‘আমি দলের সবচেয়ে বুড়ো হলেও ফিটনেসে ২৫ বছর বয়সীর সঙ্গে তুলনা দিতে পারেন’

বয়স ৪১ ছুঁইছুঁই হলেও ফিটনেস ও পারফরম্যান্সে তরুণদের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিচ্ছেন শোয়েব মালিক।

ক্রীড়া প্রতিবেদকসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2023, 01:57 PM
Updated : 29 Jan 2023, 01:57 PM

এই ১ ফেব্রুয়ারি বয়স পূর্ণ হবে ৪১, কিন্তু শোয়েব মালিককে দেখে বোঝার উপায় নেই। তার ফিটনেস এখনও দুর্দান্ত। দেশে-বিদেশে ফ্যাঞ্চাইজি লিগে পারফর্মও করে চলেছেন। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে আসছেন তিনি সেই ২০০১ সাল থেকে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন, ২০১৫ সাল থেকে খেলে আসছেন বিপিএলে। এবার খেলছেন রংপুর রাইডার্সের হয়ে। সিলেটে দলের অনুশীলনের ফাঁকে রোববার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে পাকিস্তানের এই ক্রিকেটার কথা বললেন তার বয়স-ফিটনেস, বাংলাদেশের ক্রিকেট, বিপিএল, নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ভবিষ্যতসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে। 

আপনার দলে মোহাম্মদ নাঈম শেখ, শামীম হোসেনের মতো তরুণরা আছে। এমনকি অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান বেশ কিছু দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন, কিন্তু এখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। তাদেরকে কাছ থেকে দেখছেন আপনি। তাদের নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি ও তাদের প্রতি পরামর্শ কি? 

শোয়েব মালিক: আমার ভাবনা খুবই সাধারণ, কঠোর পরিশ্রম করে যাও। সবটুকু প্রতিভাই ওদের আছে। আমি নিশ্চিত, পরিশ্রম করে গেলে ওরা ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দিতে শুরু করবে। ওদের খেলায় প্রতিভার ঝলক আমি দেখেছি। আশা করি, ওরা দলের জন্য ভালো করবে। এই দলের হয়ে (রংপুর রাইডার্স) যেমন, বাংলাদেশের হয়েও করবে। 

তারা কি আপনার সঙ্গে কথা বলে? প্রশ্ন করে? 

মালিক: হ্যাঁ, তারা আমাকে অনেক প্রশ্ন করে। যেহেতু আমি দলের সবচেয়ে বেশি বয়সী ক্রিকেটার, অনেকেই আমার কাছে আসে এবং নানা কিছু জানতে চায়। আমারও ওদেরকে সহায়তা করতে পেরে ভালো লাগে। ব্যাপারটি দলে দলের ভেতর নিজের অভিজ্ঞতা ভাগভাগি করে দেওয়া। এমনকি অন্য দল থেকে কেউও যদি আসে, আমি তার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করি। যে কোনো ক্রিকেটারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি সবসময়ই তৈরি আছি। 

অনেক বছর ধরে আপনি বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলছেন। কি কি পরিবর্তন দেখছেন? 

মালিক: বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক কিছুই বদলে গেছে। এখানকার ক্রিকেটের পরিচিত আছে এখন বিশ্বের সব জায়গায়। তারাও তো এখন বিশ্বের নানা জায়গায় লিগগুলোতে সুযোগ পাচ্ছে। নিজেদের কন্ডিশনে বাংলাদেশের সাফল্যের হার তো দুর্দান্ত। 

একটা জায়গায় তাদের এখনও উন্নতির জায়গা আছে, তা হলো দেশের বাইরের পারফরম্যান্সে। তবে এই দেশে প্রতিভার কথা যদি বলি, যথেষ্টই আছে। এখন প্রয়োজন হলো তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া, যেন তারা নিজেদের খেলায় উন্নতি করতে পারে এবং দেশের বাইরেও ভালো করতে পারে। 

আর দুই দিন পরই আপনার বয়স পূর্ণ হবে ৪১। এখনও বেশ দাপটে খেলে যাচ্ছেন। এই বয়সে খেলা চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা কোথায় পান? 

মালিক: বিশ্বাস করুন, যদিও আমি দলের সবচেয়ে বুড়ো ক্রিকেটার, তবে আমার ফিটনেস আপনি তুলনা করতে পারেন ২৫ বছর বয়সী কোনো ক্রিকেটারের সঙ্গে। আমাকে যা অনুপ্রাণিত করে তা হলো, আমি এখনও মাঠে আসা উপভোগ করি। অনভুব করি, সেই ক্ষুধাটা এখনও আছে। এই দুটি ব্যাপার (উপভোগ আর ক্ষুধা) যতদিন আছে, ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাব। 

এই কারণেই অবসরের কথা চিন্তাও করছি না আমি। যদি সম্ভব হয়, আমি অবসর নিতে চাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে কিংবা পরিপূর্ণ ক্রিকেট খেলে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই প্রক্রিয়াই (অবসরের) শুরু হয়নি এবং নিজের ক্রিকেট আমি উপভোগ করছি। যেখানেই সুযোগ মেলে, আমি যাই এবং খেলি। 

তার মানে, পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার ইচ্ছে আপনার এখনও আছে? 

মালিক: টেস্ট ও ওয়ানডে থেকে তো অবসর নিয়েছিই। টি-টোয়েন্টি আমি এখনও খেলতে প্রস্তুত আছি, পুরোপুরিই তৈরি আছি এবং যখনই সুযোগ পাই, নিজের সেরাটা দিয়ে যাচ্ছি। 

সম্প্রতি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ে বদল এসেছে। আপনার জাতীয় দলের ফেরার সম্ভাবনা কিংবা আশা কি তাতে বেড়ে গেছে? 

মালিক: দেখুন ভাই, ওসব নিয়ে আমি একটুও ভাবি না। ওই ধরনের ভাবনা আমার মাথা ও মনে আসেই না। কারণ, আমি একজন ক্রিকেটার এবং জীবনে অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে। এই পর্যায়ে এসে, এসব ব্যাপার আমাকে আর ভাবায় না।

একজন অ্যাথলেট হিসেবে… এই বার্তাটি সব অ্যাথলেটের জন্যই, দলীয় খেলায় কখনোই ভাবার কিছু নেই যে কে তোমার পক্ষে আছে, কে নেই। লক্ষ্য থাকা উচিত ঘাম ঝরানোয়, কঠোর পরিশ্রমে ভরসা রাখা এবং নিজের প্রতি ও আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখা। 

আর মাত্র দুটি ম্যাচ খেললেই ৫০০ টি-টোয়েন্টি পূর্ণ হবে আপনার। এত বছর ধরে খেলছেন। আপনার শুরুর সময়ের চেয়ে টি-টোয়েন্টি এখন কতটা বদলে গেছে? 

মালিক: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট শুরুর সময় ১৩০-১৪০ রান অনেক ক্ষেত্রেই ছিল যথেষ্ট। এখন উইকেট যদি ভালো হয়, ২২০-২৩০ রানও নিরাপদ নয়। শুরুর দিনগুলোর চেয়ে তাই অনেক কিছুই এখন বদলে গেছে। ক্রিকেটার হিসেবে সবার দায়িত্ব সময়ের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকা, যেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে টিকে থাকা যায় এবং নিজের খেলার ধারাবাহিক থাকা যায়, দলের জন সহায়ক থাকা যায়। বছরের পর বছর ধরে আমি এটাই করার চেষ্টা করছি যেন সময়ের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকা যায়, যাতে যেখানেই খেলতে যাই না কেন, দলের চাহিদা যেন মেটাতে পারি। 

টি-টোয়েন্টি যখন এলো, তখন কি মনে হলো, এটিই আপনার সবচেয়ে উপযুক্ত সংস্করণ? 

মালিক: মোটেই তা নয়। তিনশর কাছাকাছি (২৮৭টি) ওয়ানডে খেলেছি আমি! কখনোই ভাবিনি যে এটাই আমার সংস্করণ বা এরকম কিছু। ক্রিকেটার হিসেবে দায়িত্ব হলো নিজের কাছে জিজ্ঞেস করা, এরপর মনের ভেতর থেকে যা আসবে, সেটায় অটল থাকা। নিজের জন্য লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এটা করে আসছি। 

বিশ্বের নানা দেশের লিগে খেলেছেন আপনি। সেসবের সঙ্গে তুলনা করলে বিপিএল কতটা উপভোগ করেন? 

মালিক: বাংলাদেশের মানুষ আমি খুব ভালোবাসি। তারা খুবই সৌহার্দপূর্ণ। তারা মাঠে আসে এবং দলকে মন থেকে সমর্থন করে। এখানকার খাবারও খুব ভালো লাগে আমার, মাছ খুব পছন্দ করি। এমনকি এই দেশের ক্রিকেটাররাও খুব ভালো। ওরা উন্নতি করতে চায় নিজেদের খেলায়। বাংলাদেশে যখন আসি, তখন সবকিছু মিলিয়েই একটা কমপ্লিট প্যাকেজ পাই। একটা ব্যাপারেই শুধু অভিযোগ, তা হলো ট্রাফিক জ্যাম। 

বিপিএলের ক্রিকেটীয় মান? 

মালিক: ক্রিকেটের মান এখানে খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। কারণ, ব্যাটসম্যানরা এখানে ব্যাটিং বান্ধব উইকেট তেমন পায় না। কন্ডিশনও এখানে একেক জায়গায় একেকরকম। চট্টগ্রামে একরকম, ঢাকায় আরেকরকম, সিলেটে আবার ভিন্ন। একেক ভেন্যুতে একেকরকম কন্ডিশন পেলে খেলায় উন্নতির সেরা সুযোগ মেলে। এজন্যই বাংলাদেশে আসতে এবং এখানে খেলতে ভালো লাগে।

নেটে আপনাকে বোলিং অনুশীলন করতে দেখা গেল অনেক। বোলিংয়ে নতুন কিছু যোগ করার চেষ্টা করছেন? 

মালিক: বোলিংয়ে গোটা দুয়েক বৈচিত্র নিয়ে কাজ করছি। কারণ, টি-টোয়েন্টিতে অফ স্পিনাররা আক্রমণে আসা মাত্রই ব্যাটসম্যানরা আগ্রাসী হতে শুরু করে। এজন্যই কিছু বৈচিত্র নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি আমি এবং কাজ করছি সেসব নিয়ে। 

স্পিন খেলায় আপনি দুর্দান্ত। বিশেষ করে স্পিনে পায়ের কাজ আপনার দারুণ। ডাউন দা উইকেট এলে ছক্কা যেন নিশ্চিত! 

মালিক: ছক্কা হয় যদি বল জায়গায় থাকে। বল যদি আমার স্লটে না থাকে, তখন সেভাবেই সামলাতে হয়। এটা অনুশীলন থেকে আসে। কঠোর পরিশ্রম থেকে আসে। পরিশ্রম ছাড়া ধারাবাহিকভাবে কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। পরিশ্রমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এরপর নিজের ওপর বিশ্বাস। 

অনুশীনের মোহাম্মদ রফিকের (রংপুরের সহকারী কোচ ও বাংলাদেশের কিংবদন্তি স্পিনার) বোলিংয়ে ব্যাট করছিলেন আপনি। একসময় তার বিপক্ষে খেলেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। এখন কেমন মনে হচ্ছে তাকে? 

মালিক: আমি তাকে বয়স জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন যে তার বয়স ৫৭ বছর। তবে এখনও তিনি নেটে যেভাবে বল করেন, এমনকি (গা গরমের) ফুটবলে তিনি যেভাবে খেলেন, এখনও তিনি বেশ ফিট! 

তার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেছি। দেশের জন্য তিনি সত্যিই ভালো করেছেন। মানুষ হিসেবেও তিনি দারুণ। কোচিং স্টাফের অন্যরাও ক্রিকেটারদের নানাভাবে সাহায্য করেন। এই কোচিং স্টাফ বেশ তরুণ হলেও তাদের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, ম্যাচ হারলেও তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে না। এটিই সবচেয়ে জরুরি। কৃতিত্ব তাই তাদের প্রাপ্য। গোটা দলকে একসুতোয় গেঁথে রাখছেন তারা। অনুশীলনের সম্ভাব্য সেরা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। 

২০ ওভারের প্রায় ৫০০ ম্যাচ খেলে ১২ হাজারের বেশি রান আপনার, ফিফটি ৭৫টি। কিন্তু এখনও সেঞ্চুরি নেই। আপনার ব্যাটিং পজিশনের কারণে অবশ্য সেঞ্চুরি পাওয়াটা কঠিনই। তার পরও কী মনে হয়, ক্যারিয়ার শেষের আগে এই অপূর্ণতা কাটাতে চাইবেন? 

মালিক:  হ্যাঁ, আমি নিশ্চিতভাবেই চেষ্টা করব… হয়তো ওপেন করা শুরু করতে হবে! আমি মিডল অর্ডারে ব্যাট করি। দলের চাওয়া থাকে, খেলা শেষ করে আসা। দলের জন্য ফিনিশার হওয়া নিয়েই তাই মূলত আমার ভাবনা থাকে। এজন্যই হয়তো আপনারা আমার কাছ থেকে সেঞ্চুরি পাননি। 

একবার মনে আছে আমার, ওপেন করেছিলাম এবং ৯৫ রানে অপরাজিত ছিলাম (ওপেনিংয়ে নয়, আসলে তিনে নেমে ৯ ছক্কায় ৪৯ বলে অপরাজিত ৯৫, ২০১৫ সালে)। পরে মনে হচ্ছিল, আর পাঁচ-ছয় রান যদি হতো! তবে ব্যাপারটি হলো, আমি সবসময় দলের জন্য খেলি এবং ফিনিশারের ভূমিকাটাই সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। যদি কখনও সুযোগ আসে, শতরানের কাছাকাছি যদি যেতে পারি, সেঞ্চুরির সব চেষ্টাই করব।