কবিতার মানচিত্র

সবুজ তাপস
Published : 10 Jan 2021, 05:16 PM
Updated : 10 Jan 2021, 05:16 PM

শোন, সেই
কবে থেকে ঘুমের ভেতরে খুঁজছে অনেকেই

চার্বাক, গৌতম, বুদ্ধ, বাল্মিকী, পাণিনি,
কালাপাহাড়, ব্যাস, রবি, জৈমিনি..

জানো, আমি খুঁজিতেছি কাকে?
– শুধু তোমাকে, শ্রী সব
– তোমাতে আমাকে,
তাণ্ডব!
(খোঁজাখুঁজি)

'Be good only for saving yourself and the world'- এই দৃষ্টান্তবাদী নীতির কাব্যিক উপস্থাপন। কবিতাটি আমার। নিজের ভেতরে সন্ধানকর্ম চলছে। 'তোমাকে' পেতে হবে। এ-তুমি কে? এ-তুমি 'শ্রী সব', সকল সুন্দর উপাদান। সুন্দরের প্রতি মানসলোভ সচেতন মানসিকতারই পরিচায়ক। উদ্দিষ্ট বস্তুর চূড়ান্ত যোগ এখানেও ঘটেনি। অর্থাৎ সন্ধান-অভিযান চলছে, অন্যের ভেতরে নিজের অস্তিত্বের তালাশ। 'তোমাতে আমাকে' পেতে চাই। এ-আমি বা আপনজন কে? এ এক তাণ্ডব, অন্যের ভেতরে অনুকূল তুমুল অস্থিরতা। উপনিবেশবাদিতা যেখানে মানুষের ভেতরে 'অপর' শ্রেণি তৈরি করেছে, সেখানে দৃষ্টান্তবাদিতা কী সুন্দররূপে তাদের আপন করে নিয়েছে! তাহলে দৃষ্টান্তবাদ কি উত্তর উপনিবেশবাদী দর্শন? এর সমাধান অন্য গদ্যে রয়েছে। এখানে যে-কথা বলার জন্যে কবিতাটি উপলক্ষ্য-আকারে তুলে ধরলাম, তা হলো- কবিতা মানুষের জন্যই। কবিতা কি মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী লেখে? কোনো সত্তাও নয়, মানুষই কবিতা লিখে, মানুষই কবিতা পড়ে। স্বরবৈত্তিক কবিতার তালে বানর নাচানো যেতে পারে, তবে চিত্তবিনোদনটা মানুষেরই হবে। জগতটাই যেখানে মানুষের স্বার্থগত সম্পত্তি, সেখানে কবিতার উদ্দেশ্য মানবকেন্দ্রিক হতে বাধ্য। বলতে চাচ্ছি, কবিতা মানুষের স্বার্থে মানুষেরই রচনা।

এখন এমন সময় চলছে, কবিতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া মানে দৃষ্টান্তবাদী কবিতার লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত হতে চাওয়ার সময়। 'শিল্পের জন্য শিল্প' (Art for art's sake) এবং 'জীবনের জন্য শিল্প' (Art for Life's sake) – এ-দুই প্রত্যয় এবং কিছু শিল্প-সাহিত্যঘেঁষা আধুনিক আন্দোলনের সাথে দৃষ্টান্তবাদের ভেদরেখা তুলে ধরার মধ্য দিয়েই কবিতার লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য তথা মানচিত্র হাজির করছি। উল্লেখিত দু'প্রত্যয় বা মত সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত, বিংশ শতাব্দিতে শিল্প-সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনায় উঠে আসে। বাঙালি সমালোচক এবং পণ্ডিতরাও দুটো সম্পর্কে এ-যাবত কম আওড়াননি। প্রথমটি সম্পর্কে ফরাসি লেখক জর্জ চাঁদ (George Sand) বলেছেন, এটি একটি শূন্য শব্দগুচ্ছ (empty phrase), একটি অমূলক বাক্য (idle sentence)। তিনি জোরালোভাবে ঘোষণা করেছেন, "duty to find an adequate expression to convey it to as many souls as possible", ensuring that their works were accessible enough to be appreciated ( Letters of George Sand, Vol 3)"।

এ-মতের প্রবক্তারা ভারতে বিশ্বনাথ কবিরাজের 'সাহিত্য দর্পণ'-এ অনেক আগেই উন্মাদ বলে অভিহিত। ইউরোপে মার্কস ও এঙ্গেলস এই মতের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এঙ্গেলস বলেছেন: র‌্যাফেলের চিত্রকলা, থরওয়াল্ডসনের ভাস্কর্য ও প্যাগানিনির সঙ্গীতে পরিলক্ষিত শিল্পনৈপুণ্যের পেছনে রয়েছে শ্রমিকের হাত। এই হাতের অবদান অনস্বীকার্য। শিল্পের সৌন্দর্যোপভোগে এ-হাতের মূল্যায়নও জরুরি।

এঙ্গেলসের মতের সাথে ভারতীয় নন্দনতাত্ত্বিক আনন্দ কুমার স্বামীর মতের সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন, শিল্পীর সাধনা বিশুদ্ধ চৈতন্যের , সুন্দরের, আনন্দের- তা ঠিক আছে, কিন্তু সৃজনকর্মের সাথে যুক্ত অনালোচিত ও অগণ্য কামার, কুমোর, কৃষকরাও শিল্পী। বাঙালি লেখক যতীন সরকারের ধারণা এই: "…আমরা প্রায় সবাই … চিত্তগত সংস্কৃতিকেই একমাত্র সংস্কৃতি বলে ধরে নিই, বস্তুগত সংস্কৃতিকে যেন সংস্কৃতিই মনে করি না। এমনটি করতে গিয়ে আমরা এক ধরণের ভাববাদের খপ্পরে পড়ে যাই। এই ভাববাদ থেকেই কলাকৈবল্যবাদী ভাবনা আমাদের মনে শিকড় গেড়ে বসে। এরকম পার্থক্য প্রকৃতির ধারণাকেই বিকৃত করে ফেলে। এরকম বিকৃত ধারণার দরুনই চিত্তগত সংস্কৃতি ও বস্তুগত সংস্কৃতির পারস্পরিক প্রভাবের একান্ত অপরিহার্যতার বিষয়টিও আমাদের চেতনা থেকে মুছে যায়।"

দৃষ্টান্তবাদে দুটোরই কদর রয়েছে। কেননা, মানুষ দুয়ের অনুসারী এবং সমযদার। কবি যখন কবিতার উদ্দেশ্যে পঙ্ক্তিনোঙর ছোঁড়েন, তার মনে দুয়ের একটি অথবা উভয় চেতনা বিদ্যমান থাকে; শিল্পের জন্যে যে শিল্প করতে যান, ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাব, তার ভেতরেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিহিত জৈবনিক প্রশ্নফণা। এটা, জ্ঞাতে হোক আর অজ্ঞাতে হোক, তার সুন্দর-শিল্পিত সমাজের প্রতি মানসলোভ থাকার কারণেই। সুন্দর-শিল্পিত সমাজটাই তো আমাদের কাম্য। তবে দৃষ্টান্তবাদ এ-দুটোর প্রশ্রয়ে লেখা যেকোনো অবাস্তব বিশ্বাসঘেঁষা কবিতাকে পাঠ্য মনে করে না এবং এ-জাতীয় কবিতা যাতে দৃষ্টান্তবাদীদের কলমের খোঁচায় হাজির না হয়, উৎচক্ষু থাকতে হয়। চলমান এই যন্ত্রনির্ভর যুগে কবিদের চেতনে-অবচেতনে অবাস্তব বিশ্বাসের পক্ষাবলম্বন অথবা বিরোধিতা অথবা নবরূপদান করতে দেখছি। এবং এদের বেশিরভাগকে উল্লেখিত দু'প্রত্যয়ের কোনোটির প্রতি দৃঢ়নিশ্চয় থেকে লিখেছেন বা লিখছেন বলে মনে হয় না। অবশ্য এ-জায়গায় জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ কবিগণকে তুলে রাখা যাক, যদিও এঁদের লেখায় অবাস্তব বিশ্বাসের সহযোগ রয়েছে। জীবন বাবু মোটাদাগে শিল্পপ্রেমী এবং বাকি সবাই জীবনপ্রেমী।

কবিতার কাজ বা উদ্দেশ্য নিরর্থক-যুক্তিরহিত কথার জট-পাকানি নয়, প্রত্যক্ষভাবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল ভেদ করা নয়। এ-জায়গায় দাদাবাদের সাথে দৃষ্টান্তবাদের তফাৎ। কবিতার কাজ মানুষের মনকে শৈল্পিক আনন্দ দেয়া, মানুষকে নৈরাজ্যবাদী এবং নিহিলিস্ট করা নয়, সুন্দর সমাজের লোভে চিত্তরঞ্জনকর ভালো/চারু কথার সুবাস ছড়ানো। তবে কি প্রচলিত অথচ অকাম্য রীতিনীতি তথা মূল্যবোধের বিতাড়ন বা সমাজকে অশুভ সনাতনত্ব থেকে মুক্ত করতে চাই না?

চাই অবশ্যই, তবে হুগো বল (Hugo Ball), ত্রিস্তাঁ যারা (Tristan Tzara), হান্স আর্প (Hans Arp), রিচার্ড হ্যোলসেনবেক (Richard Huelsenbeck) প্রমুখ দাদাবাদীদের কথামতো নয়, অন্যভাবে: বিরোধিতাপূর্ণ বচন উচ্চারণ না করে এসব রীতিনীতির লালন-পালন করা থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে বা অসাংঘর্ষিক কৌশল দ্বারা মানসিকভাবে দূরতম ব্যবধানে রেখে। এ করতে হয় এজন্যে যে, প্রত্যক্ষভাবে অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বেদরকারী মূল্যবোধকে বিদায় জানাতে ঢাক-ঢোল পেটাতে থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার মতোন ভয়ানক-অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হাজির হয় এবং এতে ঐ বেদরকারী বা অশুভ রীতিনীতি এবং সৃষ্ট ভয়ানক ব্যাপার যাদের ফায়দা লোটার পক্ষে তাদের জঙ্গি চেঁচামেচি করা তথা রাজনৈতিক দৌড়ঝাঁপ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

অসংযত-অসংহত-অসংগত পরিবর্তনকামনায় মেতে লিফলেট ছড়িয়ে ভাইমার পার্লামেন্টে অভিযান চালিয়ে যোহানেস বাডের (Johannes Bader) নামের একজন দাদাবাদী নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেননি? আইন-আদালতের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে কোনো গুরু অপরাধের অভিযোগে ধৃত ব্যক্তির বিচার করতে বলা কি উচিত হবে? দাদাবাদীদের বক্তব্যানুসারে কাজটি করা 'উচিত'। দৃষ্টান্তবাদীরা মনে করেন, এ-জাতীয় কাজের ফল কল্যাণবাহী নয়, মানুষকে নান্দনিক দৃষ্টিধারী করতে পারা তো দূরের ব্যাপার।

পরাবাস্তববাদী আঁন্দ্রে ব্রেতঁ (Andre Breton), পল এলুয়ার (Paul Eluard), লুই আরাগঁ (Louis Aragon), অঁরি মিশো (Henri Michaux), গার্সিয়া লোরকা (Garcia Lorca), সালভেদর দালি (Salvador Dali) প্রমুখ কবি-লেখকের মতো দৃষ্টান্তবাদীরা অবচেতনমনের (Subconscious mind) ক্রিয়াকর্মকে নির্বিচারে গ্রহণ করেন না। যেহেতু অবচেতনায় তীব্রভাবে কার্ল মার্ক্সের (Karl Marx) মতো (পরাবাস্তববাদীরা অনেকটা উগ্র বামপন্থী এবং কম্যুনিস্ট বলে মার্ক্সের নাম উলেখ করলাম) দৈব বা ভৌতিক সত্তা তথা উদ্ভট-আশ্চর্যকর-অবাস্তব রূপকল্প হাজির হবার সম্ভাবনা থাকে, সেহেতু দৃষ্টান্তবাদ কবিতায় ঘুমের ভেতরে পাওয়া স্বাপ্নিক তথ্যেরও যৌক্তিক উপস্থাপন চায়। প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে – পরাবাস্তববাদীদের এ-ধরনের দৃঢ়নিশ্চয় কথায় দৃষ্টান্তবাদের সায় নেই।

এ-মতে, প্রকৃত সত্যের অনুভব চৈতন্যে বিদ্যমান এবং কবিতা এ-চৈতন্যেরই চারু উচ্চারণ। কবিতা বাস্তব কিছু চিন্তা করার সময় বা জাগতিক কোনো কাজে নিমগ্ন থাকার সময় হঠাৎ কোনো এক ফাঁকে কবির মনে উদয় হয় – কবিকে করে তোলে নাচিয়ে পিংপং বল, এর বেলায় অবচেতনার প্রশ্ন অনুত্থাপনীয়। Littérature জার্নালে, লুই আরাগঁ ও ফিলিপ সোপল্টের (Philippe Soupault) মতোন পরাবাস্তবাদীদের প্রস্তাবিত অটোমেটিক রাইটিং (Automatic Writing)-এর প্রতি দৃষ্টান্তবাদের সমর্থন নেই। তা ঐ সুন্দর সমাজের স্বার্থেই। তাদের কথামতো একজন কবিকে তার চিন্তার ওপরকার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তুলে নিতে হয়, এবং দ্রুততার সাথে, চিন্তাস্রোতকে অবাধ্য রেখে যা কিছু মনে আসবে তা-ই লিখে যেতে হয় অথবা এঁকে যেতে হয়। এ-জায়গায় দৃষ্টান্তবাদী তাগিদ এই: কবি শুভবোধ বজায় রেখে অনিয়ন্ত্রিত বা স্বেচ্ছাচারী থাকবেন, কিন্তু দ্রুততার সাথে যা কিছু মনে আসবে তা লিখে কবিতা বলে চালিয়ে দিয়ে সমাজকে নৈরাজ্যিক এবং সাহিত্যকে বেদরকারী পাঠে পরিণত করবেন না।

এখানে একটু ইঙ্গিত না দিলে নয়, আমাদের এখানকার জীবনানন্দ দাশ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক প্রমুখ কবিগণের কবিতায় পরাবাস্তববাদের (Surrealism) আছর লক্ষ করা যায়। সমসময়ের কোনোকোনো কবিও, জ্ঞাতভাবে হোক আর অজ্ঞাতভাবে হোক, মাঝেমধ্যে এ-জাতীয় কবিতা পয়দা করছেন। অবশ্য এদের পরাবাস্তববাদী নয়, পরাবাস্তবতাস্পৃষ্ট কবি বলা যেতে পারে। পরাবাস্তবাদের তীক্ষ্ণ সমালোচক Germaine Greer-এর বক্তব্য এমন: এটি প্রথাবদ্ধতা (stereotypes) ও যৌন আদর্শের (sexist norms) মধ্য দিয়ে প্রতীকীভাবে আকাঙ্ক্ষা করে নারীদের প্রতি প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। কখনও-কখনও তাদের উচ্চতর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে ঠিক, পরিণত করেছে কামনা ও রহস্যের বস্তুতে।

কবিতার কাজ পাঠককে আদিম-গূহাবান্দি করে ফেলা নয়, অবমুক্ত রেখে আনন্দোপভোগে ধাবিত করা, যে আনন্দ অবাস্তব কোনো সত্তার কল্পরূপ থেকে উৎসারিত নয়। কাঠামোবাদীরা (Structuralist) যা বলছেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, তা পাঠককে অতীতচারী এবং অবস্তুগত আনন্দোপভোগে প্রবৃত্ত করে। মানুষকে সেকেলে করার যে কোনো কাব্যপ্রয়াস অপছন্দনীয় এবং যারা এ-প্রয়াস চালাতে প্রেরণা দেন, তাদের থেকে দূরতম ব্যবধানে থাকা শ্রেয় মনে করি। কাঠামোবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক রোলাঁ বার্থ বলেছেন, যা always already written তার থেকে ধারণা বা বর্ণনা বা উপাদান নিয়ে একজন কবিকে নতুন বিন্যাসে তার নতুন কাব্যাভিযান চালাতে হয়। বার্থের কথামতো পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে কাব্যধান সংগ্রহ করতে গেলে, আমাদের এ-এলাকায় বর্তমানে দৃষ্টান্তবাদীরা যা অপছন্দ করছেন, কল্পিত-অবাস্তব চরিত্র বা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা বেশি।

মানুষ অতীত-দর্শক- এর অর্থ এই নয় যে, একজন কবিকে কবিতার লক্ষ্যে সমাজস্থ ভাষাকাঠামোকে গ্রাহ্য করে যা always already written কেবল তা অথবা তার নবীকৃত রূপ অথবা তার প্যারোডি হাজির করতে হবে এবং একই সাথে অবাস্তব পৌরাণিক বিষয়-আশয়ের সমযদার হতে হবে। কবি অতীত-সন্ধানী হোক, নিজেকে এবং অন্যকে গূহাবন্দি করে ফেলার জন্য নয়, অতীতের বাস্তব এবং দরকারি ঘটনা বা চরিত্র বা অভিজ্ঞতার সাথে বর্তমানের সংযোগসেঁতু দাঁড় করে যুক্তিধর্মী ভবিষ্যৎ রচনার স্বার্থেই। অবশ্য উল্লেখ না করলে নয়, কাঠামোবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিকদের কিছু কিছু কথার সাথে দৃষ্টান্তবাদীরা সহমত পোষণ করেন। সকল কাজই জীবনের প্রয়োজনেই, মানব-সৃষ্ট। মানুষ যেহেতু তার প্রয়োজনেই ভাষা-সৃষ্ট কর্মকাঠামো সৃষ্টি করেছে এবং এর সাহার্যে সাজিয়েছে তার চেতনা ও চৈতন্যকে, সেহেতু যেকোনো সাহিত্যকর্মও তার সৃষ্টিকরা কর্ম ও চিন্তাকাঠামোর বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু তারা যখন বলেন, মানুষের কোনো কাজই প্রাকৃতিক কিংবা সহজাত নয়, তখন একমত হতে পারি না।

দৃষ্টান্তবাদীরা মনে করেন, মানুষের কাজ অনেকাংশে প্রাকৃতিক এবং পারিপার্শ্বিক। 'প্রাকৃতিক' বলে এরা মানুষের কাজ ও জগতকে অদৃশ্যসত্তানির্ভর করেন না। দৃষ্টান্তবাদ দেব-দেবীর মতোন অতীন্দ্রিয় চরিত্র বা জগৎ নিয়েও যে কারবার করে না তা কোনো না কোনোভাবে উপরে বলা হয়েছে। এদিক থেকে বলা যায়, এ-দর্শন ভবিষ্যবাদী আবেগ থেকেও পৃথক। ফিলিপ্পো তোম্মেসো মরিনেত্তি (Filippo Tommaso Marinetti) বন্ধুদের নিয়ে যে ভবিষ্যবাদী মেনিফেস্টো প্রকাশ করেন, তাতে দ্রুতগতির মোটরকারকে নতুন সৌন্দর্যের দেবী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এবং ভূমিকায় দেব-দেবীর আদলে কোনো কিছুকে দেখাতে হলে যে অতীন্দ্রিয় বিশ্বাস মনে থাকতে হয়, তার একটি অটোবায়োগ্রাফিও রেখেছেন।

এ-ইন্দ্রিয়াতীত জগৎ প্রশ্নে এ-মতবাদ প্রতীকবাদ থেকেও পৃথক। প্রতীকবাদের (Symbolism) অন্যতম গুরু স্তেফান মালার্মে (Stephane Mallarme) বলেন- 'কোনো বস্তুর নাম বলে দেয়া মানে কবিতাটির আনন্দের তিন-চতুর্থাংশ নস্যাৎ করা, যে আনন্দ আসে একটু একটু করে আন্দাজ করার মধ্য দিয়ে…এই রহস্যময়তার নির্ভুল ব্যবহারই গড়ে তোলে প্রতীক : তিলে তিলে একটি বস্তুর আভাসকে মূর্ত করা আত্মার একটি অবস্থাকে প্রকাশ করার জন্য, অথবা, উল্টোভাবে, প্রথমে একটি বস্তুকে নির্বাচন করা এবং সেখান থেকে আত্মার একটি অবস্থাকে শনাক্ত করা, অর্থোদ্ধারের এক ক্রমপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে।… কবিতায় সর্বদায় থাকতে হবে কূটাভাস'।

প্রতীকবাদীরা অতীন্দ্রিয় জগত সম্পর্কে যে স্বাজ্ঞিক পথ অনুসরণ করছেন, তাতে দৃষ্টান্তবাদীরা সন্তুষ্ট নন। ধর্মবিশ্বাস কিংবা মরমিয়াতত্ত্বের সহযোগ ব্যতিরেকে বার্গসোঁর ((Henry Bergson) পথ অনুসরণ করে তারা যে জগতের তালাশ করছেন, তাও তো ঐন্দ্রিয়ক! ব্যাপারটা বার্গসোঁর স্বজ্ঞার ভেতর থেকে হাজির করে দেখানো যাক- ১. কোনোরূপ বিচারবুদ্ধির সাহায্য না নিয়ে একটা বস্তুকে মন দিয়ে সরাসরি উপলব্ধি করাই হল স্বজ্ঞা। ২. ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির সাহায্য ছাড়াই বস্তুর যথার্থ রূপকে উপলব্ধি করাই হলো সাক্ষাৎ প্রতীতি (Direct experience)। ৩. কোনো বিষয়ের সাক্ষাৎ প্রতীতিই স্বজ্ঞা। এখন যে-মন দিয়ে স্বজ্ঞাবাদীরা বস্তুর স্বরূপ জানতে চাচ্ছেন, তাও তো চৌদ্দেন্দ্রিয়ের একটি (যে সকল অঙ্গ বা শক্তি দ্বারা পদার্থের বা বাহ্য বিষয়ের উপলব্ধি বা জ্ঞান জন্মে এবং কর্ম সাধন করা যায়, সেগুলোকে ইন্দ্রিয় বলা হচ্ছে। ইন্দ্রিয় মোট চৌদ্দটি: যথা- চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক- এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; বাক, হাত, পা, পায়ু, উপস্থ- এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়; মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, চিত্ত- এই চারটি অন্তরেন্দ্রিয়। মন কিন্তু সকল ইন্দ্রিয়েরই পরিচালক।)!

তাহলে, বলা যাচ্ছে, ইন্দ্রিয়ের সাহার্য ছাড়া তারাও তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছেন না। সম্ভবত মন যে একটা ইন্দ্রিয়, ভারতীয় আবিষ্কার, তা বার্গসোঁরা জানতেন না! দৃষ্টান্তবাদ মানুষের যে স্বজ্ঞার জগৎ রয়েছে, তাতে আস্থা রাখে, তাকেও ঐন্দ্রিয়ক বা ইন্দ্রিয়সাপেক্ষ মনে করে। তবে এটি স্বজ্ঞার জগতের সাথে আত্মার প্রসঙ্গ টেনে এনে মানুষকে ইন্দ্রিয়নিরপেক্ষ কোনো অবস্থার দিকে চালিত করে না।

এ-মতবাদ, মানুষের অন্তর্জগৎ, যেখানে স্বপ্ন ও কল্পনার চির যাতায়াত, দৃশ্য জগতের বৈচিত্র্যপূরণ মানসচিত্রের দোলাচল, নানা প্রতীকের মাধ্যমে সেই বাস্তব জগতকে আবিষ্কার করতে প্রাণিত করে। অর্থাৎ দৃশ্য জগতের বাইরে যে বাস্তবানুগ স্বজ্ঞাজগৎ (intuitive world) রয়েছে তাকে চিত্র-বিচিত্র প্রতীকপুঞ্জের মাধ্যমে ধরা যাবে বলে এ-মতবাদও দাবি করে। আগেই বলেছি, দৃষ্টান্তবাদ, আত্মার নয় মনের অস্তিত্বে আস্থাশীল একটি দর্শন। এটি জোর দাবি করে, কবিতার কাজ মানুষের অন্তর্জগতের গুপ্ত/সুপ্ত বোধকে বাস্তবজগতের দৃষ্টান্তের সাহায্যে প্রকাশিত/জাগ্রত করা, আনন্দ দেয়া।