ফাইজারের টিকা: সংরক্ষণ-বিতরণ কীভাবে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্সের কাছ থেকে ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি যে দেড় লাখ ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশ পাচ্ছে, সংরক্ষণ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে তা শুধু ঢাকাতেই প্রয়োগ করা হবে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2021, 06:28 PM
Updated : 27 May 2021, 06:28 PM

আগামী রোববার দুপুরে ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকার এই চালান বাংলাদেশে পৌঁছাবে। সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ইতোমধ্যে এ টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।

পরীক্ষামূলক প্রয়োগে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা দেখানো ফাইজারের টিকাও নিতে হবে দুই ডোজ করে। প্রথম ডোজ দেওয়ার ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর দিতে হবে দ্বিতীয় ডোজ। ১২ বছরের বেশি বয়সীরাই এ টিকা নিতে পারে।

কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ হল এর সংরক্ষণ ব্যবস্থা। এ টিকা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করতে হয় অতি শীতল তাপমাত্রায়, যে ব্যবস্থা বাংলাদেশে অপ্রতুল। একই কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করাও কঠিন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ফাইজারের টিকার দুই লাখ ডোজ টিকা সংরক্ষণের সক্ষমতা তাদের আছে। সক্ষমতা বাড়ালে ১০ লাখ ডোজ টিকাও সংরক্ষণ করা যাবে।

এখন প্রশ্ন হল, বাংলাদেশ এ টিকা সংরক্ষণ করবে কীভাবে, বিতরণই বা কীভাবে হবে।

ফাইজার-বায়োএনটেকের যে টিকা প্রথম চালানে বাংলাদেশকে কোভ্যাক্স দিয়েছে, তা সংরক্ষণ করতে হয় হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।

সংরক্ষণ

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানিয়েছে, ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা সংরক্ষণ করতে হয় হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।

ফলে এ টিকা সংরক্ষণ করতে আল্ট্রা কোল্ড ফ্রিজারের প্রয়োজন হবে। আর পরিবহনের জন্য থার্মাল শিপিং কনটেইনার বা আল্ট্রা ফ্রিজার ভ্যান প্রয়োজন হবে।

তবে সাধারণ রেফ্রিজারেটরে ২ ডিগ্রি থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হলে এ টিকা ৫ দিন পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগী থাকবে। আর রেফ্রিজারেটরের বাইরে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ টিকা দুই ঘণ্টা টিকবে।

এই টিকা সংরক্ষণ ও বিতরণে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমএনসিঅ্যান্ডএএইচ অপারেশনাল প্ল্যানের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সব ধরনের প্রস্তুতিই’ তারা নিয়েছেন।

“এটা আল্ট্রা-লো ফ্রিজারেই রাখতে হবে। সেজন্য আল্ট্রা-লো ফ্রিজার প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যাতে কোনো সমস্যা না হয়।”

বিমানবন্দর থেকে বিশেষ ফ্রিজার ভ্যানে করে টিকার চালান নেওয়া হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংরক্ষণাগারে।

“ওরা (ফাইজার-বায়োএনটেক) যেভাবে পাঠাচ্ছে, ওই কন্টেইনারেই ড্রাই আইস দিয়ে পাঠায়, সেখানেই মাইনাস টেম্পারেচার দেওয়া থাকে। বিমানবন্দর থেকে আমরা সেগুলো আমাদের স্টোরে রাখব।“

শামসুল হক জানান, কত টিকা সংরক্ষণ করা যাবে, তা নির্ভর করছে টিকার ভায়ালের ওপর। সিঙ্গেল ডোজ ভায়াল না হয়ে মাল্টি ডোজের হলে বেশি পরিমাণ টিকা সংরক্ষণ করা যাবে। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, বাংলাদেশে মাল্টিডোজের ভায়ালই আসছে।

“আমাদের যে সক্ষমতা আছে, মানে আমার হাতে যেটা একদম রেডি, তাতে দুইলাখ ডোজ টিকা রাখতে পারব। এরপরে যদি আমাদের টিকা আসে, যেক্ষেত্রে আমরা আরও ফ্রিজার রেডি করব। আমরা যেটা খোঁজ নিয়েছি, প্রায় আট থেকে ১০ লাখ ডোজ টিকা রাখার মত ফ্রিজারের ব্যবস্থা আমরা হয়ত করতে পারব। আমরা এসব ফ্রিজার এখন অন্য কাজে ব্যবহার করছি।”

প্রয়োগ কীভাবে?

শামসুল হক বলেন, এই টিকা জমাট অবস্থায় আসবে এবং সেভাবেই সংরক্ষণ করা হবে। মানুষের শরীরে প্রয়োগের আগে সাধারণ রেফ্রিজারেটরে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে টিকার ভায়াল রাখা হবে ৬ ঘণ্টা।

“তাতে সেটা আস্তে আস্তে গলে যাবে। এই গলানো অবস্থায় টিকা ১২০ ঘণ্টা রাখা যায়। টিকা দেওয়ার দিন স্টোর থেকে সেটা সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হবে।”

তিনি জানান, কেন্দ্রে নেওয়ার পর ডাইলুয়েন্টের সঙ্গে মিশিয়ে এই টিকা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হবে। ডাইলুয়েন্ট মেশানোর পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে এ টিকা প্রয়োগ করে ফেলতে হবে।

“যে ডাইলুয়েন্ট লাগবে, সেসব মেটেরিয়ালস আমরা তৈরি করে ফেলেছি। ট্রেইনিং মেটেরিয়ালসও আমাদের তৈরি হয়ে গেছে।”

কোথায় দেওয়া হবে? কারা পাবে?

সংরক্ষণ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে ফাইজারের টিকা আপাতত ঢাকার বাইরে নেওয়া হবে না। আবার সংরক্ষণাগার থেকে ঢাকার বর্তমান সব টিকাকেন্দ্রে পরিবহনের ক্ষেত্রেও জটিলতা আছে। ফলে সব কেন্দ্রে ফাইজারের টিকা পাওয়া যাবে না।

শামসুল হক বলেন, “আপাতত এই টিকা আমরা ঢাকাতেই দেব। তবে ঢাকার সব সেন্টারে দেওয়া যাবে না, সবগুলো সেন্টার উপযুক্ত না। কারণ এই টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। আমাদের এখনও পলিসি তৈরি হয়নি।” 

ঢাকার কোন কোন সেন্টারে এ টিকা দেওয়া হবে, কারা ফাইজারের টিকা পাবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, “এটা এখনও প্ল্যানিং পর্যায়ে আছে।”

ফাইল ছবি

কেন ফাইজারের টিকা

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারটি করোনাভাইরাসের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে, যার মধ্যে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা চতুর্থ। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি বায়োএনটেক মিলে এ টিকা তৈরি করেছে।

গত বছরের ২ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য ফাইজারের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে এখন এ টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়ালে এ টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে বলে উৎপাদকদের ভাষ্য।

এর আগে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, রাশিয়ার তৈরি স্পুৎনিক-ভি এবং চীনের সিনোফার্মের তৈরি টিকার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

এর মধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কেনা কোভিশিল্ড দিয়ে গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে দেশে গণটিকাদান শুরু করে সরকার। চীনের সিনোফার্মের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে দেড় কোটি ডোজ টিকা, যা জুন, জুলাই ও অগাস্ট মাসে বাংলাদেশে আসবে। রাশিয়ার কাছ থেকে স্পুৎনিক-ভি কেনার জন্য সরকারি পর্যায়ে আলোচনা চলছে, তবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।  

সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড কিনতে বাংলাদেশের প্রতি ডোজে খরচ হয়েছে সব মিলিয়ে ৫ ডলারের মত। সিনোফার্মের টিকার ক্ষেত্রে প্রতি ডোজের দাম হবে ১০ ডলার।

স্পুৎনিক-ভি কিনলে বাংলাদেশে কত দাম দিতে হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে ভারতে এ টিকার দাম পড়েছে ১৩ ডলারের মত। আর ফাইজার-বায়োএনটেক শুরুর দিকে তাদের টিকা বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রি করেছে ২০ ডলারে।  

তবে বাংলাদেশকে ওই দামে ফাইজারের টিকা কিনতে হচ্ছে না। দরিদ্র দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্স থেকে বাংলাদেশ এ টিকা পাচ্ছে।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্যাভি এবং সংক্রামক রোগের টিকা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সংস্থার (সিইপিআই) নেতৃত্বে গড়ে তোলা কোভ্যাক্স বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৯২টি দেশকে টিকা সরবরাহের লক্ষ্য ঠিক করেছে।

এর আওতায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশের জন্য টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কোভ্যাক্স। সে হিসেবে ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে পুরো টিকা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।

কোভ্যাক্স থেকে প্রথম চালানে ফাইজারের টিকা সরবরাহের প্রস্তাব করা হয়েছিল বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ তাতে সম্মতি দেওয়ায় ৩০ মে তা দেশে আসছে। পরের চালানে কোভ্যাক্স থেকে কোন টিকা কী পরিমাণে পাওয়া যাবে, তা এখনও জানতে পারেনি সরকার।