিনি। বোলাররা সেই ভরসার প্রতিদান দেন দারুণভাবেই।
দলকে প্রথম ব্রেক থ্রু এনে দেন তৃতীয় ওভারে আক্রমণে আসা লেগ স্পিনার ফাহিমা। তার প্রথম বলেই সাসকিয়া হর্লির ক্যাচ ছাড়েন নিগার। তবে এক বল পরই হর্লিকে স্টাম্পড করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
স্কটল্যান্ডের বড় দুই ভরসা দুই বোন সারাহ ব্রাইস ও ক্যাথরিন ব্রাইসের জুটি লম্বা হতে দেননি মারুফা আক্তার। পাওয়ার প্লের শেষ বলে নিচু হওয়া ইনসুইঙ্গারে ক্যাথরিনকে বোল্ড করে দেন এই পেসার।
বোলারদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করে স্কটিশদের রানের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। লেগ স্পিনার রাবেয়া খানের বলে ক্যাচ দিয়ে ৩ রানে স্বর্ণার হাতে জীবন পান আইলসা লিস্টার।
পরের ওভারে আক্রমণে এসেই লিস্টারকে ১১ রানে থামান রিতু মনি। প্রিয়ানাজ চ্যাটার্জি দ্রুতই ফেরেন রান আউটে। রিতুর বলে একটু পরে সীমানায় ফাহিমার দারুণ এক ক্যাচে বিদায় নেন ডার্সি কার্টার।
এক প্রান্ত আগলে রাখা সারাহ ব্রাইসকে ২৯ রানে স্টাম্পিংয়ের সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেন নিগার। পরে আরও দুই দফায় জীবন পান তিনি। কিন্তু বাংলাদেশকে ভুগতে হয়নি এজন্য। ওপেন করতে নেমে ৫২ বলে ৪৯ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি স্রেফ একটি চার মেরে।
স্কটল্যান্ডের গোটা ইনিংসে চার ছিল মোটে পাঁচটি। ১১ ওভারের পর চার হয়নি একটিও। কোনো জুটিই স্পর্শ করেনি ২০ রান। ম্যাচ শেষের বেশ আগেই তাই নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের জয়।
স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সব মিলিয়ে পাঁচ টি-টোয়েন্টি খেলে প্রতিটিতেই জিতল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচে নিগারদের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। এই মাঠেই ম্যাচটি শনিবার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১১৯/৭ (সাথি ২৯, মুর্শিদা ১২, সোবহানা ৩৬, তাহ ০, নিগার ১৮, স্বর্ণা ৫, রিতু ৫, ফাহিমা ১০*, রাবেয়া ১*; স্ল্যাটার ২-০-১৩-০, ক্যাথরিন ব্রাইস ৪-০-২৩-১, বেল ৪-০-২৩-১, আবতাহা ৪-০-২৪-০, ফ্রেজার ৪-০-২৩-১, হর্লি ২-০-১৩-৩)।
স্কটল্যান্ড: ২০ ওভারে ১০৩/৭ (হর্লি ৮, সারাহ ব্রাইস ৪৯*, ক্যাথরিন ব্রাইস ১১, লিস্টার ১১, প্রিয়ানাজ ৫, কার্টার ২, জ্যাক-ব্রাউন ৯, ফ্রেজার ২, আবতাহা ২*; মারুফা ৩-০-১৭-১, নাহিদা ৪-০-১৯-১, ফাহিমা ৪-০-২১-১, রাবেয়া ৪-০-২০-১, রিতু মনি ৪-০-১৫-২, স্বর্ণা ১-০-১০-০)।
ফল: বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী।
প্লেয়ার অব দা ম্যাচ: রিতু মনি।