দেশে বৈদ্যুতিক কেবল শিল্পের পালে হাওয়া

“সরকার সুযোগ দিলে বর্তমানে স্থানীয় চাহিদার পুরোটাই দেশীয় জোগান থেকে পূরণ করা সম্ভব,” বলছেন আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2023, 05:52 AM
Updated : 14 August 2023, 05:52 AM

সরকার বিদ্যুতের বিতরণ লাইন মাটির নিচে স্থাপনের প্রকল্প নেওয়ার পর আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে দেশীয় কোম্পানিগুলো।

বর্তমানে সরকারের চলমান প্রকল্পে যে পরিমাণ আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল প্রয়োজন, তার পুরোটাই দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন থেকে যোগান দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এন পাল।

বর্তমানে শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন মাটির নিচে স্থাপন করার বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এগুলোর অধিকাংশই চীনের অর্থায়নে চলমান থাকায় অন্যান্য সরঞ্জামসহ উচ্চ ভোল্টেজের তারগুলো চীন থেকেই আসে।

তবে বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবির অর্থায়নে পরিচালিত কিছু প্রকল্পে মিডিয়াম ভোল্টেজের কেবল সরবরাহ করতে পারছে বিজলী কেবলস, বিআরবি কেবলস, বিবিএস ও পারটেক্সসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি।

আরএন পাল বলেন, বাংলাদেশে এখন যেসব তার উৎপাদন হয়, তাতে ৪০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করে ৬০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন করা যায়।

“সরকার সুযোগ দিলে বর্তমানে স্থানীয় চাহিদার পুরোটাই দেশীয় জোগান থেকে পূরণ করা সম্ভব। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের তার বা বৈদ্যুতিক কেবল রপ্তানিও শুরু করেছে বিজলী কেবলস।”

হবিগঞ্জে এক হাজার বিঘা জমির ওপর ২০ ধরনের পণ্যর উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। সেখানে ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগে মিডিয়াম ভোল্টেজ বা হাই টেনশন (এইচটি) কেবল তৈরির নতুন একটি ইউনিট চালু করা হয়েছে গত এপ্রিলে।

আরএফএল এর উৎপাদিত কেবল বাজারে 'বিজলী কেবলস' নামে পরিচিত। সম্প্রতি ঢাকা থেকে একদল গণমাধ্যম কর্মীকে সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বাজার সম্ভাবনার দিকগুলো তুলে ধরে প্রাণ-আরএফএল কর্তৃপক্ষ।

শতভাগ দেশীয় জোগান?

বিজলী কেবলস বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছে, বর্তমানে মিডিয়াম ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারের বার্ষিক বাজার প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে বিআরবি, বিবিএস ও পারটেক্সসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি মিডিয়াম ভোল্টেজ কেবল উৎপাদন করছে। এসব কোম্পানি মোট ব্যবহারের ২০ শতাংশের জোগান দিচ্ছে। বাকি ৮০ শতাংশ চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে।

আর এন পাল বলেন, আরএফএলের কারখানার হাই টেনশন কেবলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার টন। বাজারে এরচেয়েও বেশি উৎপাদন সক্ষমতার কোম্পানি রয়েছে।

“বর্তমানে সরকারের বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেখানে বিদেশ থেকে তার আমদানির শর্ত রয়েছে। এসব শর্ত উন্মুক্ত করা গেলে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোই চাহিদার পুরোটা যোগান দিতে পারবে। কারণ, এসব তারের বিষয়ে যেসব স্ট্যান্ডার্ড চাওয়া হয়, তার সবই বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর নিশ্চিত করার সক্ষমতা রয়েছে।

“এসব তারের অধিকাংশ কাচামাল চীন থেকে আসে। ফলে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোও যদি বাংলাদেশে উৎপাদিত তার ব্যবহার করে, তাহলে তাদের সময় ও খরচ সাশ্রয় হবে।”

বিজলী কেবলসের কারখানা ঘুরে দেখা যায়, শুধু মিডিয়াম ভোল্টেজ কেবল না, অতি সম্প্রতি এইচডিএমআই (হাই-ডেফিনিশন মাল্টিমিডিয়া ইন্টারফেস) ও ইউএসবি (ইউনিভার্সাল সিরিয়াল বাস) কেবলও তৈরি করছে এ কোম্পানি।

এছাড়া ইলেকট্রিক কেবল, সুপার অ্যানামেল ওয়্যার, ফাইবার অপটিক কেবল, কমিউনিকেশন কেবলও তৈরি হচ্ছে আরএফএলের কারখানায়।

বিজলী কেবলসের ফ্যাক্টরি হেড মো. আবুল বাশার বলেন, “দেশে সব ধরনের কেবলের চাহিদাই বাড়ছে। বর্তমানে দেশে বৈদ্যুতিক কেবলের বাজার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার। ১০ বছর আগে কেবলের মোট বাজার ছিল আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার। এখন প্রতিবছর ২০ শতাংশ হারে বাজার বাড়ছে।

“শতভাগ বিদ্যুতায়ন, মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি, বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ নানা কারণে কেবলের চাহিদা বাড়ছে। এ খাতে দেশে আনুমানিক ১০,০০০ কোটি টাকার মত বিনিয়োগ হয়েছে। কর্মসংস্থানের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার। বর্তমানে ছোট-বড় প্রায় ১২০টি কোম্পানি কেবল উৎপাদনে জড়িত।”

বাজার পরিস্থিতি  

দেশে ব্যবহৃত কেবলের প্রায় ৪০ শতাংশ ‘ডমেস্টিক কার্যক্রম’ বা ঘরবাড়ি ও অফিসের বৈদ্যুতিক সংযোগে ব্যবহার করা হয়। আর ৬০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়।

বৈদ্যুতিক তার শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল হিসাবে কপার, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল, রেজিন, ক্যালসিয়াম ও স্ট্যাবিলাইজার আমদানি করতে হয়। এসবের আমদানি শুল্ক গড়ে ৩৫ শতাংশ।

অন্যদিকে তৈরি কেবল আমদানি করলে গড়ে শুল্ক দিতে হয় ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দেশীয় শিল্প ১০ শতাংশ শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে ডমেস্টিক কেবল উৎপাদনের মাধ্যমে বিজলী কেবলস যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে বিজলীর পাওয়ার কেবল, কমিউনিকেশন কেবল, এনামেল অয়্যার, কপার স্ট্রিপ, অপটিক্যাল ফাইবার ও ফায়ার রেজিস্ট্যান্ট কেবলসহ ১০ শ্রেণির তার রয়েছে তাদের।

এর মধ্যে পাওয়ার কেবলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এ পর্যন্ত বিজলী কেবলস প্রায় ২২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৫ শতাংশ।

বর্তমানে চারটি উৎপাদন কারখানা রয়েছে বিজলী কেবলসের। বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার ৪০০ টন। এর মধ্যে বর্তমানে ব্যবহার হয় প্রায় ১৫ হাজার টন।

২০২১ সালে রপ্তানি শুরু করে বিজলী কেবলস। বর্তমানে বিজলী কেবলস ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিজলী কেবলস রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।