অনলাইনভিত্তিক খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করা ছোট উদ্যোক্তরা ছাড়াও সঙ্কটে আছেন বহু ফ্রিল্যান্সার।
Published : 25 Jul 2024, 01:06 AM
পরিবার গ্রামে রেখে ধানমণ্ডিতে একা থাকেন মামুন। কয়েক মাস আগে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারীর চাকরিটি খোয়ানোর পর নিজের মোটরসাইকেলকে পুঁজি করে শুরু করেন খাবার সরবরাহের কাজ।
এই কাজ করতে গিয়েই গত শুক্রবার কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলা সহিংসতার মধ্যে পড়েছিলেন। বলতে গেলে, সেদিন জীবন হাতে করে ফিরতে পেরেছিলেন। এরপর থেকেই ঘরে বসা মামুন। কারফিউর শিথিল সময়ে হয়ত ডেলিভারি দিতে পারতেন, কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সেটিও হচ্ছে না।
“মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের নই, এমন একটি পর্যায়ে আছি যে, দিনের আয় দিনে করে খেতে হয়। কারো কাছে চাইতে পারি না আবার দিতেও পারি না,” অসাহয়ত্বের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "অরাজক পরিবেশ থাকুক বা অন্য যা কিছুই হোক, রোজগার করলে পেট চলবে, আমাকে এমন চিন্তাই করতে হয়। মা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কই যাব? আর এখন তো সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। সব অর্ডার শেষ। এতদিনের কষ্টে জমানো টাকা ভেঙে খাচ্ছি।”
পাঁচ দিন পর মঙ্গলবার রাত থেকে দেশের কিছু কিছু জায়গায় ইন্টারনেট ফিরতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত। তবে ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আপাতত চালু হচ্ছে না বলে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে।
কিন্তু খাবারের ব্যবসা ও অর্ডার দুটোই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর। তাই এসব মাধ্যম চালু না হলে মামুনের মতো মানুষের বিপদ সহসাই কাটছে না।
ফেইসবুক পেইজ খুলে খাবারের ব্যবসা চালানো ছোট উদ্যোক্তারাও ইন্টারনেট না থাকায় পড়েছেন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে।
ফেইসবুকের মাধ্যমে খাবারের ব্যবসা পরিচালনা করে ‘গাপুস’ নামের একটি পেইজ।
পেইজটির স্বত্তাধিকারী মাহমুদা মালেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুক্রবার দুপুর ১২টার মধ্যে গুলশানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে খাবার পৌঁছানোর কথা ছিল। সকাল ১১টার মধ্যেই ডেলিভারি দেওয়া গেছে। তবে কিছু স্থানে পৌঁছানো যায়নি। রাইডারা খাবার নষ্ট না করে খেয়ে নিয়েছে। এতে অনেক গ্রাহক টাকা ফেরত চেয়েছেন, কয়েক হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
গত কয়েকদিন ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় সব অর্ডার বাতিল হয়েছে এই উদ্যোক্তার। যারা পেইজটি থেকে নিয়মিত খাবার নিতেন তারা অবস্থা বুঝে আবার খাবার নেবেন বলে জানিয়েছেন।
মাহমুদা বলেন, “যেহেতু দুপুর, রাতের বা অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ খাবার তৈরি করি তাই কয়েকদিন আগেই অর্ডার নেওয়া হয় এবং সে অনুযায়ী বাজারও করা হয়। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগের অবস্থা প্রায় নেই, ডেলিভারিও সম্ভব না। এখন তো পুরো বাজারের টাকাই নষ্ট হলো।”
একই সমস্যায় আছেন অনলাইনে পোশাক বিক্রি করেন এমন উদ্যোক্তারা। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তাদের কারও অর্ডার বাতিল হয়েছে, কেউ ডেলিভারি দিতে পারছেন না। আবার কারো হাজার হাজার টাকার পোশাক তাঁতিদের কাছে আটকে আছে।
এমন একজন উদ্যোক্তা বুশরা বিনতে আলম। তার পেইজের নাম ‘মিরান’। মূলত জামদানি শাড়ি বিক্রি করেন এই তরুণী।
বরিশাল থেকে পেইজটি পরিচালনা করলেও ঢাকাসহ সারাদেশেই শাড়ি ডেলিভারি করেন তিনি।
বুশরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মুহূর্তে আমার প্রায় ৫৬ হাজার টাকার শাড়ি তাঁতির কাছে আটকে আছে, যোগাযোগের অভাবে ডেলিভারি দিতে পারছি না। ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সব যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ থাকায় গ্রাহকদেরও কোনো তথ্য দিতে পারছি না। এতে পেইজের নির্ভরযোগ্যতা অনেকটাই কমবে। এছাড়া তাঁতিদের নতুন কোনো ডিজাইন দিতে পারছিনা। তাই কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে।”
আর্থিক ক্ষতির চেয়েও পেইজের রিচ কমে যাওয়া নিয়েই বেশি চিন্তিত এই উদ্যোক্তা বলেন, “এতদিন ফেইসবুক বন্ধ থাকায় রিচ একেবারেই কমে যাবে। ফলে রিচ বাড়াতে দিনে ১০টিরও বেশি পোস্ট করে লাভ হবে কিনা জানি না। এছাড়া পেইজ বুস্ট করতে হবে বেশি। আগে একদিনে ৫ ডলার বুস্ট করে যে রিচ পাওয়া যেত এখন সেখানে ১০ ডলার করতে হবে। সবদিক দিয়েই আর্থিক ক্ষতি হবে।"
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বহু ফ্রিল্যান্সারাও আছেন সংকটে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিষ্ঠানে প্রজেক্ট ম্যানেজার ও নিউ জিল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানে টেক লিড হিসেবে কাজ করেন সাব্বির আল ফাহাদ।
গত বৃহস্পতিবার মিটিং চলার সময় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয় তার। ফলে দেশের অবস্থা সম্পর্কে অফিসে কিছুই জানাতে পারেননি সাব্বির।
তিনি বলেন, “সঠিক সময়ে কাজ পৌঁছাতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠান অন্য কাউকে নিয়ে নেবে। সেক্ষেত্রে আমি চাকরিও হারাতে পারি, যেহেতু কোনোভাবেই অফিসে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না।
“ইন্টারনেট নেই আর তার ওপর ফোনের নেটওয়ার্কও ছিল খুব স্লো। অফিসে ফোন বা মেসেজ কিছুই দেওয়া যায়নি। ইন্টারনেট না থাকায় কোনো সফটওয়্যার বা অ্যাপে কাজ করা সম্ভব হয়নি। কাজগুলো সব জমে আছে।”
তবে মঙ্গলবার রাত থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ইন্টারনেট চালু হওয়ায় সাব্বিরের মতো ফ্রিল্যান্সারদের বিপদ কিছু কাটলেও মামুন, বুশরা ও মাহমুদারা চিন্তায় আছেন, ক্ষতির পরিমাণ সামনের দিনগুলোতে হয়ত আরও বাড়বে।