শৈশব থেকেই দুরন্ত মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম ক্রিকেট খুব ভালবাসেন। খেলতেনও খুব। ২০১০ সালে সীতাকুন্ডে মালবাহী ট্রেন দুর্ঘটনায় ডান পা হারালে অনেক স্বপ্ন ভঙ্গ হয় তার। কিন্তু জীবনে এমন অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও হার মানেননি এই তরুণ।
শরিফুল ইসলাম এখন বাংলাদেশ ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ক্রিকেট টিমের উইকেট রক্ষক এবং ব্যাটার।
১৯৯৭ সালের ২৩ জুন চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড থানার দক্ষিণ সলিমপুর ফকিরহাট গ্রামে জন্ম হয় শরিফুল ইসলামের। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
শরিফুলের মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। বাবা আইয়ুব আলী মারা মারা গেছেন।
হিসাববিজ্ঞান নিয়ে চট্টগ্রামের সিটি গেইট এলাকায় আলহ্বাজ মোস্তফা হাকিম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়তেন শরিফুল। পরিবারের আর্থিক টানাপোড়নে শরিফুলের পড়ালেখা থেমে যায় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষেই।
দুর্ঘটনার পর কিছুটা সুস্থ হতেই শরিফুল আবারো খেলাধুলার চেষ্টা করেন। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাধ সাধে তাতে।
এরপর সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজ্ড (সিআরপি) প্রতিষ্ঠানের কৃত্রিম পা সংযোজনের কথা জানতে পারেন তিনি। প্রথমে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সিআরপিতে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে যান সাভার সিআরপিতে যায়
দুর্ঘটনায় পা হারানোর পর শরিফুলের চারপাশ বদলে গিয়েছিল। কৃত্রিম পা সংযোজন করে আগের মত খেলার স্বপ দেখতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু পরিবার থেকে তার এই শারীরিক অবস্থায় খেলা নিয়ে সায় ছিল না কোনো।
শরিফুল লুকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ছোটদের সঙ্গে খেলার চেষ্টা করতেন। এক সময় ঠিকই ব্যাটে-বলে করতে পারছিলেন তিনি। তখন এলাকায় অনেকেই তাকে সহযোগিতা করা শুরু করল। অন্যরা এরপর শরিফুলকেও খেলাতে নিত।
২০১৪ সালে চট্টগ্রাম সিআরপিতে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেন এই তরুণ। সেখানেই ক্রিকেট খেলোয়াড়ের খোঁজে একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন হয়। ৪০ জন ছেলে থেকে শরিফুলসহ ২ জন সুযোগ পায়।
আর সারাদেশ থেকে শরিফুলসহ ৩০ জন নির্বাচিত খেলোয়াড় ঢাকা সিআরপিতে মাসব্যাপী ক্যাম্পে যোগ দেয়।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বিকেএসপিতে সারাদেশ থেকে ৫০০ ছেলে টেলেন্টহান্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেখান থেকে বাছাই পর্বে ২০ জনের মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে শুধুমাত্র শরিফুলই সুযোগ পান।
বিকেএসপির মাসুদ হাসান, বিসিবির রাশেদ ইকবাল, জসীম উদ্দিনের ক্রিকেট কোচের অধীনে বাংলাদেশ ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ ক্রিকেট টিমের একজন নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে চলতে থাকে শরিফুলের অনুশীলন।
শরিফুল দেশেই ২০১৫ সালে পাঁচ জাতি ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ২০১৭ সালে আইসিআরসি আয়োজিত বিভাগীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ২০২১ সালে কুষ্টিয়ায় চার বিভাগ নিয়ে আয়োজিত টুর্নামেন্ট, ২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু চার জাতি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নেন।
ভাল খেলার কারণে বিভিন্ন খেলায় ম্যান অফ দি ম্যাচ, সেরা ব্যাটার, ম্যান অফ দি টুর্নামেন্টও হয়েছেন শরিফুল।
জীবিকার প্রয়োজনে প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ওই প্রতিষ্ঠানের কমার্শিয়াল (ইমপোর্ট) বিভাগে অফিস সহকারী হিসেবে যোগদান করেন।
তবে শরিফুলের ক্রিকেট অনুশীলন ধরে রাখতে চাকরিতে তার বিভাগীয় প্রধান, মানবসম্পদ বিভাগীয় প্রধান, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবরই উৎসাহ দিয়ে থাকেন। ফলে কাজ ও ছুটি নিয়ে কখনও প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়নি সেখানে।
শরিফুলদের টিমে যারা খেলছেন তাদের কারো পা নেই, কারো হাত নেই। কারো রয়েছে চলাফেরায় শারীরিক জটিলতা।
মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহিম, এনামুল হক বিজয়, সাব্বির রহমান, শফিউল ইসলাম, মোহাম্মদ আশরাফুলদের মত দেশ বরেণ্য জাতীয় ক্রিকেটারও এই খেলোয়াড়দের পথচলায় সব সময় পাশে থেকে উৎসাহ দিয়েছেন, বলে জানালেন শরিফুল ইসলাম।
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও পতাকা বুকে দেশকে বেশ কয়েকবার উপস্থাপন করেছেন শরিফুল।
২০১৬, ২০১৭ ও ২০২২ সালে ভারত, ২০১৭ সালে দুবাই, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে খেলেছেন দেশের হয়ে।
দুবাইয়ে ট্রাইনেশন সিরিজ ও ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপে খেলেছেন। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ওরচেস্টাশায়ার কাউন্ট্রি ক্রিকেট ক্লাব মাঠেও খেলেছেন শরিফুল ইসলাম।
দেশবিদেশের বিভিন্ন খেলায় ম্যাচ ফি না থাকলেও আছে প্রাইজ মানি ও টুর্নামেন্ট শেষে সম্মানি ভাতা।
বিদেশের মাটিতে খেলায় আর্থিক বিষয় ছাড়া অনাপত্তি পত্র, যাবতীয় কাগজপত্রসহ সব ব্যবস্থা করে দেয় বিসিবি।
আর্থিক বিষয়গুলো দেখে শরিফুলদের নিয়ে কাজ করা ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস, বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ, সিআরপি ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ক্রিকেট টিমসহ বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠন ও স্পন্সর প্রতিষ্ঠান।
ভালোবাসার ক্রিকেট ও চাকরি, সব মিলিয়ে শরিফুলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা এখন ভালো।
আগামীতে বিসিবি থেকে তাদের বেতনভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন শরিফুল। আর তাই ভালো খেলে টিমে জায়গা করে নেওয়া এবং পারফর্মেন্স ধরে রাখার চেষ্টায় অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন শরিফুল। শরিফুল ইসলাম বলেন, “আসলে যারা প্রতিবন্ধী আছে, হয়ত আমাদের সমাজের অনেকেই আজও আড়চোখে দেখে।
“আমি মনে করি সবাই তাদেরকে উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা দিলে তারাও দেশের জন্য অনেক সম্মান বয়ে আনতে পারে।
”আর যারা প্রতিবন্ধী আছে, তারা যদি নিজের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে পারে, তাহলে একদিন বিশ্বজয় করতে পারবে।”