‘বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্কটল্যান্ডের জয় একই সমান্তরালে’

২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন প্রেস্টন মমসেন। এবারও তিনি বিশ্বকাপ আছেন, তবে ধারাভাষ্যকার হিসেবে। অথচ বয়স তার মোটে ৩৪! ২০১৪ সালে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর সেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। সহযোগী দেশগুলোর অধিকার নিয়েও ছিলেন সোচ্চার। তবে স্কটিশ ক্রিকেটের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে ক্রিকেট ছেড়ে দেন ২৯ বছর বয়সেই। এখন তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত চার্টার্ড সার্ভেয়ার। সুযোগ পেলে ধারাভাষ্য দেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে স্কটল্যান্ডের জয়ে উচ্ছ্বসিত সাবেক এই ব্যাটসম্যান মাসকাটে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তুলে ধরলেন এই জয়ের মাহাত্ম্য, স্কটল্যান্ডের সামনে হাতছানি, সহযোগী দেশগুলোর হাহাকারসহ অনেক কিছু।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিমাসকাট থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2021, 08:04 AM
Updated : 20 Oct 2021, 10:59 AM

২০১২ সালে বাংলদেশকে হারানো স্কটল্যান্ড দলে আপনি খেলেছিলেন। এবার ধারাভাষ্যকক্ষে থেকে দেখলেন। বিশ্বকাপের জয়ের আবেদন নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন। তবু যদি দুটি জয়ের তুলনা করাতে বলা হয়?

প্রেস্টন মমসেন:  এবারের জয়ের মাহাত্ম্য অবশ্যই অনেক বেশি। ২০১২ সালের জয়টাও স্মরণীয়, কারণ সেবারই প্রথম স্কটল্যান্ড কোনো পূর্ণ সদস্য দেশকে হারায়, যে কোনো সংস্করণ মিলিয়েই। আজকে দল যে অবস্থানে, সেই ভ্রমনের শুরু ছিল ওই জয় দিয়ে।

এবারের জয় দেশের ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে অনেক বড়। বিশ্বকাপে এবার দলের লক্ষ্য সুপার টুয়েলভ-এ খেলা। ওই জয় ছিল পারফেক্ট শুরু। গ্রুপের শীর্ষে থাকার সুযোগও এখন আছে। সত্যিই পারলে তা হবে অসাধারণ কিছু।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে দারুণ ফর্মে থেকে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে এসেছে। কিন্তু স্কটল্যান্ড ভড়কে যায়নি। চ্যালেঞ্জ নিয়েছে এবং ৪০ ওভার জুড়ে দুর্দান্ত স্কিল দেখিয়েছে। ভুলে যাবেন না, এখানকার কন্ডিশনের সঙ্গে বাংলাদেশের মিলই বেশি।

সব মিলিয়ে ঐতিহাসিক রাত, ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

আপনি ভাবতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশকে হারিয়ে দেবে আপনার দল?

মমসেন: আমার বেশ বিশ্বাস ছিল। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা হতে পার। তবে সত্যি বলতে, বাংলাদেশের অ্যাপ্রোচই ম্যাচটিকে স্কটল্যান্ডের হাতে তুলে দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাটারদের পারফরম্যান্স খুবই হতাশাজনক ছিল। ওরা কোনো ঝুঁকিই নেয়নি। স্রেফ খেলে গেছে এবং স্কটল্যান্ডকে পেয়ে বসতে দিয়েছে।

তবে স্কটল্যান্ডও দারুণ বোলিং করেছে। ১৪০ রান নিয়ে জেতা কখনোই সহজ নয়।

মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ ও সাকিব আল হাসান মিলে তিনশর মতো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছে। আরও ভালো ক্রিকেটার আছে। যে কোনো অবস্থায়ই এই দলের ১৪০ রান তাড়া করা উচিত। সহযোগী দেশের বিপক্ষে তো বটেই। এটা আসলে তুলে ধরছে, স্কটল্যান্ড কতটা ভালো খেলে বাংলাদেশের মতো অভিজ্ঞ একটা দলকে দমিয়ে রাখতে পেরেছে।

স্কটল্যান্ডে তো ক্রিকেটের আবেদন ও জনপ্রিয়তা ততটা নেই। এই জয় কতটা সাড়া ফেলতে পেরেছে বলে জানতে পারছেন?

মমসেন: এই জয় ভালোই নাড়া দিয়েছে। দেশে লোকে উচ্ছ্বসিত, রোমাঞ্চিত এবং খেলাটির জন্য দারুণ ব্যাপার হয়েছে এই জয়ে। ছেলেদের জন্য সমর্থন রাতারাতি অনেক বেড়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে এবং ক্রিকেটাররাও তা অনুভব করতে পারছে।

দেশ থেকে এমন সমর্থন পেয়ে ছেলেদের খুব অনুপ্রাণিতও মনে হচ্ছে। খুবই উজ্জীবিত ওরা, তাড়না ও ক্ষুধা অনেক। বাংলাদেশকে হারানোর পর পাপুয়া নিউ গিনিকেও হারিয়েছে।

বিশ্বমঞ্চে জয় সবসময়ই দারুণ। এই খেলাগুলো স্কাই স্পোর্টসে দেখানো হচ্ছে, লোকের আগ্রহ বাড়ছে। আমি নিশ্চিত, এবারের সাফল্য স্কটল্যান্ডের ক্রিকেট আরও এগিয়ে নিতে, খেলাটাকে আরও ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করবে। আরও অনেক লোকে, শিশু-কিশোররা ক্রিকেটে আগ্রহী হবে, অনেকের দুয়ার খুলে যাবে।

এজন্যই জয়ের ধারা ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সুপার টুয়েলভ খেলা নিশ্চিত করা।

সুপার টুয়েলভ পর্বে খেলতে পারলে স্কটল্যান্ড ক্রিকেটের জন্য সেটির অর্থ কি হবে?

মমসেন: অসাধারণ, বিশাল এবং দারুণ কিছু হবে। আমি আসলে কথায়ও বোঝাতে পারব না কত বড় এক পদক্ষেপ হবে তা আমাদের ক্রিকেটের জন্য। ছেলেরা আরও অনেক ম্যাচ খেলতে পারবে, বিশ্বমঞ্চে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পাবে, শীর্ষ দলগুলির বিপক্ষে অন্তত আরও ৫টি ম্যাচ নিশ্চিতভাবেই খেলতে পারবে, মানে বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে খেলবে, নিজেদের সামর্থ্য দেখাবে, আগেও যেটা বললাম, সব ম্যাচ টিভিতে দেখাবে…বলে শেষ করতে পারব না।

ক্রিকেটাররা আর্থিকভাবে লাভবান হবে, ভবিষ্যতে আরও বড় আর্থিক নিশ্চয়তার দুয়ার খুলে যাবে, ক্রিকেট বোর্ড নতুন স্পন্সর পাবে, নতুন ভক্ত-সমর্থক গড়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ক্রিকেটের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বাড়বে। টিভিতে যখন তারা ছেলেদের খেলতে দেখবে, জিততে দেখবে, সেখানে নিজেরাও সম্পৃক্ত হবে। স্কটল্যান্ডে ক্রিকেটের সার্বিক উন্নতির পথে অনেক সহায়তা করবে।

২০০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে হারানোর পর আয়ার‌ল্যান্ড ক্রিকেটের চিত্র কতটা বদলে গেছে, আমরা দেখেছি। স্কটিশ ক্রিকেটেও তেমন কিছু হতে পারে।

২০১৮ সালে স্কটল্যান্ড ওয়ানডেতে হারিয়ে দেয় ইংল্যান্ডকে। ক্যালাম ম্যাকলাউড ১৪০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন। এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়, দুটির কোনটি স্কটিশ ইতিহাসে ওপরে থাকবে?

মমসেন: দুটি জয়কে আলাদা করা কঠিন। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটির আলাদা মূল্য আছে। কারণ বিশ্বকাপের ম্যাচ, এই জয়ে মূল পর্বে ওঠার সুযোগ থাকছে, পয়েন্ট মিলছে। তাছাড়া ম্যাচের পরিস্থিতির কারণেও, ৫৩ রানে ৬ উইকেট থেকে বাংলাদেশের দারুণ বোলিং আক্রমণের সঙ্গে লড়াই করে ১৪০ করা এবং পরে শিশির ভেজা মাঠে এমন অভিজ্ঞ ব্যাটিং লাইন আপকে আটকে রাখা… সব মিলিয়েই জয়টি স্মরণীয়।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টি শুধু ক্রিকেটে নয়, স্কটিশ ক্রীড়ার ইতিহাসেই সেরা জয়গুলোর একটি। সেটা ছিল ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেটের ম্যাচ। ৩৭১ রান করে ৬ রানে জেতে স্কটল্যান্ড। সেটার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন।

আমার কাছে, দুটিই একই সমান্তরালে। দুটিই স্কটিশ ক্রিকেট ও স্কটিশ ক্রীড়ার ইতিহাসে বড় অধ্যায়। সেই অধ্যায় নিশ্চিতভাবেই শেষ নয় এখানেই!

এই ইতিহাসের অংশ তো আপনিও হতে পারতেন! এখনও দারুণ ফিট মনে হচ্ছে আপনাকে। বয়সও মোটে ৩৪। অল্প বয়সে ক্রিকেট ছেড়ে না দিলে হয়তো এখন মাঠের ভেতরেই থাকতেন। আক্ষেপ হচ্ছে না?

মমসেন: নাহ, আক্ষেপ নেই। খেলাটা ছাড়তে হওয়ায় খারাপ লাগা তো স্বাভাবিক। সেটা সবসময়ই থাকে। এখন নতুন করে আক্ষেপ নেই।

২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমি দলের অধিনায়ক ছিলাম। খারাপ খেলিনি আমরা। পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, আমাদের অবশ্যই আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়েকে হারানো উচিত ছিল। মূল পর্বে খেলা উচিত ছিল।

তবে ওই সময়টায় আমরা এত অভিজ্ঞ ছিলাম না। এই ৫ বছরে দলটা অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে, অনেক দূর এসেছে। ২০১৬ আসরে খেলা ১০ জন এবারও আছে। তার মানে, অনেক অভিজ্ঞ দল।

ওরা ওদের যোগ্যতা দিয়েই আজকের জায়গায়। আমিও নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে খুশি। অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ক্রিকেটের বাইরে এখন আমার পেশাদার জীবন আছে। সেখানে অনেক ব্যস্ত থাকি। তার পরও অন্য ভূমিকায় বিশ্বকাপের অংশ হতে পেরে, ক্রিকেটের সঙ্গে থাকতে পেরে এবং আইসিসি ও স্টার স্পোর্টসে সঙ্গী হিসেবে স্কটল্যান্ড ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা অনুসরণ করতে পেরে আমি গর্বিত ও সৌভাগ্যবান। কারণ, আমি ক্রিকেট ভালোবাসি এবং আমার দলের এগিয়ে চলার এই গল্পটি দারুণ, দেখতে দারুণ।

আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন, স্কটিশ ক্রিকেটে এমন পেশাদারিত্ব আসুক যেন আপনার মতো অল্প বয়সে কাউকে ক্রিকেট ছাড়তে না হয়?

মমসেন: এটা খুব ভালো একটা পয়েন্ট। অবশ্যই চাই এবং সেটিই হওয়া উচিত। পেশাদারীত্ব ছাড়া তো এগিয়ে চলা কঠিন। ছেলেরা যেন লম্বা ক্রিকেট ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে পারে, নির্ভার থাকতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। যতদিন সামর্থ্য আছে, স্কটল্যান্ড ক্রিকেট দলের হয়ে অবদান রাখতে পারে, সেটা ৩৫ বছর হোক বা ৩৬-৩৭… সবাই যেন নিশ্চিন্তে খেলতে পারে।

উন্নতি হচ্ছে এখানে। এই ধরনের টুর্নামেন্টে সাফল্য পেলে তা আরও দ্রুতগতিতে হবে।

এবার যদি সুপার টুয়েলভ পর্বে খেলতে পারে স্কটল্যান্ড, এরপর কি? টেস্ট মর্যাদার লক্ষ্য?

মমসেন: হতে পারে। তবে আমার মতে, টেস্ট মর্যাদার ধারণাটি নিয়ে আইসিসির নতুন করে ভাবা উচিত। টেস্ট খেলুড়ে না হলে কেন বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ মিলবে না? স্কটল্যান্ড অবশ্যই টেস্ট মর্যাদা চায়। তবে আমরা সাদা বলের ক্রিকেটই বেশি খেলি, লাল বলের ক্রিকেট খুব একটা হয় না।

আমরা দেখিয়েছি এর মধ্যেই, ৫০ ওভারের ক্রিকেটে আমরা লড়াই করতে পারি, ২০ ওভারের ক্রিকেটে লড়াই করতে পারি। ইংল্যান্ড ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা অবস্থায় ওদেরকে আমরা হারিয়েছি, এবার টি-টোয়েন্টিতে ছয় নম্বর দল বাংলাদেশকে হারালাম। আমরা সাদা বলেই আরও সুযোগ চাই।

আমরা চাই আরও বেশি ম্যাচ ও সফর। বাংলাদেশ সফর করতে চাই, শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়েতে যেতে চাই। নিয়মিত খেলতে চাই। আমাদেরকে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। আইসিসির ভাবা উচিত। টেস্ট মর্যাদা পাওয়া দেশগুলি এমনিতেই বেশি ম্যাচ খেলে। তা খেলুক। কিন্তু আমরা কেন কম খেলব?

আপনি সবসময়ই সহযোগী দেশগুলোর অধিকার নিয়ে সোচ্চার। ম্যাচ বাড়ানোর কথা বললেন। আইসিসি আর কি কি করতে পারে?

মমসেন: প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে আরও বেশি ক্রিকেটার প্রয়োজন। স্কটল্যান্ডের নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজন। তাদের পারিশ্রমিকও আরও বাড়ানো প্রয়োজন। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার কথা বাদই দিলাম, বাংলাদেশের সঙ্গেও তুলনায়ই আসে না আমাদের ক্রিকেটারদের আয়।

আমাদের ক্রিকেটারদের বেশির ভাগেরই ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি অন্য চাকরি বা জীবিকার কথা ভাবতে হয়। এসব জায়গায় আইসিসি সহায়তা করতে পারে। এই ধরনের বোর্ডগুলির পাশে আরও বেশি করে থাকতে পারে।

আর ম্যাচ খেলার কথা তো বললামই। আমি নিজে যখন খেলেছি, অধিনায়ক ছিলাম, বেশি বেশি ম্যাচ পাওয়ার জন্যই সবচেয়ে বেশি কথা বলেছি, লড়াই করেছি। শুধু আমাদের নয়, সব সহযোগী দেশের জন্যই। বেশি বেশি ম্যাচ খেলার বিকল্প নেই।

আমি নিশ্চিত করে জানি, বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে স্কটল্যান্ড সব দলের সঙ্গে লড়াই করতে পারবে। সেই সুযোগ থেকে কেন আমাদের বঞ্চিত করা হবে!