বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ব্যর্থতার খতিয়ান

মূল পর্বে জয় খরা কাটানো এবং প্রথমবারের মতো একাধিক জয় ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। স্বপ্ন ছিল সেমি-ফাইনাল। পূরণ হলো না কিছুই। উল্টো বিব্রতকর হার দিয়ে শেষ হলো বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়ে শূন্য হাতে বিদায় নিল বাংলাদেশ। 

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতদুবাই থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Nov 2021, 04:49 AM
Updated : 5 Nov 2021, 09:54 AM

বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর মাঠের খেলা কিংবা টি-টোয়েন্টিকে ঘিরে দলের ভাবনা সবাই পড়ে গেছে প্রশ্নের মুখে। আলোর রেখা নেই খুব একটা। বৃহস্পতিবার আসরে নিজেদের সবশেষ ম্যাচটা খেলে ফেলার পর সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ বললেন, ব্যর্থতার কারণ জানা নেই তারও। নিজেও খুঁজছেন অনেক প্রশ্নের উত্তর।

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে ব্যাটিং। অথচ বেশিরভাগ ম্যাচে একাদশে ছিল নয় ব্যাটসম্যান। অন্তত আটজন ছিল প্রতি ম্যাচেই। কিন্তু সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি কেউই। একটা ম্যাচেও বাংলাদেশ পাওয়ার প্লে কাটাতে পারেনি বিনা উইকেটে। বরং পাওয়ার প্লেতে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট হারানো দল বাংলাদেশই (১৮টি)।

ব্যাটসম্যানরা ধুঁকেছে বাউন্ডারি পেতে, ভুগেছে রানের চাকা সচল রাখতে। ৩০ ছাড়াতে পেরেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ১২০ এর বেশি স্ট্রাইক রেট কেবল মাহমুদউল্লাহর।

চরমভাবে ব্যর্থ সৌম্য সরকারের মতো অভিজ্ঞ ও আফিফ হোসেনের মতো তরুণ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। লিটন দাসের ব্যর্থতা আলোচিত ছিল বিশ্বকাপজুড়ে। বড় ইনিংস যেমন খেলতে পারেননি, তার স্ট্রাইক রেট মোটে ৯৪.৩২!

দেড়শর বেশি বল খেলতে পারেন কেবল মোহাম্মদ নাঈম শেখ। ৭ ম্যাচে বাঁহাতি এই ওপেনার করেন দলের সর্বোচ্চ রান, ১৭৪। তার সমস্যা আবার স্ট্রাইক রেট, স্ট্রাইক রোটেশন। ভুল সময়ে বারবার ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলে আউট হন মিডল অর্ডারে সবচেয়ে বড় ভরসা মুশফিকুর রহিম। প্রত্যাশিত ধারাবাহিকতা ছিল না সাকিব আল হাসানের ব্যাটে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬৯ রান করলেও মাহমুদউল্লাহ রাখতে পারেননি প্রভাব।

বোলিংয়ের তুলনামূলক একটু ভালো। সাকিব যথারীতি ছিলেন নির্ভরযোগ্য। ৬ ম্যাচে তার শিকার ১১ উইকেট। ৭ ইনিংসে ৮ উইকেট নেন শেখ মেহেদি হাসান। এই অফ স্পিনারের পারফরম্যান্স নজর কেড়েছে বিশ্বক্রিকেটের অনেকের।

চোট পাওয়ার আগ পর্যন্ত খুব একটা খারাপ করেননি মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। সীমিত সুযোগে সামর্থ্যের ঝলক দেখান শরিফুল ইসলাম। আরও কার্যকর হয়ে ওঠার আভাস দেন তাসকিন আহমেদ। গতি, আগ্রাসন ও স্কিল মিলিয়ে দুর্দান্ত বোলিং করে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক পারফরমার হয়তো এই ফাস্ট বোলারই। ১৪৭ কিলোমিটার গতিতে বল করেছেন তিনি প্রায় নিয়মিতই।

কিন্তু পেস বোলিংয়ে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হওয়ার কথা ছিল যার, সেই মুস্তাফিজুর রহমান ছিলেন ধারহীন। বাংলাদেশের হয়ে ১০ ওভারের বেশি করা বোলারদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে খরুচে। ২৪ ওভারে ৮ উইকেট নিতে দেন ২২২ রান। ওভার প্রতি ৯.২৫ করে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পুরো বিশ্বকাপ অভিযানে ইতিবাচক কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন। অথচ বিশ্বকাপের আগে তারা দেখিয়েছিলেন বাঁক বদলের আশা। সেটা প্রথম হোঁচট খায় প্রস্তুতি ম্যাচে। দুটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি ম্যাচে হেরে যায় বাংলাদেশ। পরে হার দিয়ে শুরু করে প্রাথমিক পর্ব। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ওই হারে শঙ্কা জাগে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়েরও। পরে ওমান ও পাপুয়া নিউ গিনির বিপক্ষে জয়ে দল জায়গা করে নেয় সুপার টুয়েলভে। সেখানে সঙ্গী হয় এক রাশ হতাশা।

পাওয়ার হিটিংয়ের বিপরীতে স্কিল হিটিং দিয়ে ব্যবধান ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। অথচ স্কিলে ঘাটতিই প্রবলভাবে চোখে পড়েছে। কীভাবে রান নিতে হবে, প্রান্ত বদল করে খেলতে হবে, গ্যাপ খুঁজে বের করতে হবে, উদ্ভাবনী শট কখন ও কিভাবে খেলতে হবে, ব্যাপারগুলো যেন ভুলে ছিলেন ব্যাটসম্যানরা। স্পষ্ট ছিল ম্যাচ পরিস্থিতি নিয়ে সচেতনতার অভাব।

লড়াইয়ের তাড়নাটাই দেখাতে পারেননি তারা। ম্যাচ নিয়ে যেতে পারেননি গভীরে। ব্যাটিংয়ে পাওয়ার প্লেতেই যেন কেটে গেছে ফল নিয়ে সব অনিশ্চয়তা। পুরোপুরি ব্যর্থ টপ অর্ডার। ফিনিশাররা ‘ফিনিশ’ হয়ে গেছেন ঝড় তোলার আগেই। উদ্ভাবনী শটে দক্ষতার ছাপ খুব একটা রাখতে পারেননি কেউ। ইনিংস সাজাতে বিকল্প কোনো পরিকল্পনা যেন ছিল না কারও।

অবশ্য, বছরের পর বছর মিরপুরের উইকেটে খেলে সেটা কঠিনও। মন্থর ও নিচু উইকেটে খেলে না খোলে ব্যাটসম্যানদের হাত, না বোলারদের মাথা। ব্যাটসম্যানরা পারেন না বড় শট খেলে অভ্যস্ত হতে। জানেন না চার-ছক্কার মালা গেঁথে ইনিংস সাজাতে।

উইকেটই যখন সব করে দেয়, খুব কম বোলারই মাথা খাটিয়ে বোলিংয়ের কাজটা করেন। এর বেশ চড়া মাশুলই দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। নিজস্ব ঘরানা তৈরির যে চেষ্টা এতদিন ছিল, সেটা মোটামুটি ভেস্তে যেতে বসেছে দুঃস্বপ্নের এক বিশ্বকাপে।       

এর মধ্যে কিছু কিছু ব্যাপার দাগ কেটে গেছে। এর একটি তাসকিনের প্রতিক্রিয়া। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে সীমানা থেকে অনেক সামনে দাঁড়িয়ে অ্যারন ফিঞ্চের ক্যাচে সৌম্য হাতই ছোঁয়াতে পারেননি। সে সময় ভীষণ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল পেসার তাসকিনকে। উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলছিলেন তিনি। হয়ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। একটি-দুটি নয়, বিশ্বকাপে ১১টি ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন বাংলাদেশের ফিল্ডাররা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সুযোগ হাতছাড়া করায় দিতে হয়েছে চড়া মাশুল।  

সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা।’

বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামনে এখন কী? সবচেয়ে সহজ উত্তর, পাকিস্তান সিরিজ। ব্যস্ত সূচিতে এরপর আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেট মিলিয়ে আসতে থাকবে একের পর এক খেলা। আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব সিরিজও আছে সামনে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় আসরে বাংলাদেশের পথ চলাও শুরু হবে শিগগির। তবে আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের তো নেই এক বছরও! অন্য সংস্করণগুলোর ব্যস্ততার ফাঁকেই তাই ২০ ওভারের ক্রিকেট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে বাংলাদেশের।

মাহমুদউল্লাহ যেমন বলেছেন, অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন। শীর্ষ পর্যায়ের দলগুলোর বিপক্ষে লড়াই করতে অনেক উন্নতি প্রয়োজন। এর জন্য হয়ত সব পর্যায়েই পরিবর্তন প্রয়োজন।