স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার পরও দপ্তরে না আসায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এসব সংস্থার প্রধানদের অনিয়মিত হওয়ার বিষয়টিও।
Published : 07 Aug 2024, 01:21 AM
সবশেষ তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রথম দিন সোমবার সরকার পতনের পরে ছুটি বাতিল হওয়ায় মঙ্গলবার সরকারি অফিস খোলা হলেও অফিসে আসেননি আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রধানরা।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি এর চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-আইডিআরএ এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী অফিসে আসেননি।
স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার পরও দপ্তরে না আসায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এসব সংস্থার প্রধানদের অনিয়মিত হওয়ার বিষয়টিও।
অসুস্থতাজনিত কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ-বিআইডিএস এর মহাপরিচালক বিনায়ক সেন অফিসে আসেননি।
আর্থিক খাতের প্রধানদের দপ্তরে না আসার বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘বিরাজমান পরিস্থিতি অতীতে কখনও দেখা যায়নি। আমরা এখন একটি ট্রানজিশনে আছি।
“এটা শেষ না হলে তারা হয়ত ফিরবেন না। সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত এই সমস্যাটি থেকে যাবে। যত দ্রুত সরকার গঠন হবে, তত দ্রুত পরিস্থিতি বদলাতে থাকবে। ‘’
রাজনৈতিক সরকার বদল হলেও স্বায়ত্তশাসিত আর্থিক খাতের প্রধানদের দায়িত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আইন প্রয়োগের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আর্থিক খাতের তিনটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানরা অফিসে না আসায় কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়ায় থাকা ফাইলগুলো সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে ফেরত পাঠানো হয় নির্বাহী প্রধানদের অফিসে ফেরার জন্য। তারা দৈনন্দিন কার্যক্রম প্রতিপালন করেছেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে।
অবশ্য রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রধানরা অপেক্ষায় আছেন নতুন সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য। তারা মনে করছেন, সরকার যদি তাদের দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে নির্দেশনা দেন, তাহলে দায়িত্বে ফিরবেন।
এর মধ্যে এক সংস্থার প্রধান মঙ্গলবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সচিবও কোনো সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় তিনি বাসায় চলে যান নিজ অফিসে না গিয়ে।
মঙ্গলবার রাতে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘খুব শীঘ্রই অফিসে যাওয়া শুরু করব, ইনশাআল্লাহ।’’
ব্যাংক খাতে সমস্যা আরও বেড়েছে ২ বছরে
অর্থমন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব থাকা অবস্থায় গত ২০২২ সালের জুলাই মাসে চার বছরের জন্য আব্দুর রউফ তালুকদারকে গর্ভনর হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।
এ জন্য চাকরির মেয়াদের এক বছর আগেই অবসর নিতে সচিব পদ থেকে পদত্যাগ করেন রউফ তালুকদার। আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম চলমান থাকার সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্বে এসে তিনি কয়েকটি বিষয়ে নজীরবিহীন সিদ্ধান্ত নেন।
দশ দুর্বল ব্যাংক শনাক্ত করে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও তাতে ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন হয়নি। শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকার তারল্য সুবিধা দিয়ে আসছেন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিতে সংস্কার করলেও গত কয়েক বছর ধরেই তা ১০ শতাংশের ঘরে রয়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দর নির্ধারণে প্রথমে এবিবি ও বাফেদাকে দায়িত্ব দিয়ে এখন মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
ডলারের বিনিময় হার বাজার দরে করার উদ্যোগ নিতে তার ঘোষণা গত এক বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। ডলার ব্যবস্থাপানায় দুর্বলতায় গত দুই বছরে টাকার মান কমেছে ২৪ টাকা ৫৫ পয়সা বা ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০২২ সালের জুন শেষে ডলারের দর ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা।
সবশেষ গত ২৬ জুলাই তা হয়েছে ১১৮ টাকা। মাঝখানে খোলা বাজারে ডলারের দর উঠেছিল সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা।
তার সময়ে গত দুই বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫৭ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। এত অল্প সময়ে অতীতে কোনো গভর্নরের সময়ে এত বেশি পরিমাণে খেলাপি ঋণ বাড়েনি।
সবশেষ দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে ব্যাংকিং খাতে নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। ঋণ অনিয়মে ডুবতে বসা পদ্মা ব্যাংক(সাবেক ফারমার্স) একীভূত করতে চুক্তিবদ্ধ করে দেয় শরীয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে চুক্তি হয় অপর রাষ্ট্রায়ত্ত বিডিবিএল ব্যাংক। সবই করা হয় তার নির্দেশে।
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সকল লেনদেন সম্পন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে হওয়ায় নির্বাহী প্রধানের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়।
গভর্নর না আসায় জরুরি ও দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন ডেপুটি গভর্নর বৈঠক করেন। গভর্নরের অনুপস্থিতি বা ছুটিতে থাকাকালীন দৈনন্দিন কাজ ও ডাক ফাইল গ্রহণ এবং বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন পদাধিকার বলে ডেপুটি-১ এর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা।
বর্তমানে ডেপুটি গভর্নর-১ কাজী ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘গভর্নর অফিসে আসেননি। জরুরি প্রয়োজনে তার বাসায় ফাইল পাঠানো যাবে। আমাদের জানিয়েছেন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি একটু শারিরিক ও মানসিক সমস্যা বোধ করায় অফিসে আসবেন না মঙ্গলবার।’’
‘‘নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে তার গানম্যান (সশস্ত্র পুলিশ) পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ তো নেই। এখন আগামীকাল (বুধবার) দেখি আনসার বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না। এটিও একটি কারণ তার না আসার।’’
বুধবার নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে কী নির্দেশনা আসে, সিই বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে বলে তথ্য দিয়েছেন ছাইদুর রহমান।
দাঁড়াতে পারছে না পুঁজিবাজারও
অর্থনীতির দগদগে ক্ষত হয়ে এখনও ‘চিকিৎসা’র অপেক্ষা করছে দেশের পুঁজিবাজার। আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ খাত পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে ২০২০ সালের ১৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে নিয়োগ দেয় সরকার। সবশেষ গত এপ্রিলে পুনরায় চার বছরের জন্য এ পদে বসানো হয় তাকে।
আগের চেয়ারম্যানের সময়ে কভিড-১৯ এর কারণে পুঁজিবাজারে দেওয়া ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে নিয়েছিলেন পরিস্থিতি উন্নয়নে দায়িত্বে নেওয়ার ১৩ দিন পর।
বাজার কারসাজিতে জড়িতদের ধরতে নেওয়া একাধিক পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীরা সন্তুষ্ট হতে শুরু করলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ৭ হাজার ছুয়েছিল।
তালিকাভুক্ত বন্ধ কারখানা চালুর উদ্যোগ ও লোকসানি কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার মত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বিশাল খরচের বহর নিয়ে বিদেশে রোড শো করেন একাধিক দেশে।
তাতেও উন্নতি না হওয়ায় ২০২২ সালে তিনিও পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস বসান, যা ধীরে ধীরে তোলা হচ্ছে এখনও।
আবুল খায়ের হিরু, সাকিব আল হাসান, মতিউর রহমানের মত বাজার কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়েও থেমে যান তিনি।
বড় অঙ্কের কারসাজির বিপরীতে নামমাত্র জরিমানা করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ফরচুন শু, জেনেক্স ইনফোসিস, সোনালী পেপার, ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্স, এনআরবিসি ব্যাংক ও আইপিডিসি ফিন্যান্স এর মত অনেক কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হলেও তাদের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নেয় বিএসইসি। কয়েকটির বিরুদ্ধে তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি।
এতে বাজারও ঘুরে দাড়াতে পারছে না গত কয়েক বছর ধরে। বিতর্কের অবসান না হওয়ায় বাজার ফের সাড়ে ৫ হাজার সূচকে নেমে যায়।
সরকারি সফরে কানাডা থেকে গত ৩ অগাস্ট রাতে ঢাকায় ফিরেছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
তিনিও অফিসে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী কি হবে, তা তো জানতে পারছি না। দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে বলা হবে, না কি ছেড়ে দিতে হবে তা বুঝতে চাচ্ছি।’’
‘‘পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনে আমার আগের দায়িত্বে ফিরে যাব,’’ যোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক।
প্রেষণে গত দুই মেয়াদে চার বছর ধরে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
আরেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীও মঙ্গলবার নিজ দপ্তরে যাননি। কবে নাগাদ দায়িত্বে ফিরবেন তা জানতে একাধিকবার চেষ্টা ও ক্ষুদে বার্তা দিলেও তার সাড়া মিলেনি।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘গত ২৮ জুলাই ব্রেইন স্ট্রোক হয় আমার। আগামী তিন সপ্তাহ পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে হচ্ছে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র মেনে।’’
তিনি বলেন, ‘‘আশা করছি, দ্রুত সুস্থ হলে কাজে যোগ দিতে পারব।’’