ক্রোয়েশিয়ার প্রাচীন শহরে শুনেছি সমুদ্রের সুর

মায়াবী পরিবেশে সূর্যাস্তের সময় দূর থেকে ভেসে আসছে সি অর্গানের সুমধুর সুর। সি অর্গানে সমুদ্রের ঢেউ এসে পড়লেই সুর বেজে ওঠে।

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুলঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
Published : 27 March 2023, 10:03 PM
Updated : 27 March 2023, 10:03 PM

এবারের হেমন্তের ছুটিতে ভেবেছিলাম সবাই দল বেঁধে ইতালির সিসিলি যাবো। কিন্তু প্লেনের টিকেট আর আমাদের যাওয়ার সময়  কিছুতেই মিলছিল না। তাই কোথায় যাবো বলতে বলতে সবাই মিলে ক্রোয়েশিয়া যাওয়া মনস্থির করে ফেললাম।

আমাদের সাত জনের দল ভোরবেলা রওনা হলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। দুপুর বেলায় ফ্লাইট। সেই সকালে তড়িঘড়ি করে ঠিক মতো খেয়েও বের হতে পারলাম না। সবার মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। সেইসাথে হালকা ক্ষুধা ক্ষুধা ভাব। ভাবছি দেড় ঘন্টারই তো ফ্লাইট, নেমেই খাওয়া-দাওয়া করবো।

নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট পৌঁছালো। আমরা এয়ারপোর্টের বাইরে বের হলাম। একটা গাড়ি আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখা হয়েছিল। শুধু চাবি বুঝে নিয়েই আমাদের বুকিং করা বিশাল বড় বাড়িতে দৌড় দেব এমন চিন্তা যখন করছি, তখন দেখা গেলো আমার বর গাড়ির চাবি আর কাগজপত্র আনতে গিয়ে আর আসছে না।

কী ব্যাপার? ভাই আসে না কেন? বলতে বলতে বাকি দুজনও চলে গেলো সামনের অফিসে। প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে ওরা লাইনেই দাঁড়িয়েই আছে। আর আমরা বাইরে বসে গাড়ি পেলেই আগে খাবো নাকি বাসায় যাবো সেই নিয়ে পরিকল্পনা করছি। খেতে গেলে কোথায় যাওয়া যেতে পারে, কী কি খাবো, সেসব চিন্তা-ভাবনা। যেহেতু সবাই ক্ষুধার্ত, আমাদের যে কোনো আলাপই শেষ পর্যন্ত খাবারের কথা দিয়ে শেষ হচ্ছে।

ভাগ্য যেন মুচকি হাসছে আমাদের কথা শুনে; আর বলছে, এত প্ল্যান যে করছো, দেখো না কি হয়! এর মধ্যেই ছোট ভাই তামিম চেষ্টা করলো সবাই মিলে কফি খাওয়া যায় কিনা, কিন্তু বিধিবাম, কোনা (ক্রোয়েশিান কারেন্সি) ছাড়া এয়ারপোর্টে কফি কেনা সম্ভব হলো না। ছোট ভাই গেল কোনা কেনা যায় কোথায় তা খুঁজতে।

অবশেষে গাড়ির চাবি হাতে বিজয়ী তিনজন বাবাই, আর সাথে দুজন ছোট ভাই তামিম আর হাই হাসি মুখে বের হয়ে এলো আমাদের কাছে। ভীষণ খুশি তিনজন। আমরা হাঁটা শুরু করলাম বিশাল পার্কিং লটে আমাদের জন্য নির্ধারিত গাড়ির খোঁজে।

গাড়িতে উঠেই আমরা রেস্তোরাঁয় যাবো আগে, এ কথা বলতে বলতে ঠিক যখন গাড়ি খুঁজে পেলাম, সবার মুখের হাসি মুহূর্তেই উবে গেল। বিশেষ করে আমাদের ড্রাইভারের থুড়ি আমার বরের মুখ চুপসে গেলো বিশাল ট্রাকের সমান গাড়ি দেখে।

তামিম বললো, আপু তুমি ভাইয়ের পাশে বসলে মনে হয় ভাই ভরসা পাবে। ভরসা দেওয়ার জন্য বরের পাশে যেই না বসলাম মনে হলো আমরা পাহাড়ের ওপরে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।

আমরা সাত সিটের যে গাড়ি বুক করেছিলাম, সেটা না থাকায়  আমাদের এই বিশাল নয় সিটের গাড়ি দেওয়া হয়েছে। এই গাড়িতে সিটে বসার পাশাপাশি মেঝেতেও বসে-শুয়ে আরাম করার মত অনেক জায়গা।

এখানে পাহাড়ি এঁকেবেঁকে চলা রাস্তায় এই বিশাল গাড়ি কীভাবে চালানো সম্ভব তাই নিয়ে আমরা এমনই চিন্তিত হলাম যে, সবার মধ্যেই হতাশা জেঁকে বসলো। বাবাই গাড়ি স্টার্ট দিয়েও থামিয়ে দিয়ে বললো, এই রিস্ক কোনো ভাবেই নেওয়া উচিত নয়।

আমরা সবাই যেন এই কথার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। সবাই সাথে সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। কিন্তু বুকিংয়ের টাকা ফেরতযোগ্য ছিল না। এখন কী উপায়? লিওনেল, তামান্না, মৌ, আর আমাকে রেখে ওরা তিনজন গেল কী করা যায় দেখতে।

গেল তো গেল আর ফেরার নাম নেই। এদিকে প্লেন থেকে নেমেছি প্রায় দুই ঘন্টার কাছাকাছি হয়ে গেল। কোথায় এই সময় আমাদের সমুদ্রের তীরে সূর্যাস্ত দেখার কথা, তা না আমরা এয়ারপোর্ট থেকেই বের হতে পারছি না। সেই সাথে রয়েছে রাজ্যের চিন্তা, ক্ষুধা আর অনিশ্চয়তা।


যাই হোক অনেক কাঠ-খড় পুরিয়ে অবশেষে গাড়ি ফেরত দেওয়া গেল।  টাকাও ফেরত দেওয়া হবে বলে জানালো ওরা। এবার ঠিক করলাম উবার নেব। কিন্তু এবারও সাত সিটের গাড়ি পাওয়া গেল না। তাই দুটো গাড়ি নিয়ে হাজির হলাম আমাদের ছুটির দিনের বিশাল ভিলাতে।

ভিলাতে এসে মনটা ভালো হয়ে গেল সবার। সামনে সুইমিং পুল, গ্রিল করার ব্যবস্থা আর ভেতরটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। সবাই ক্ষুধার্ত। ছেলেরা পানি, চাল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গেল দোকানে। আমি রান্না করে এনেছিলাম। তাই দিয়েই সবাই খাওয়া সেরে চললাম রাতের আলোয় সমুদ্রসৈকত আর পুরোনো শহর ঘুরে দেখার জন্য।

ক্রোয়েশিয়ার একটি উপকূলীয় শহর জাদার। এই শহর প্রায় তিন সহস্রাব্দের ইতিহাস ধারণ করে রয়েছে। সেইন্ট ডোনাটাস চার্চ কিংবা জাডার ক্যাথেড্রাল মানেই হলো পুরোনো ইতিহাসের গন্ধমাখা স্থাপত্য। রাতের আলোয় আমরা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি সাগরের একটি ছোট্ট অংশের ধার ঘেঁষে। সাগরের এদিকে মাছ ধরার নানা ধরনের নৌকা, স্পিডবোট আর মাঝারি আকৃতির জাহাজগুলো হালকা ঢেউয়ে ধীরে ধীরে দোল খাচ্ছে। মাছের আশঁটে গন্ধ আর দূর থেকে ভেসে আসা কোনো ক্লাবে বাজানো মিউজিক, সব মিলিয়ে কেমন অদ্ভূত শান্তি শান্তি পরিবেশ।

পুরোনো শহর বিশাল এক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এটাও আমার কাছে নতুন এক অভিজ্ঞতা। এত দেশ ঘুরেছি, কিন্তু এরকম প্রাচীর দিয়ে ঘেরা শহর খুব একটা নজরে আসেনি আগে কখনও। এই প্রাচীরটাই যেন জায়গাটির ভারিক্কি আর পুরোনো ভাবকে দশ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

রাতের শহর দেখা আর দিনের শহর দেখার মাঝে অনেক পার্থক্য। আর রাতের শহরকে দেখতেই আমার বেশি ভালো লাগে। পুরোনো শহরের অলিগলি ঘুরছি সবাই মিলে। যদিও পুত্র আর হাঁটতে না পেরে বাবার সাথে বাসায় চলে গিয়েছে। কিন্তু আমি যেন রাতের শহরে ঘোরার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। আর তাই সবার সাথে রয়েই গেলাম। রাস্তাগুলো সাদা পাথরের। রাস্তার আলো পড়ায় দেখে মনে হচ্ছিল যেন বৃষ্টি দিয়ে ধুয়ে গিয়েছে। এই মায়াবী পরিবেশের মাঝে নবম শতকে তৈরি হওয়া সেইন্ট ডোনাটাস চার্চ দেখে মনে হচ্ছিল প্রতিটা পাথরে যেন হাজারও গল্প গেঁথে রয়েছে।

গভীর রাতে ফিরে এলাম সবাই।পরদিন ক্রকা ন্যাশনাল পার্কে (Krka National Park) বেড়াবো ঠিক হলো। আমরা বাসের টিকেট কেটে অপেক্ষা করছি তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে।কিন্তু আমাদের বাসের দেখা নেই। আসছে অন্য প্ল্যাটফর্মের বাসগুলো। এমন অবস্থায় আমার বর খবর নিতে গিয়ে আর ফিরছে না। তাকে খুঁজতে হাই গেলো, সেও ফিরছে না।  আর কেউ যাওয়া উচিৎ হবে কিনা এমন আলোচনার মাঝে তামিমও গেলো তার বউসমেত। তামিমও আর ফেরে না। কিছুক্ষণ পর মৌ খবর আনলো বাস নাকি আমাদের সামনে থেকেই চলে গিয়েছে। কাউন্টারের মেয়েটা ভুল তথ্য দিয়েছে। এবার আবার টিকেট ফেরত নিয়ে টাকা ব্যাক করার যুদ্ধ। আমরাও চললাম যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। যেই না পৌঁছালাম ওমনি দেখলাম যুদ্ধজয়ীদের মুখে হাসি। কি আর করা উবার নিয়ে আমরা চললাম।

ক্রকা নদীর ওপর দিয়ে বোটে করে পৌঁছালাম ক্রকা ন্যাশনাল পার্কে। সিরিজ অফ সেভেন ওয়াটারফল নামে সাতটি জলপ্রপাতের জন্য এর পরিচিতি রয়েছে।


প্রায় ১৮ প্রজাতির মাছ রয়েছে এই নদীতে। আর পার্কে প্রায় ৮৬০ প্রজাতি ও উপ-প্রজাতির গাছ ও ২২২ প্রজাতির পাখি রয়েছে। একদম ওপরে ওঠার পর দেখি বিস্তর্ণ বনভূমি আর নদী এঁকেবেঁকে দৃষ্টিসীমানার বাইরে হারিয়ে গেল।  আমরা সবাই কম-বেশি ওপরে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তারমাঝেই দেখি একজন মানুষ, তার ভাঙ্গা পা নিয়ে ক্রাচে ভর করে ওপরে উঠছে। মানুষের ইচ্ছাশক্তি দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

ফিরে এসে সবাই মিলে ক্রয়েশিয়ান রেস্তোরাঁতে অতি অখাদ্য নানারকম মাছের আইটেম খেলাম। ভেবেছিলাম অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলের মতো এখানেও খাবারগুলো মজাদার হবে। কিন্তু তা একেবারেই নয়। সবাই ধোঁকা খেয়ে আবার মাঝরাত অবধি পুরোনো শহরে চক্কর দিলাম সবাই মিলে।

পরেরদিন হাই এর তৈরি করা মজাদার ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। যদিও এখানে সব পাথুরে বিচ, আর অক্টোবর বলে পানি বেশ ঠাণ্ডা। কিন্তু কেউ সেটা পাত্তা না দিয়ে সোজা নেমে গেল পানিতে। সারাদিন সেখানে থেকে প্ল্যান ছিল সবাই মিলে সূর্যাস্ত দেখবো সৈকতের বিশেষ জায়গাতে বসে। ওরা বলে সান গ্রিটিংস।  মায়াবী পরিবেশে সূর্যাস্তের সময় দূর থেকে ভেসে আসছে সি অর্গানের সুমধুর সুর। সি অর্গানে সমুদ্রের ঢেউ এসে পড়লেই সুর বেজে ওঠে। এখানে সূর্যাস্ত দেখার জন্য শত শত টুরিস্ট ভিড় করে রয়েছে। কেউ বসেছে, কেউ বা দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমরা সবার থেকে কিছুটা দূরে একদম সমুদ্রের ধার ঘেঁষে বসে সূর্যাস্ত দেখছি। ধীরে ধীরে গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যার আকাশে তারা ফুঠে উঠছে, আর আমরা গাইছি গলা ছেড়ে, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা...’।

আপনার নিবন্ধিত ইমেইল থেকে অপ্রকাশিত লেখা/ছবি/ভিডিও আকারে নাগরিক সংবাদ পাঠান citizen.journalism@bdnews24.com  ঠিকানায়।  
নিবন্ধিত নাগরিক সাংবাদিক হতে আপনার নাম (বাংলা ও ইংরেজিতে), ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেইল আইডি এবং ছবি  citizen.journalism@bdnews24.com  ঠিকানায় ইমেইল করুন।