তিন সপ্তাহ বাদেই শুরু হতে যাচ্ছে রোজার মাস, তার আগেই কেনাকাটার ফর্দে যোগ হচ্ছে ডাল, ছোলা, বেসনের মত পণ্যের নাম। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ধীরে ধীরে বাড়ছে এসব পণ্যের দামও।
বিক্রেতারা বলছেন, ছোলা-বুটের বাজার এবার কী হবে তা তারা বুঝতে পারছেন না। কারও কারও কাছে খবর আছে, সপ্তাহের ব্যবধানে ৫-১০ টাকা পণ্যপ্রতি বাড়লেও এলসি খুলে দেওয়ায় ভারত থেকে আমদানি বাড়লে স্থিতিশীল থাকবে বাজার। যদিও ইতোমধ্যে দাম বেড়েছে এসব পণ্যের।
আর দফায় দফায় দাম বেড়ে সাধারণের নাগালের বাইরে গেছে মাছ-মাংস কিংবা ব্রয়লার মুরগি। তেল, চাল, চিনি আটা, ময়দা আগের মতই বাড়তি দামে আটকে আছে। শীত বিদায়ের সাথে সাথে বাজারে বেড়েছে সবজির দাম।
সরবরাহ কমে যাওয়ায় সবজির দাম কেজিতে বেড়েছে ১০-২০ টাকা। গ্রীষ্মের নতুন সবজি বাজারে উঠতে শুরু করলেও দাম বেশি। বাজারে এক কেজি করলা ১২০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, পটল ১২০ টাকা ও ঝিঙা ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল থাকলেও কমেনি আদা-রসুনের দাম। প্রতি কেজি আদা মানভেদে ১৪০-২৮০ টাকা, আর রসুন ১৬০-২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা শুকনা মরিচের কেজি ৪০০-৫০০ টাকা।
শুক্রবার ছুটির দিনে রাজধানীর মিরপুর ও মহাখালীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ছোলার দাম মানভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে ৯৫-১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আবার প্রতি কেজি বুটের ডাল গত সপ্তাহে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকায়। বেসনের কেজি ১২০ টাকা।
কাজীপাড়া মোড়ের মুদি দোকানি মোরশেদ বললেন, "এলসি বন্ধ থাকায় ডাল-ছোলার দাম একটু বেড়েছিল, তবে তা কমে যাবে। ভারত থেকে পণ্য আসার খবরে পাইকারি বাজারে কমার আভাস পাচ্ছি। মুড়ির দাম তেমন বাড়েনি। আগে যা তাই।
“তবে কিছু কোম্পানি প্যাকেট মুড়ির দাম ঠিক রাখলেও পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। ৫০০ গ্রাম প্যাকেটের বদলে একই দামে তারা ৪০০ গ্রামের প্যাকেট দিচ্ছে।"
বাজারে প্রতি কেজি খোলা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। আর নানা কোম্পানির প্যাকেটজাত ৫০০ গ্রাম মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়।
রমজানের পণ্যের খোঁজ খবর করতে আসা ক্রেতা হাসিবুল আলম বললেন, "প্রতিবারই তো দাম বেড়ে যায়। দোকানদাররা বলছে এবার ৮০-৯০ টাকাতেই ছোলা-ডালের দাম আটকা থাকবে, তবে হতে পারে যেকোনো কিছুই, ভরসা করা যাচ্ছে না।"
মাছ-মাংসে নাভিশ্বাস
বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৪০-২৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক হালি ব্রয়লার মুরগির ডিম কিনতে লাগছে ৪৮-৫০ টাকা। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭২০-৭৫০ টাকা দরে। খাসির মাংসের দাম প্রতি কেজি ১১০০ টাকা।
দাম বৃদ্ধিতে বাদ যায়নি মাছের বাজারও। মিরপুর ২ নম্বর কাঁচাবাজারে চাষের বিভিন্ন জাতের মাছে দাম বেড়েছে কেজিতে প্রায় ৪০-৫০ টাকা।
বাজারে প্রতি কেজি পাঙাস যেখানে বিক্রি হত ১৫০-১৬০ টাকায়, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকায়। প্রতি কেজি তেলাপিয়া কিনতে গুনতে হচ্ছে ২২০-২৫০ টাকা।
আর উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের দাম বেড়েছে আরও বেশি। ইলিশ-চিংড়ি ও দেশি নানা জাতের মাছে গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে দাম বেড়েছে ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত।
ওই বাজারের মাছ বিক্রেতা সোহেল মিয়া জানালেন, প্রতি কেজি চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬০০-১০০০ টাকায়, যা আগে ৫০০-৮০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হত। রুই, কাতলা, মৃগেল বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৬০ টাকা কেজিতে, যা আগে ২৮০-৩২০ টাকায় বিক্রি হত।
বাজারে মুরগিসহ অন্যান্য মাংসের দাম বাড়ায় মাছের ওপর চাপ বেড়েছে বলে মনে করছেন বিক্রেতারা।
২ নম্বর কাঁচাবাজারে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী আহমেদ ফয়সাল বলেন, “নির্দিষ্ট আয়ের যারা আছি, তাদের জন্য মাছ-মাংস খাওয়া একেবারে কঠিন হয়ে গেছে।
“মুরগির কথা বাদই দিলাম, চাষের মাছও তো নাগালের বাইরে। নিজে না খেলেও বাচ্চাকে তো দেওয়া লাগে।”
কাজীপাড়া এলাকার মাংস বিক্রেতা মো. সেলিম মিয়া বলেন, “১১১০ টাকা কেজি খাসি কিনার লোক কই? খুব দরকার ছাড়া কেউ খাসি কেনে না। কিনলেও আগে যেমন কিনত, তেমন না।
“গরু কিনলেও কম, যতটুকু লাগে তেমন। অনেক রেগুলার কাস্টমারও এখন কম আসে।”
‘সারাদিন রিকশা চালাইয়াও খরচ পুষাইতে পারি না’
নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি আর অস্থিরতায় সীমিত আয়ের মানুষ পড়েছেন বড় বিপদে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও যে বাজারের সঙ্গে আর কুলায়ে উঠতে পারছেন না। সামনে রোজার মাস, তখন কী হবে- এ ভেবেই দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না।
মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকায় শুক্রবার সকালে কথা হচ্ছিল রিকশাচালক আকবর মিয়ার সঙ্গে। বলছিলেন, “ভালো-মন্দ খাওয়ার কথা এহন আর চিন্তাও করি না। সবজি, ডিম, ডাল কোনোটারই দাম কম নাই। সারাদিন রিকশা চালাইয়াও খরচ পুষাইতে পারি না।”
মহাখালী এলাকায় ফেরি করে বাদাম-বুট বিক্রি করেন আমান উল্লাহ। নাবিস্কো এলাকার এই বাসিন্দার ভাষ্য, দেশে দ্রব্যমূল্যের দাম আবার কমবে- এমনটা বিশ্বাস হয় না তার। কিন্তু আয় বাড়ানোর উপায়ও খুঁজে পাচ্ছেন না।
"সারাদিনে ৪০০-৫০০ টাকার ব্যবসা হয়। এই টাকা দিয়ে কোনোরকম ডাইল-ভাতে জীবন চলে। মাছ-মাংস কিনার কোনো ভাউ নাই। রিজিকের মালিক আল্লাহ, আল্লায় চালায়। দাম কমব বলে মনে হয় না। কোনোটার তো কমে না, খালি বাড়েই।”
মহাখালীর এক বাণিজ্যিক ভবনে স্বল্প বেতনে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন সুফল আহমেদ। কাজ আগের মতই আছে, বেতনও আগের মত- কিন্তু জীবন আর আগের মত নেই।
সুফলের কথায়, “এই আয়ে আগে যেমন চলা গেছে, এখন আর তেমন চলা যায় না। চাহিদার সাথে অনেক আপস করতে হয়। আগে একটু বেশি খাইলে, এখন কম খাই।”