ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেটারদের আনন্দের এক দিন

ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট দলের বিশ্ব জয়ের সম্ভাবনা দেখেন বিসিবির এই বিভাগের প্রধান আকরাম খান।

শাহাদাৎ আহমেদ সাহাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2023, 02:44 PM
Updated : 18 May 2023, 02:44 PM

কেউ কেউ ছবি তুলছেন দল বেধে, কেউ আবার পরিবারের সদস্যদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন মিরপুরের সবুজ গালিচা। বন্ধু হাবিবকে বাইরে থেকেই ড্রেসিং রুমের ঝলক দেখালেন মাহফুজুর রহমান। বন্ধুর তো বটে, তার নিজের চোখে মুখেও তখন তৃপ্তির ছাপ। মাহফুজের মতো প্রথমবার শের-ই বাংলার মাঠে খেলা, ড্রেসিং রুম ভাগাভাগি করার আনন্দ ছুঁয়েছে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট টুর্নামেন্টের অন্য ক্রিকেটারদেরও। পাশাপাশি কিছু দাবিও জানালেন তারা।

মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার হয়েছে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট টুর্নামেন্টের প্রথম আসরের ফাইনাল ম্যাচ। ইউনিসার্ভ ডিজেবল ক্রিকেট টিম অব বাংলাদেশকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দা ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড (বিসিএপিসি) দল।

দুপুরে শুরু হওয়া ম্যাচ শেষ হতে হতে মিইয়ে গেছে রোদের তেজ। বিকেলের মিষ্টি রোদে উল্লাসে মেতেছেন বিসিএপিসি দলের সদস্যরা। কারও হয়তো হাত নেই পুরোটা, কেউ পায়ের সমস্যায় দৌড়াতে পারছেন না সাবলীলভাবে। তবু ম্যাচে নিবেদনের পুরোটা দিয়েই লড়েছেন তারা। শিরোপা জেতার উচ্ছ্বাসটাও তাই ছিল দেখার মতো।

গত ৬ মে টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী দিন শারীরিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ক্রিকেটারদের উৎসাহ জোগাতে পূর্বাচলের শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম সাইটে উপস্থিত ছিলেন বিসিবির ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট বিভাগের প্রধান আকরাম খান ও জাতীয় দলের নির্বাচক হাবিবুল বাশার।

সমাপনী দিনে হাজির হন বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান পাপন। তার সঙ্গে প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরি, আকরাম, বিসিবির মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান তানভির আহমেদ টিটু, প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিনরা।

বিসিবির প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার গ্রহণ করে হাসিমুখে ফিরলেন মাহফুজুর রহমান। ক্রেস্ট দিলেন বন্ধু হাবিবের কাছে। ঠিক পরপরই আবার তাকে যেতে হলো টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার নিতে। এবারও তার পুরস্কার জমা পড়ল বন্ধুর হাতে।

তিন মাস বয়সে হাত পুড়ে যাওয়ার কারণে ডান হাতের একটি আঙুল হারান মাহফুজ। ওই হাতে শক্তি পান না তিনি। শুধু বাম হাতের জোরেই টুর্নামেন্টে নেন ১০ উইকেট, ব্যাটিংয়ে করেন ১৪০ রান। জোড়া পুরস্কার জিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে দেশের মূল ক্রিকেট মাঠে খেলার অনুভূতি জানালেন তিনি।

“একটা খেলোয়াড় সব সময় স্বপ্ন দেখে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। সেদিক থেকে বিসিবি আমাদেরকে একটা সুযোগ করে দিয়েছে এই মাঠে খেলার। সুন্দর একটা টুর্নামেন্ট হয়েছে। খুব ভালো লাগছে। সবার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা।”

“সবারই একটা স্বপ্ন থাকে যে, মিরপুরে ভালো একটা উইকেটে খেলা। এত সুন্দর মাঠ। এখানে খেলার অনুভূতি আসলে অন্যরকম। আর টুর্নামেন্ট সেরা হতে পেরেছি, খুব ভালো লাগছে আমার।”

২০২১ সালে বিকেএসপির ডিগ্রি বিভাগে ভর্তি হয়েছেন মাহফুজ। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব না জেনেই ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেটে ভালো কিছুর আশায় বুক বেধেছেন তিনি।

“অনেক দিন ধরে আমাদের ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেটে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, অনেক পিছিয়ে ছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও অনেক সমস্যা থাকে। এখন যেহেতু শুরু হয়েছে। আশা করি সমস্যা আর থাকবে না।”

মাহফুজের দলের দ্রুপম পত্রনবিশ ১৭ উইকেট নিয়ে হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা বোলার। জন্মের পর ডান হাতের সবগুলো আঙুল পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয়নি তার। সাকিব আল হাসানকে আইডল হিসেবে নিয়ে তিনি বাম হাতেই পূরণ করছেন নিজের ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন।

ম্যাচ শেষ করে দ্রুতই ড্রেসিং রুমে ঢুকে যান দ্রুপম। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে তিনিও জানান নিজের রোমাঞ্চের কথা।

“এটা তো অনেকেরই স্বপ্ন থাকে, এই মাঠে খেলার। আজকে খেলতে পারলাম। সত্যিই খুব ভালো লাগছে। যারা ক্রিকেট খেলে, ছোটবেলা থেকে সবারই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করার। এখন একটা সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আস্তে আস্তে হয়তো পূরণ হবে।”

দেশে বিচ্ছিন্নভাবে নানা সময়ে হুইল চেয়ার ক্রিকেট, ব্লাইন্ড ক্রিকেট বা ফিজিক্যালি ডিজেবলড ক্রিকেট খেলা হয়েছে। তবে সরাসরি বিসিবির তত্ত্বাবধানে পূর্ণাঙ্গ কোনো টুর্নামেন্ট এবারই প্রথম। নিয়মিত এমন আয়োজনের পাশাপাশি আর্থিক নিরাপত্তারও দাবি জানালেন দ্রুপম।

“আমাদের মতো এমন অনেক ক্রিকেটারই আছে যারা ভালো খেলে কিন্তু সুযোগের অভাবে খেলতে পারছে না। এরকম টুর্নামেন্ট যদি নিয়মিত হয় তাহলে অনেক ভালো ক্রিকেটার বের হবে। আমরা আসলে দেশের জন্য কিছু করতে চাই। আশা করব, বিসিবি আমাদের আরও বেশি বেশি খেলার সুযোগ দেবে।”

“আমাদের এখানে কেউই পেশাদার ক্রিকেটার নয়। কেউ হয়তো চাকরি করে, ছুটি নিয়ে খেলতে এসেছে। এখন বোর্ড যেহেতু একটা দায়িত্ব নিয়েছে, উইং খুলেছে, দেখা যাক কী হয়। আমাদের অর্থনৈতিক সাহায্যটা আসলেই দরকার। কেউই আসলে এটিকে পেশা হিসেবে নেয়নি এখনও। আর্থিক নিরাপত্তা পেলে অনেকেই হয়তো এগিয়ে আসবে।”

মাহফুজ-দ্রুপমের মতো টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যানও চ্যাম্পিয়ন দলের। টুর্নামেন্টে ৫৩ বলে ১০৯*, ৩৩ বলে ৫৩* রানের ইনিংসসহ সর্বোচ্চ ২২০ রান করেছেন শাকিল হোসেন। জন্মের পর একটি দুর্ঘটনায় বাম পায়ের কুচকিতে টান লেগে সেটি ডান পা থেকে কিছুটা ছোট হয়ে যায়। ফলে হাঁটাচলার সমস্যা নিয়েই বেড়ে ওঠেন তিনি।

সেরা ব্যাটসম্যানের পুরস্কার নিয়ে নিজের ভালো লাগার কথা বললেন শাকিল।

“এবারের টুর্নামেন্ট আমাদের খুব ভালো কেটেছে। বিসিবির প্রথম ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড টুর্নামেন্টে সেরা ব্যাটসম্যান হতে পেরেছি। আমার খুবই ভালো লাগছে। একটা অপরাজিত সেঞ্চুরি করেছি, একটা ফিফটিও ছিল। সবকিছু মিলিয়ে ভালো হয়েছে। এটি দিয়ে আমাদের পথচলা শুরু হলো।”

ফাইনালে দারুণ ফিল্ডিং করে নজরকাড়া সাজ্জাদ হোসেন শুনিয়েছেন শের-ই বাংলার ড্রেসিং রুমে বসতে পারার রোমাঞ্চের কথা।

“সবকিছু মিলিয়ে ভালো লাগছে। এখানে খেলতে পেরেছি ভালো লেগেছে। (ড্রেসিং রুম) শেয়ার করে খুব ভালো লাগছে। আমরাও জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের মতো ওখানে বসতে পেরেছি। যেহেতু এটা বিসিবি টুর্নামেন্ট, সামনে তো এখান থেকে জাতীয় দল হবে। ভালো কিছুর আশা করছি।”

চ্যাম্পিয়ন দলের জাবেদ ভূঁইয়ার কণ্ঠে শোনা গেল কিছুটা অনুযোগ।

“এবারই প্রথম এমন টুর্নামেন্ট করল বিসিবি। এর আগে আমাদের তেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি। বছরে একবার খেলা হয়, তখন এক মাসের জন্য ডাকা হতো। কিন্তু সবাই যদি খেলার মধ্যে থাকত, তাহলে আরও অনেক উন্নতি হতো। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারতের দলগুলো অনেক ভালো। কারণ ওরা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে থেকে ১২ মাসই সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পায়। আমাদেরও সেরকম হবে আশা করি।”

ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেটারদের দাবির কথা জানানো হয় বিসিবির এই বিভাগের প্রধান আকরাম খানকে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আশার কথা শোনান তিনি।

“এবার আমাদের যতটুকু সম্ভব হয়েছে (আর্থিক সহায়তা) দিয়েছি। যাতায়াত ভাড়া, দৈনিক ভাতাসহ সবই দিয়েছি। সামনে খেলার সব সরঞ্জামও দেওয়া হবে। আস্তে আস্তে পুরো জিনিসটা একটা কাঠামোতে আসছে। এখন একটা দল তৈরি হোক। এরপর বেতনভুক্ত করার ব্যাপারে এগোবো।”

“এখন তো বৈশ্বিকভাবেও টুর্নামেন্ট শুরুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল করবে। আইসিসিও হয়তো সামনে বড় পরিসরে আয়োজন করবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের যেই মানের ক্রিকেটার আছে তাতে আমাদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।”