“বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে সিদ্ধান্ত এলে সেখানে আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে,” বলেন তিনি।
Published : 20 Sep 2024, 10:46 AM
ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে পরিবর্তনের ধারায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যোর দায়িত্বে আসা অধ্যাপক রেজাউল করিম তার পরিকল্পনা গোছাতে শুরু করেছেন।
শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে যুগোপযোগী জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলেছেন তিনি।
গত বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) সমাজকর্ম বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রেজাউল করিমকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়।
উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সমস্ত কমিউনিটি চেয়েছিল, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য থেকে কোনো শিক্ষক ভিসি হোক। কর্তৃপক্ষ আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছে। আমি কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, তারা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টিমেন্টকে ধারণ করে অনেকটা প্রত্যাশা রেখেই আমাকে নিয়োগ দিয়েছে।
“আমি এই মুহূর্তে ওইভাবে নিজের কাজ গোছাতে পারিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্র আছে, যেগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলছে না, সেগুলোকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়; সেটা দেখব। সকলের সহযোগিতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে একক পরিবার হিসেবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করে যাব।”
নতুন ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল প্রসঙ্গে
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নতুন ক্যাম্পাসের জন্য ২০০ একর জায়গা পেলেও মন্থর গতিতে চলছে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। রয়েছে দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজির নানা অভিযোগ।
আর একমাত্র ছাত্রী হল নিয়ে চলা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই থাকেন ক্যাম্পাসের আশপাশের বিভিন্ন মেসে।
খাতা-কলমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি হল থাকলেও আশির দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে বেদখল হয়েছে সেগুলো। বহুবার হল উদ্ধারের উদ্যোগ নিলেও প্রভাবশালীদের কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
তবে নতুন ক্যাম্পাস ও হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করার আশা ব্যক্ত করেছেন নবনিযুক্ত উপাচার্য।
অধ্যাপক রেজাউল বলেন, “আমি প্রথমেই আমার শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দেব। তারা এখানে অনেক অসুবিধার মধ্যে আছে। শিক্ষার্থীদের কী কী অসুবিধা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করব; পাশাপাশি প্রশাসনিক শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে গতিশীল করব। এভাবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাব।
“বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো আছে, আমাদের নতুন ক্যাম্পাস আছে, এসব দিকে নজর দিতে হবে। এগুলো শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধার সঙ্গেই জড়িত।”
প্রশাসনিক শূন্যস্থান পূরণের দিকে নজর
৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে; বাদ যায়নি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকা হালিমের সঙ্গে একযোগে পদত্যাগ করেন রেজিস্ট্রার, প্রক্টোরিয়াল বডি, হল প্রভোস্ট, ছাত্রকল্যাণ পরিচালকসহ দপ্তর প্রধানেরা। কোষাধ্যক্ষ ছাড়া প্রায় সব জায়গায়ই শূন্যতা বিরাজ করছে।
প্রসাসনিক এই শূন্যতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির অন্তরায় জানিয়ে অধ্যাপক রেজাউল বলেন, “আমাদের প্রশাসনিক সেক্টরে প্রায় সকল পদই শূন্য আছে। সেই জায়গাগুলো তো খালি রাখা যায় না। সেগুলো কীভাবে পূরণ করা যায়, সেদিকে নজর দেব।
“আজ একটা পত্রিকায় দেখলাম, প্রক্টোরিয়াল বডি না থাকায় আমাদের নারী শিক্ষার্থীরা একটু অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ছেন। তারা কোথায় অভিযোগ জানাবেন, সেটা নিয়ে রয়েছে সংশয়। এ জন্যই শিক্ষার্থী-সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলো নিয়ে আমি কাজ করব।”
আন্দোলনে নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী সাজিদ ও তামিমের কথা স্মরণ করে করে নবনিযুক্ত উপাচার্য
বলেন, “আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী সাজিদ ও তামিমসহ আরও যারা নিহত হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। অনেকেই আহত হয়েছেন আবার অনেকে এখনও চিকিৎসাধীন আছেন। যে প্রত্যাশায় তারা এই ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেটা আংশিক হলেও পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছি এবং কর্তৃপক্ষ সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমুখী চাপ নিয়ে উপাচার্য যা ভাবছেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের নানামুখী চাপ নিয়ে চিন্তা করছেন না উপাচার্য রেজাউল করিম, বরং শুনিয়েছেন প্রত্যাশার কথা।
শিক্ষকতা জীবনে রেজাউল করিম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সমাজকর্ম বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। এর আগে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও কাজ করেছেন।
প্রশাসনিক কাজ সামলানোর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ অধ্যাপক রেজাউল দল-মত নির্বিশেষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে বলেন, “আমি সবার সহযোগিতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমি আশা করি, সবাই দল-মত নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাকে সহযোগিতা করবেন।
“এখানে কেউ তাদের ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেবেন না। ‘স্টুডেন্ট ফার্স্ট’ মানে স্টুডেন্টের লেখাপড়া ফার্স্ট। পড়াশোনার আগে এগুলোকে তারা গুরুত্ব দেবেন না; এটা আমার প্রত্যাশা। আশা করছি সবাই আমাকে যথাসম্ভব সমর্থন করবে। আমার সেই আস্থাও আছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি প্রসঙ্গে
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ অগাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভা কক্ষে বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটি বৈঠকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের মৌখিক ঘোষণা দেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক হুমায়ুন কবির চৌধুরী।
ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে অধ্যাপক রেজাউল করিমের রয়েছে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা। তিনি বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি অতটা পছন্দ করি না। কিন্তু আবার পরিচ্ছন্ন রাজনীতি ব্যতিক্রমী ব্যাপার। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন রাজনীতি দেখেছি, তখন এ রকম ছিল না।
“বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে সিদ্ধান্ত এলে সেখানে আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে। তাই এটা নিয়ে আমাকে আরেকটু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) আইন প্রণয়নের পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিগত প্রশাসন।
বিভিন্ন সময় জকসু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান রেখে আসছে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। তবে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম এ ব্যাপারে নিজের অভিমত তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, “আমি চাই, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র চর্চা করুক। এখান থেকেই তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা বিকশিত হোক। জকসু গঠন করতে গেলে সাংগঠনিক কিছু বিষয় আছে। জকসু হলে শিক্ষার্থীরা দলভিত্তিক না হয়ে নিজেরাই বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলবে। এটা একটু দেখতে হবে। আমি একটু সময় পেলেই এসব দিক নিয়ে ভাবব।”
জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা রেজাউল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজকল্যাণ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।
২০০৮ সালে জগন্নাথের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক রেজাউল, যিনি ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক ছিলেন।
জগন্নাথে আসার পর বিশ্ববিদ্যালটির আইন-কানুন তৈরিতে তার ভূমিকা ছিল।