টুয়েলভথ ফেইল, থ্রি ইডিয়টস, পিকে, সাঞ্জুর মতো চলচ্চিত্র উপহার দেওয়া বিধু বিনোদ চোপড়ার ছেলে আগ্নি চোপড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পা রেখেই চার ম্যাচে পাঁচ সেঞ্চুরিতে গড়েছেন ইতিহাস।
Published : 01 Feb 2024, 04:10 PM
ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের উজ্জ্বল নক্ষত্র বলা যায় বিধু বিনোদ চোপড়াকে। গত বছর আলোড়ন তোলা ‘টুয়েলভথ ফেইল’ সিনেমাটির পরিচালক তিনি। রাজকুমার হিরানি পরিচালিত মুন্না ভাই সিরিজ, থ্রি ইডিয়টস, পিকে ও সাঞ্জুর মতো সিনেমাগুলোর প্রযোজক ছিলেন বিধু বিনোদই। প্রযোজক-পরিচালক হিসেবে গত চার দশকে উপহার দিয়েছেন স্মরণীয় সব চলচ্চিত্র। অথচ তার ছেলে আগ্নি দেব চোপড়ার তেমন আগ্রহই নেই রূপালী পর্দার প্রতি। তিনি যে মজে আছেন ক্রিকেটের প্রেমে!
বাবা নিজের আঙিনায় তারকা বনে গেছেন অনেক আগেই। সেই তুলনায় ছেলে আগ্নির কেবলই পথচলার শুরু। তবে পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরুতেই যা করে দেখাচ্ছেন তিনি, সেটাই বা কম কিসে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পা দিয়েই গড়েছেন ইতিহাস।
ভারতের ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির শীর্ষ প্রতিযোগিতা রঞ্জি ট্রফির প্লেট লিগে মিজোরামের হয়ে খেলছেন আগ্নি। এই মাসের শুরুর দিকে সিকিমের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে প্রথম ইনিংসেই ১৯ চার ও ৭ ছক্কায় খেলেন ১৭৯ বলে ১৬৬ রানের ইনিংস। অভিষেকে জোড়া সেঞ্চুরিই করে ফেলেছিলেন প্রায়, দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৪ বলে ৯২ করে আউট হয়ে যান।
সেই যে শুরু, এরপর আর থামাথামির নাম নেই। পরের ম্যাচে নাগাল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ১৫০ বলে ১৬৪। এবার দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫ রানে আউট হয়ে যান।
আগ্নির স্বপ্নের রথ চলছে তো চলছেই। আরুনাচলের বিপক্ষে ১১৪ (৮৭ বলে) ও ১০ রান করার পর মেঘালয়ের সঙ্গে দুই ইনিংসেই তিন অঙ্কের উষ্ণ ছোঁয়া পান তিনি। এবার প্রথম ইনিংসে করেন ৯০ বলে ১০৫, দ্বিতীয় ইনিংসে ৭১ বলে ১০১।
এই পরিক্রমায় অসাধারণ এক রেকর্ডে নাম লিখিয়ে ফেলেন ২৫ বছর বয়সী বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান।
ক্রিকেট ওয়েবসাইট ইএসপিএনক্রিকইনফো খেলাটির বিভিন্ন পরিসংখ্যান রাখা শুরুর পর থেকে, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ক্যারিয়ারের প্রথম চার ম্যাচেই সেঞ্চুরি করা একমাত্র ক্রিকেটার আগ্নি। তাকে নিয়ে তাই আলোচনা এখন তুঙ্গে।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৫ ম্যাচ খেলে তার গড় এখন ৯৫.৮৭, স্ট্রাইক রেট ১১১.৮০! টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও তার শুরুটা হয়েছে বেশ ভালো। ৭ ম্যাচে ২ ফিফটিতে ৩৩.৪২ গড়ে করেছেন ২৩৪ রান। স্ট্রাইক রেট এখানে ১৫০.৯৬!
আগ্নির জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। তবে ক্রিকেটের পথ ধরে বেড়ে ওঠা মুম্বাইয়ের হয়ে। অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-২৩ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলেছেন তাদের হয়েই। কিন্তু তুমুল প্রতিযোগিতার কারণে মুম্বাইয়ে ক্রিকেটে খেলার তেমন সুযোগ মিলছিল না তার। তাই কোচ খুশপ্রিত সিংয়ের পরামর্শে মিজোরামের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
সিদ্ধান্তটা যে একটুও ভুল হয়নি, তা তো এখন পরিষ্কার। আগ্নিও বেশ স্বচ্ছন্দে আছেন এই দলে, পিটিআইকে বললেন সে কথা।
“মিজোরামে আসার পর সবাই আমাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং দলের অংশ করে নিয়েছে। আমার কখনও মনে হয়নি আমি বাইরের কেউ। আমাকে কিছু মিজো শব্দ ও বাক্যাংশ শেখানো হয়েছে। আমার এমনও মনে হচ্ছে না যে, একেবারে অচেনা জায়গায় এসে পড়েছি।”
রঞ্জি ট্রফিতে ভারতের ঘরোয়া সার্কিটের শীর্ষ ৩২টি দল এলিট লিগে চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলে। আর পরের ৬টি দলকে নিয়ে আয়োজন করা হয় প্লেট লিগ, যেখানে পাঁচটি দল থাকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে। প্লেট গ্রুপের ফাইনালে জায়গা করে নিতে পারলেই পরের মৌসুমে এলিট গ্রুপে খেলার সুযোগ মেলে।
দেশের তারকা সব ক্রিকেটাররা খেলেন এলিট গ্রুপে। তাই প্লেট গ্রুপের সঙ্গে এলিট গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য অনেক। আগ্নির রেকর্ড আর পারফরম্যান্সের মান নিয়ে তাই বাঁকা চোখে তাকানোর লোকও কম নেই। তবে সেদিকে না তাকিয়ে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ভালো পারফর্ম করে দলকে এলিট গ্রুপে তুলে নেওয়ার লক্ষ্যে।
“মানুষের যা বলার তা বলবেই, তবে দিনশেষে এটাই আমার পারফরম্যান্স। একই বিভাগে অনেক ক্রিকেটার খেলছে, কিন্তু খুব বেশি রান তারা করতে পারছে না। মান তো সবার জন্যই সমান।”
“আমি বর্তমানে থাকার চেষ্টা করছি। আমার লক্ষ্য মিজোরামকে এলিট বিভাগে নেওয়া। আমরা যদি এলিট ডিভিশনে খেলতে পারি, তাহলে বোলিংয়ের মানের দিক থেকে চিন্তা করার কিছু নেই এবং আমি মিজোরামের হয়েই খেলব।”
চাইলেই বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারতেন আগ্নি। বলিউডে পরিবারতন্ত্র তো চলে আসছে যুগ যুগ ধরেই। আগ্নির মা অনুপামা চোপড়া সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক। চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার গড়া আগ্নির জন্য অন্তত ক্রিকেটের চেয়ে অনেক সহজ হতো। কিন্তু আগ্নিকে আকর্ষণ করেছে ভিন্ন এক জগৎ।
প্রশ্নটা তাকে নিয়মিতই শুনতে হয়েছে। কিন্তু সবসময়ই বলেছেন, তিনি তার স্বপ্নের পথেই আছেন।
“ছোটবেলা থেকেই আমাকে জিজ্ঞাস করা হতো, আমি সিনেমায় আসব কি না। তবে আমি কখনোই ভাবিনি সিনেমায় আসার কথা। আমার ভাবনায় কখনও আসেনি যে, ‘আমার বাবা সিনেমা বানায়, তাই আমার এখানে যাওয়া উচিত, আমার জন্য এটাই হবে সহজ পথ’।”
“চলচ্চিত্রের প্রতি আমার কখনোই আগ্রহ ছিল না। বলতে চাচ্ছি, আমি সিনেমা দেখতে পছন্দ করি এবং সময় ভালো কাটে। কিন্তু এটা কখনোই আমার প্যাশনের জায়গা ছিল না।”
পরিবার থেকে কখনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি তাকে। তার বাবার চাওয়া শুধু একটাই ছিল, পেশা যেটাই হোক, সেই আঙিনার যেন সেরাদের সেরা হয় তার সন্তানরা। আগ্নি বললেন, বাবার মতো কঠোর পরিশ্রম করে নিজের স্বপ্নপূরণের পথে ছুটছেন তিনি।
"আমি ও আমার বোন যখন ছোট ছিলাম, বাবা তখন তার বাবার একটি কথা আমাদেরকে শুনিয়েছিলেন, ‘যদি তুমি রাস্তায় বসে জুতো সেলাই করতেও চাও, তবু ওই রাস্তার সেরা মুচি হও’।”
“ইচ্ছামতো কাজ করার স্বাধীনতা বাবা আমাদের দিয়েছেন। তবে বলেছেন, যেটাই করি না কেন, সেখানে সবচেয়ে সেরা হতে। প্রতিভা কেবল একটা পর্যায় পর্যন্ত নিতে যেতে পারে, বাকিটা নির্ভর করে কাজের ওপর, আর আমি এটা বাবার সিনেমার মধ্যে দেখেছি। আমার বাবা ও মা তাদের পেশায় যততা শ্রম দেন, আমার মনে হয় এটা আমার ওপর প্রভাব ফেলেছে।”
সেই প্রভাবকে সঙ্গী করে কতদূর যেতে পারবেন আগ্নি, তা সময়ের হাতেই তোলা রইল। তবে প্রভাতের সূর্যে অন্তত ঝলমলে দিনেরই ইঙ্গিত।