খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই-তিনটি বাদে সবগুলো প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই নাজুক।
Published : 20 Sep 2024, 09:25 AM
অনিয়ম-দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাবে দেশের ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনএফবিআই) আমানত রাখায় গ্রাহকদের মধ্যে অনীহা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এনএফবিআই সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এ বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে এসব প্রতিষ্ঠান ৪৭ হাজার আমানতকারী হারিয়েছে।
দেশে বর্তমানে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫টি। এর মধ্যে ৩টি সরকারি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুই-তিনটি বাদে সবগুলোর অবস্থাই নাজুক।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ৩৫ (৩টি সরকারি, ৩২টি বেসরকারি) আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতকারী সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮০ হাজার, যা মার্চ প্রান্তিক শেষে ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার।
চলতি বছরের জুন শেষে এনবিএফআইতে মোট আমানত ছিল ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকা; মার্চে ছিল ৪৪ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির (বিডি ফাইন্যান্স) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মোহাম্মদ কায়সার হামিদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সেক্টরে অনেক অ্যাকাউন্ট আছে যেগুলো ডিপিএস বা ছোট ডিপোজিটের। এগুলো কমে যাওয়ার কারণে ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমে যেতে পারে।”
আর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী এর পেছনে আস্থার সঙ্কট দেখছেন।
তিনি বলেন, “আস্থা কমে যাওয়ায় আমানতকারীর সংখ্যা কমে গেছে। কারণ এখানে অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তাতে মানুষের ভরসা কমছে। তাছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যাংকের ওপর (গ্রাহকদের) ভরসা বেশি।”
“হাতে গোনো ২-৩টা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলোর অবস্থা নাজুক,” বলেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানগুলোর নাজুক অবস্থার কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। তাছাড়া বৈনদন্দিন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণেও অনেকে আমানত ভাঙছেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “হাতেগোনা ভালো কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত ও গ্রাহক কমবেশি বাড়ছে। তবে এগুলো বাদে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই অবস্থা ভালো নয়। ফলে গ্রাহকেরা সেখানে নতুন করে আমানত রাখছেন না। উল্টো তাদের আমানতের টাকা তুলে নিচ্ছেন।
“এমন অনেক প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা কয়েক বছর ধরে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এছাড়া মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় অনেক গ্রাহক দৈনন্দিন খরচ মেটাতে আমানত ভেঙে তুলে নিচ্ছেন।”
ঋণ বিতরণে অনিয়ম এবং সুশাসন না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান ধুঁকছে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালের জুন শেষে এনবিএফআই খাতে আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে একই বছরের সেপ্টেম্বরে সেটি প্রায় ৫ লাখ ৫১ হাজার কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ১০ হাজারে।
তারপরে এক বছরের মতো আমানত বাড়ার প্রবণতা থাকলেও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতি প্রান্তিকেই আমনতকারী কমেছে।
২০২১ সালে গ্রাহকসংখ্যার বড় পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যায় আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোমিনুল ইসলাম, “তখন কয়েক লাখ নতুন ডিপিএস অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়েছিল। আমাদের ভাবনা ছিল, এসব গ্রাহকদের মধ্যে অন্তত ১০-১৫ শতাংশ স্থায়ী হবে। কিন্তু তা হয়নি। মূলত এ ধরনের ক্যাম্পেইনগুলো শেষ হওয়ার পর বড় পরিবর্তন হয় গ্রাহকের সংখ্যায়।”
কোভিড মহামারী পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘অতি রক্ষণশীল’ অবস্থানের কারণে এনবিএফআই খাত ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
“কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিমালার কারণে এখন যেসব প্রতিষ্ঠান ভালো আছে, তাদের পক্ষেও টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এনবিএফআই সেক্টরকে টিকিয়ে রাখতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব নীতিমালায় পরিবর্তন নিয়ে আসা উচিত,” বলেন এই আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে এনবিএফআইয়ে এ কোটি টাকার উপরের হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২২৮টি। মার্চ শেষে এমন হিসাবের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২০৪টি।
অর্থাৎ, তিন মাসে কোটি টাকার বেশি আছে, এমন হিসাব বেড়েছে মাত্র ২৪টি।