বাংলাদেশে মহামারীর কি শেষের শুরু?

করোনাভাইরাসের দাপুটে ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের প্রভাবে দেশে জানুয়ারি থেকে বেড়ে চলা সংক্রমণ ফেব্রুয়ারি থেকে কমে আসায়, কোভিড মহামারীর পরিস্থিতি আপাতত কিছুটা স্বস্তিকর মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2022, 07:32 PM
Updated : 24 March 2022, 07:32 PM

তবে করোনাভাইরাস মহামারী বিদায় নিচ্ছে কি না, জানতে হলে পুরো মার্চ মাস পর্যবেক্ষণ করতে হবে বলে মনে করছেন ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম।

দেশের বড় একটি জনসংখ্যাকে টিকার আওতায় আনায় এবং ওমিক্রনের কারণে ‘নেচারাল হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হলেও মার্চের শেষ নাগাদ সংক্রমণ বেড়ে যাবে কি না, সে নিশ্চয়তা এখনও দিচ্ছেন না স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত একদিনেই ২০ লাখের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, এ ছাড়া চীন নতুন করে কোভিডে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশকেও প্রস্তুত থাকার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি মাসে দুলাখের ঘরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মার্চের ২৩ দিনে নেমেছে সাত হাজারের ঘরে।

৩ মাসে শনাক্ত রোগীর চিত্র

> জানুয়ারিতে সারাদেশে রোগী শনাক্ত হয় ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৮ জন

> ফেব্রুয়ারিতে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৮৯ জন এবং

> মার্চের ২৪ তারিখ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৭৪৯৫ জন।

ঠিক দুই মাস আগে ২৩ জানুয়ারি ১০ হাজার ৯০৬ জন এবং এক মাস আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ২৯৮ জন রোগী শনাক্ত হয়। আর বৃহস্পতিবার সারাদেশে ৯২ জনের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে।

দেশে ২৩ জানুয়ারি ১৪ জন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল করোনাভাইরাসে আর বুধবার মারা যান একজন। বৃহস্পতিবার কারও মৃত্যু হয়নি।

গত ২৩ জানুয়ারি শনাক্তের ছিল ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ, ২৩ ফেব্রুয়ারিতে তা ছিল ২৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, বুধবার নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১ দশমিক ২৭ শতাংশ।

করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুর পর শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি ছিল ২৮ জানুয়ারি, ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

দেশে করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার প্রাণ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর গত ১ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ করা নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে জানিয়েছিল, দেশে এখন যারা কোভিড আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের সবার শরীরেই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।

ওমিক্রনের প্রাধান্য নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে সারাবিশ্বে এত বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে যে কারণে নেচারাল হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হয়েছে।

“যেহেতু নেচারাল হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে, সে কারণে আরেকটা ভ্যারিয়েন্ট আসা কঠিন। যদি বিশেষ কোনো ঘটনা না ঘটে… যেমন যুদ্ধ। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি শুরু হয়ে যায় তাহলে অনেক কিছুতেই কম্প্রোমাইজ করতে হবে। এটা বাদ দিলে ধরে নেওয়া যায় যে আমরা শেষের শুরু পার হয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট হয়ত এই মহামারীর শেষের শুরু।”

টিকাদান কার্যক্রম

>> দেশে এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ পেয়েছে ১২ কোটি ৬৫ লাখের বেশি মানুষ

>> দ্বিতীয় ডোজের আওতায় এসেছেন ৯ কোটি ২৪ লাখের বেশি

>> বুস্টার ডোজ নিয়েছেন ৬৪ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি মানুষ

প্রথম, দ্বিতীয় এবং বুস্টার ডোজ মিলিয়ে বাংলাদেশ জনসংখ্যার বড় অংশকে টিকার আওতায় আসায় সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ 'ভালো অব্স্থানে' আছেন বলে মনে করেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর।

বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ তাদের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বেশি মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দিলেও, অনেক দেশই টিকাদানে পিছিয়ে।

তাই ‘হার্ড ইউমিনিট’ নিয়ে অন্যান্য বিশেষজ্ঞের মতামতের সঙ্গে একমত নন এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সতর্ক থাকাতেই তার পরামর্শ।

“একই সময়ে সারাবিশ্বের মানুষকে ৭০ শতাংশ টিকা দিতে পারলে হয়তো হার্ড ইমিউনিটির বিষয়টি আসত। সারাবিশ্বে এখনও প্রতিদিন ১০ লাখের মতো মানুষ নতুন করে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হচ্ছেন। সে কারণে বাংলাদেশেও আবার সংক্রমণ ফিরে আসতে পারে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শিথিলতার কোনো সুযোগ নাই।”

দেশে ১২ কোটি মানুষ পেয়েছেন কোভিড টিকা।

কোভিড মহামারীর বিদায় এবং ফিরে আসা প্রসঙ্গে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল বলেন, বিপুল সংখ্যা মানুষ টিকা নেওয়ায় সংক্রমণ আবার নাও বাড়তে পারে। 

“ডেল্টাকে রিপ্লেস করে ওমিক্রন এসেছে। ফলে সংক্রমণ বাড়লেও টিকা দেওয়া থাকায় সিভিয়ারিটি কম হয়েছে বলে আমার ধারণা।”

নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসার আশঙ্কা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই ভাইরাস নিয়মিত মিউট্যান্ট করে। এ কারণে স্বস্তিতে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এ কারণে মার্চের শেষদিকে আবার বাড়বে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।”

টানা দুই সপ্তাহ ধরে শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরে নেওয়া হয়; সে হিসাবে বাংলাদেশ এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা.মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

“ওভারঅল বাংলাদেশ খুব ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু বিশ্বের অনেক জায়গায় যেহেতু এখনও রোগী পাওয়া যাচ্ছে, প্যানডেমিকের শেষ ঘোষণা করা যাচ্ছে না। এ কারণে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখব। ”

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টেই মহামারীর শেষ কি না- এমন প্রশ্নে সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “প্যানডেমিক হয়ত শেষ হবে। কিন্তু ভাইরাস থেকে যাবে, হয়ত ফ্যাটালিটি কমে যাবে। তবে যাই হোক এখনও পর্যন্ত আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।”