টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের পথে

বোরহান বিশ্বাস
Published : 13 August 2020, 01:55 PM
Updated : 13 August 2020, 01:55 PM


গত বছর অগাস্টের প্রথম দিন টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) বড় ভাইদের সঙ্গে গোপালগঞ্জ গিয়েছিলাম।

আমাদের মত অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল দেখতে যান।  টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে রাখা আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কফিন। জাদুঘরেও সব সময় জনসমাগত দেখা যায়।

আমরা সকাল ৮টায় রওনা দিয়ে দুপুর ৩টায় সেখানে পৌঁছলাম। সাড়ে ৩টা নাগাদ সমাধিসৌধ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর বঙ্গবন্ধু  ও ১৫ অগাস্টে শহীদদের জন্য দোয়ায় অংশ নেন সবাই। কিছু সময় সেখানে থেকে আমরা আবার রওনা হই ঢাকার পথে। ঢাকায় এসে পৌঁছুতে রাত প্রায় ১টা বেজে গিয়েছিল। ঢাকা-মাওয়া সড়কে নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় যাওয়া-আসায় সময় লেগেছিল প্রায় ১৪ ঘন্টা। তবে সড়কের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর পথের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল অনেক।  গত নভেম্বরে খিলগাঁওয়ের পরিচিত এক বড় ভাই গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেকে ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যান। তাদের যাওয়া-আসায় সময় লেগেছিল মোটে ৮ ঘন্টা।

মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত জন্মভিটা গোপালগঞ্জ ছিল সবচেয়ে অবহেলিত অঞ্চলগুলোর একটি। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে হত্যার পর শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর লাশটি হেলিকপ্টারে করে গোপালগঞ্জের নিভৃতপল্লী টুঙ্গীপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই অতি সন্তর্পণে তাকে দাফন করা হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে দাফন করা হয় ঢাকার বনানী কবরস্থানে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক বঙ্গবন্ধুকে কেন গোপালগঞ্জেই কবর দেওয়া হল?

এ বিষয়ে কে এম শফিউল্লাহ তার 'বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গ' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, "তিনি খন্দকার মোস্তাককে বঙ্গবন্ধুর দাফন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, সেই বিশ্বাসঘাতক বলেন, রাস্তাঘাটে তো কত মানুষ মারা যায়, তাদের সবার দিকে কি আমার খেয়াল রাখতে হবে? গ্রেভ হিম অ্যানি হয়্যার, বাট নট ইন ঢাকা।"

বিশ্লেষকদের মতে, ঘাতকরা হয়তো ভেবেছিল ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন করা হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তাই বঙ্গবন্ধুকে শহর থেকে বহু দূরে নদী-নালা, খালি-বিলবেষ্টিত গোপালগঞ্জের গাঁয়ে কবরস্থ করা হয়। তাদের ধারণা ছিল, দৃষ্টির আড়াল থেকে এক সময় মনের আড়ালে চলে যাবেন বাঙালির এই স্বপ্নদ্রষ্টা।

বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীন সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলার পথ মসৃণ করে দিলেও দক্ষিণাঞ্চল থেকে যায় কণ্টকাকীর্ণই। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে গোপালগঞ্জ জেলার উন্নয়নের কাজে হাত দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ধারাবাহিতকায় গোপালগঞ্জ জেলার উন্নয়ন আজ চোখে পড়ার মত।

গণমাধ্যমকর্মী শাহীনুর রহমান তার অভিজ্ঞতা থেকে বললেন,  "একটা সময় ঢাকা-আরিচা-ফরিদপুর-মাদারীপুরের সড়ক ধরে যেতে হত গোপালগঞ্জ। মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট থেকে একটি সরু রাস্তা ছিল গোপালগঞ্জ পর্যন্ত। অনেক সময় পর পর বাস আসতো। ভাঙাচোরা সড়কে কখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস উল্টে রাস্তার পাশে পড়ে যাবে সেটাই ছিল যাত্রীদের বড় ভয়।

"গোপালগঞ্জে যাওয়ার এই একটি মাত্র রাস্তাই ছিল। এছাড়া টেকেরহাট থেকে লঞ্চে করেও যাওয়া যেত বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমিতে। ঢাকার সদরঘাট নৌ টার্মিনাল থেকে রাতে একটি মাত্র লঞ্চ ছেড়ে যেত গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে। রাত পেরিয়ে পরদিন অনেক বেলায় কুমার নদ ও মধুমতি নদী পাড়ি দিয়ে গোপালগঞ্জ যেত সেই লঞ্চ।"

এরপর  সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর পিতৃভূমি টুঙ্গীপাড়ায় যাওয়া ছিল রীতিমতো এক সংগ্রাম বলে জানালেন তিনি।

"লম্বা সময় নৌকায় ভ্রমণ করে ওই অঞ্চলের মানুষদের যেতে হত টুঙ্গিপাড়ায়। দীর্ঘ এই যাত্রার ধকল সহ্য করার মতো শারীরিক সক্ষমতা অনেকেরই থাকতো না। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এটি ছিল অনেকটা যুদ্ধের মত।"

শাহীনুর রহমান বলেন,  "আজ গোপালগঞ্জ দেখলে হয়তো বোঝা যাবে না 'খোকার' জেলাটি কতোটা অবহেলিত ছিল!

"ঝকঝকে তকতকে প্রশস্ত মসৃণ রাস্তায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস চলাচল করায় মানুষ আরাম-আয়েশে মাত্র পাঁচ ঘন্টার ব্যবধানে পৌঁছে যাচ্ছে গোপালগঞ্জ। দিনে গিয়ে দিনেই জাতির পিতার কবর জিয়ারত করে ঢাকায় ফিরতে পারছেন রাজধানীবাসী।"

ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া হয়ে ফেরিতে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে দিন-রাত গাড়ি চলছে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে। আর স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সময় লাগবে আরো কম।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় জাতির পিতার মাজার জিয়ারত করার জন্য গোপালগঞ্জে যাওয়ায় সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে হেলিপ্যাড।

কয়েক মাসে আগে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের (ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা আট লেনের সড়ক) উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা তুলে ধরে তিনি মজা করে বলেন, "সবচেয়ে বড় কথা, আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে পারব।"

বেদনার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন,  "দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সব সময় অবহেলিত ছিল। দীর্ঘ ভোগান্তি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে যেতে হত।"

ইতিহাস তার আপন নিয়মেই যোজন যোজন দূরে থাকা জাতির জনকের সমাধিসৌধ যাওয়ার পথ খুঁজে নিয়েছে। যে পথ চলে গেছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর থেকে সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার পথে।