কোভিড-১৯: চীনা টিকা নিয়ে আরও ‘দেখার পর’ সিদ্ধান্ত

চীনের তৈরি করা নতুন করোনাভাইরাসের একটি টিকার বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধীরেসুস্থে এগোতে চাইছে সরকার, সেজন্য এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2020, 12:29 PM
Updated : 12 August 2020, 12:36 PM

কোনো টিকার চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বিপুল সংখ্যক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে তার ফলাফল দেখতে হয়। পরীক্ষায় নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলেই সেই টিকা অনুমোদন পায়।

চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের করোনাভাইরাসের টিকা এখন তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে।

এর মধ্যে চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেড তাদের তৈরি করা টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা বাংলাদেশেও করার পরিকল্পনা করে। গত ১৮ জুলাই এই টিকা বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমোদনও দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল, বিএমআরসি।

ঘোষণা অনুযায়ী, এই টিকার বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কাজটি করবে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি। আগামী ১৮ মাস ধরে দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা রয়েছে।

তবে এখনও পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়নি। বিষয়টি নতুন হওয়ায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম জানিয়েছেন।

ডা. খুরশীদ আলম মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ জাতীয় পর্যায়ে হবে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ কিছুটা ‘ধীরে সুস্থে’ সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে। এজন্য চীনের কোথায় কোথায় এর ট্রায়াল হয়েছে, ফলাফল কী তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।

“এটা ন্যাশনাল ট্রায়ালের ব্যাপার। পরীক্ষামূলক প্রয়োগটি চালাতে গিয়ে যদি কারও কোনো ক্ষতি হয় তার জবাব কে দেবে? বিএমআরসি যদিও ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে তারপরও হুট করে শুরু করা যাবে না, ধীরেসুস্থে এগোতে হবে।”

তিনি বলেন, ট্রায়ালের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য কমিটি, বিএমআরসি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছে।

“আমাদের কাছে রিকুইজিশন আছে, আমরা রেখে দিয়েছি। আমরা এখনও নির্দেশনা পাইনি বিষয়টি নিয়ে কী করা উচিত। পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া বা না দেওয়ার ক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের নাই।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টির সঙ্গে ইনভলভড হতে হবে। সংসদের কাছ থেকে আইন করে বলতে হবে এর ট্রায়াল দেওয়ার জন্য। কারণ জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চাট্টিখানি কথা নয়। এটা যেহেতু দ্রুত করা দরকার সেক্ষেত্রে হয়ত অনেক আইনকানুন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তুলে নেবে। কিন্তু যতক্ষণ তুলে না নিচ্ছে ততক্ষণ তো আমরা ওই আইনের বাইরে যেতে পারছি না।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউনিট-১ ও ইউনিট ২, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল এবং হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চীনা এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা রয়েছে।

টিকার পরীক্ষা নিয়ে জানতে চাইলে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. শিহাব উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখনও এ ধরনের কোনো নির্দেশনা পাননি তারা।

“আমি কয়েক দিন আগে আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা জানিয়েছেন এটা এখনও প্রাইমারি স্টেজে আছে। এখনও কথা-বার্তা চলছে। আমাদের কাছে আসলে তো সরকারি আদেশ, নির্দেশনাসহ আসবে।”

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল হাসেম শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের হাসপাতালেও এ ধরনের কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি।

“আমাদের এখানে পরীক্ষা শুরু করার আগে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিতে হবে। কারা আসবে, কাদের ওপর কীভাবে প্রয়োগ হবে-বিস্তারিত। কিন্তু আমি যত দূর জেনেছি পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিষয়টি এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র পায়নি।”

এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চীনের সিনোভ্যাক আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে কথা বলেছে, সরকারের সঙ্গে নয়। বিএমআরসি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দিলেও সরকারিভাবে এখনও দেওয়া হয়নি।

“আমরা এখনও তাদেরকে জিজ্ঞেস করছি যে, আপনারা আমাদের দেশের চার থেকে সাড়ে চার হাজার লোকের ওপর পরীক্ষা করতে চান। আপনাদের দেশে করেছেন কি না? তারা কিন্তু তাদের দেশে এখনও এটা (পরীক্ষামূলক প্রয়োগ) করে নাই। আমাদের দেশে করবেন, এই জিনিসটা তাদের ওখানে কী ফল এনেছে তা দেখতে হবে।

“কারণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরে মানুষের শরীরের ওপর কী প্রতিক্রিয়া হয় তা তো আমরা বলতে পারি না। আমাদের দেশের লোক ঝুঁকিতে পড়ুক এটাও আমরা চাই না। এসব বিষয় চিন্তাভাবনা করে আমরা দেখছি কী করা যায়। যদি অন্যান্য দেশে হয় সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে আমরা হয়ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেব।”

এ বিষয়ে আইসিডিডিআর,বির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির একজন প্রতিনিধি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গবেষণাধীন বিষয় নিয়ে এই মুহূর্তে আইসিডিডিআর,বি কোনো কথা বলবে না।

বিশ্বের দুই কোটির বেশি মানুষকে আক্রান্ত এবং প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের প্রাণ হরণকারী কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে এখন টিকার দিকে চেয়ে আছে সবাই।

বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টিকা তৈরিতে নেমে পড়েছে। সিনোভ্যাক তাদের টিকার দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা (ট্রায়াল) সম্পন্ন করেছে। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার জন্য ব্রাজিলেও পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি পাওয়ার কথা জানিয়েছে তারা।

চীনা কোম্পানিটি দাবি করেছে, তারা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ৭৪৩ জনের উপর এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে সফলতা দেখেছে। ওই ব্যক্তিদের দেহে এই টিকা নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।